সহজ উঠোন

রেজিস্টার / লগইন করুন।

সব কিছু পড়তে, দেখতে অথবা শুনতে লগইন করুন।

Sahaj Uthon
21-May,2023 - Sunday ✍️ By- গৌতম চক্রবর্তী 444

ইতিহাস এবং ঐতিহ্য রক্ষাকারীর কথা কেউ ভাবেন না/গৌতম চক্রবর্তী

চির সখা হে (তৃতীয় পর্ব)

ইতিহাস এবং ঐতিহ্য রক্ষাকারীর কথা কেউ ভাবেন না
গৌতম চক্রবর্তী

মনে পড়ছে ২০১৭ সাল। দাঁড়িয়ে আছি রবীন্দ্র স্মৃতিবিজড়িত মংপুতে এক নষ্টালজিক অনুভূতি নিয়ে। এসেছিলাম কালিম্পঙে কালচারাল টুরিজমকে সামনে রেখে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শেষ জীবনের উপরে যে গবেষণামূলক কাজ করছি তার তথ্য অনুসন্ধান করতে। রবীন্দ্রস্মৃতি বিজড়িত গৌরীপুর হাউসে ক্ষেত্র সমীক্ষা করে কালিম্পং ফেরত পরিকল্পনা নিলাম মংপুতে যাব। সংস্কারের অভাব আর দার্জিলিংয়ে পৃথক গোর্খাল্যান্ডের আন্দোলনের জেরে দুই বছর বন্ধ ছিল রবীন্দ্র ভবন। পাহাড়ের বন্ধ আর আন্দোলনের জেরে মংপুতে তখন টুরিস্ট আসত না বললেই চলে। অনেক দিন ধরেই ওই ভবনের ভিতরে প্রবেশ নিষেধ ছিল পর্যটকদের। ফলে সবাই বাইরে থেকেই ভবনটি দেখে ফিরে আসতেন। অপেশাদার জার্ণালিস্ট এবং লেখক হিসাবে বিশেষ অনুরোধে ভেতরে ঢুকতে পেরেছিলাম। তবে ছবি তোলা বারণ ছিল। বাইরে থেকে ছবি নিয়েছিলাম। তখন ভবনটির অবস্থা ছিল করুণ। ছাদের কোণ দিয়ে জল পড়ছিল। মোটামুটি ভেঙে পড়ার দশা। আসবাবপত্র ও আলোকচিত্রগুলোর অবস্থা ছিল আরও শোচনীয়। কাগজে দেখেছিলাম মংপুর সংগ্রহশালা থেকে চুরি হয়ে গেছে রবীন্দ্রনাথের আঁকা আসল ছবি, ছবি আঁকার রং-তুলি-কালি, পাণ্ডুলিপি, তাঁর শখের হোমিওপ্যাথির সরঞ্জাম, দুর্লভ আলোকচিত্রসহ নানা কিছু। অকুস্থলে এসে দেখেছিলাম মংপুর এই ভবনটি থেকে চুরি হওয়া মোটেই অপ্রত্যাশিত ছিল না। কারণ রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরস্কারই তো চুরি হয়েছে। খুব রাগ হয়েছিল। বঙ্গদেশে যে স্থানগুলোতে এমন সংগ্রহ রয়েছে সেখানকার নিরাপত্তা ব্যবস্থা এত ঢিলেঢালা হবে কেন। আমাদের ইতিহাসের মূল্যবান সম্পদরাশির অধিকাংশই আমরা হারিয়েছি। তাই এই সব সম্পদের যেটুকু আমাদের দেশে রয়েছে তার নিরাপত্তায় কেন আমরা আরও যত্নবান হব না? ফিল্ড রিপোর্ট বিস্তারিতভাবে ছবিসহ পাঠিয়েছিলাম হেরিটেজ কমিশন, রাজ্য সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি দপ্তর, তৎকালীন পর্য্যটন মন্ত্রী গৌতম দেবের কাছে এবং মাননীয় মুখ্যমন্ত্রীর দপ্তরে।

দীর্ঘদিন ধরে সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে রবীন্দ্র ভবন তার জৌলুশ হারিয়ে জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছিল। বিভিন্নভাবে অবহেলায় কবির স্মৃতি বিজড়িত এই ভবন নষ্ট হতে বসেছিল। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তৎকালীন দার্জিলিং জেলার তথ্য ও সংস্কৃতি জেলা অধিকর্তা জগদীশ রায়ের সঙ্গে আলাপচারিতায় জানতে পেরেছিলাম সংস্কার জরুরি হওয়ায় পশ্চিমবঙ্গ সরকারের হেরিটেজ কমিশন ভবনটির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নিচ্ছে এবং মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ করার জন্য সুপারিশ করেছে। অবশেষে সংবাদপত্রে জেনেছিলাম ভবনটিকে হেরিটেজ তকমা দিয়েছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। ৪৫ লক্ষ টাকা ব্যয়ে মংপুতে রবীন্দ্রভবন সংস্কার করছে হেরিটেজ কমিশন এবং  জানা গিয়েছিল পশ্চিমবঙ্গ সরকারের হেরিটেজ কমিশন রবীন্দ্র ভবনটির সংস্কার করে যথাযথ সংরক্ষণ এবং একে রবীন্দ্র গবেষণার একটি কেন্দ্রে পরিণত করার সংকল্প ঘোষণা করেছেন। অত্যন্ত আনন্দ হয়েছিল। জেনেছিলাম গৌরীপুর ভবনকেও সংস্কার করে পিপিপি মডেলে একদিকে রবীন্দ্র হেরিটেজ ভবন, সংগ্রহশালা এবং অপরদিকে বাণিজ্যিক ভবন করা যায় কিনা সেই সম্ভাবনাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তখন রবীন্দ্র অনুরাগী হিসাবে একটু আশান্বিত হয়েছিলাম এবার হয়তো হাল ফিরবে মংপুর রবীন্দ্র ভবন এবং কালিম্পঙের গৌরীপুর হাউসের। ভবনে নতুন রং করা হবে, ঘরের কাঠের পাটাতন বদলে দেওয়া হবে, প্রতিটি কক্ষ সাজানো হবে। জেনেছিলাম ভবনের সার্বিক কাজ পরের ২২ শ্রাবণ কবিগুরুর প্রয়াণ দিবসের আগেই শেষ হয়ে যাবে এবং কবিগুরুর ১৫৮ তম জন্মদিনে ২৫ বৈশাখ থেকে রবীন্দ্র ভবন রবীন্দ্রভক্তদের জন্য খুলে দেওয়া হবে। এরপর থেকে সবাই নবরূপে রবীন্দ্র জাদুঘর বা রবীন্দ্র ভবনকে দেখতে পারবেন। তাই সেই কারণেই অন্তরের টানে আবার ছুটে এসেছিলাম রবীন্দ্র তর্পণে মংপু এবং কালিম্পং। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতি বিজড়িত মংপুর রবীন্দ্রভবন তখন সুন্দর করে সাজিয়ে তোলার কাজ চলছিল। এই কাজ অনেকদিন বন্ধ ছিল বলে প্রায় এক বছরেরও বেশি সময় ধরে সেখানে কাজ চলছিল। ঠিক ছিল পরের বছর পঁচিশে বৈশাখ সেই ঐতিহাসিক ভবন আবার নতুন করে পর্যটকদের জন্য খুলে দেওয়া হবে।

‘ঘন ছায়াছন্ন পথ দিয়ে মেঘ কুয়াশার রাজ্য ছাড়িয়ে মংপুতে যখন নামলাম তখন রোদ চারদিকের ধোয়া সবুজের উপর ঝিলমিল করছে, শেষ বেলাকার রোদের সুন্দর শান্ত হাসি।' 'মংপুতে রবীন্দ্রনাথ' বইটিতে মৈত্রেয়ী দেবী এভাবেই মংপুর বর্ণনা দিয়েছিলেন। আজও যেন পাল্টায় নি সেই মংপু। শিলিগুড়ি থেকে সেভক হয়ে ৫১ কিলোমিটার এবং দার্জিলিং থেকে ৩৩ কিমি দূরের ৩৭০০ ফিট উচ্চতার মংপুতে পৌঁছে সে কথাই সবার আগে মনে হল। রম্ভি থেকে অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছলাম মংপুর ‘রবীন্দ্রভবন’। যে বাড়িতে কবিগুরু বারবার থেকেছেন, সেই বাড়ি আজ রবীন্দ্র ভবন, রবীন্দ্র জাদুঘর। ভবনটি একতলা। ঘরের মেঝে তৈরি কাঠের পাটাতন দিয়ে। দেয়াল পাকা হলেও বাড়ির টিনের ছাউনির নিচে কাঠ দিয়ে সিলিং তৈরি করা। ঠান্ডা থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য বাড়িটি এভাবে গড়া হয়েছিল। কুইনাইন কোম্পানিই গড়েছিল বাড়িটি।এই বাড়ির একবার দর্শন পাওয়া ভারতের সব রবীন্দ্রপ্রেমী মানুষের কাছে স্বপ্নের। ভেতরে ঢুকলাম। কাচের দরজা-জানলা সম্বলিত দুধসাদা রঙের বাড়ি। রবীন্দ্র ভবনের সামনে সুন্দর একটি বাগান রয়েছে। বাগানে কবিগুরুর একটি আবক্ষমূর্তি আছে। মূর্তিটি ফাইবার গ্লাস দিয়ে তৈরি। প্রবেশপথের বাঁদিকে কবির মর্মরমূর্তি। সবুজ লন পেরিয়ে লম্বা টানা বারান্দা যেন নিয়ে গেল বিগত কোনও অতীতে। বারান্দায় একটি আরামকেদারায় সাদা চাদরের উপর কবি প্রতিকৃতি স্ব-মহিমায় ভাস্বর। সামনে ফুলের অর্ঘ্য, সুগন্ধী ধূপ। এখানে কবি প্রতিদিন ভোরবেলা সমাহিত চিত্তে ধ্যানে বসতেন। তাঁর চেয়ার-টেবিলটি সযত্নে রাখা। ছবির সামনে পড়ে কিছু ক্যামেলিয়া। এই বাড়িকে ঘিরে রয়েছে না বলা কত ইতিহাস। তখন রান্নাঘরটি ছিল ভবনের বাইরে। এখন নেই। এখানে ছিল কবিগুরুর উপাসনাগৃহ। উপাসনাগৃহের পেছনে ছিল বিরাট এক পাহাড়ি গাছ। কবিগুরু গাছটির নাম দিয়েছিলেন ‘সপ্তপর্ণী’। বহু বছরের পুরনো ‘সপ্তপর্ণী’ গাছটি এই বাড়ি ঘিরে আজও দন্ডায়মান। 

এ বাড়ির গাছটিকে নিয়েই কবি  লিখেছিলেন ‘ক্যামেলিয়া’ কবিতাটির একটি স্তবক। সামনের বারান্দায় বসে লিখেছিলেন ‘মংপু পাহাড়ে’। বাড়ির ভেতরে তাঁর ব্যবহৃত জিনিস, পাণ্ডুলিপি ছিল সুন্দরভাবে সাজানো। এই ভবনে রয়েছে কবিগুরুর কিছু দুষ্প্রাপ্য জিনিস, ব্যবহৃত চেয়ার, খাট, বিছানাপত্র, রিডিংরুম, শয়নঘর ইত্যাদি। কবিগুরু ছবি আঁকতে যেসব রং ব্যবহার করতেন সেসব রঙের বাক্সও রয়েছে। আছে একটি দেয়াল আলমারি। এই আলমারিতে কবিগুরু ওষুধ রাখতেন। রিডিংরুমের পাশে শয়নকক্ষ। এখানে রয়েছে কবিগুরুর ব্যবহৃত একটি সিঙ্গল খাট। খাটের ওপর তোশক, বিছানা। শয়নকক্ষের পাশে বাথরুম। সে যুগে এখানে বানানো হয়েছিল ইট-বালু দিয়ে বাথটাবও। পাশে রাখা হতো গরম জল। গরম জলের সঙ্গে ঠান্ডা জল মিশিয়ে স্নান করতেন কবিগুরু। মংপুর পাহাড় ঘেরা রবীন্দ্র ভবন পর্যটকদের কাছে প্রধান আকর্ষণ। উল্লেখ্য, চার বার মংপুতে এলেও পঞ্চম বারও মংপুতে আসার জন্য উদ্যোগী হয়েছিলেন কবিগুরু। কিন্তু অসুস্থ হয়ে পড়ায় কালিম্পং থেকেই কলকাতা ফিরে গিয়েছিলেন তিনি। সে সময় তিনি অবশ্য তাঁর ওষুধসহ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আগেভাগে পাঠিয়েছিলেন এই রবীন্দ্রভবনে। এই ভবনে কবিগুরুর পাঠানো সে সব ওষুধ অত্যন্ত যত্ন সহকারেই সংরক্ষণ করা ছিল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে সময়ে মংপু ভ্রমণ করেছিলেন তখন যোগাযোগ ব্যবস্থা এতটা উন্নত ছিল না। কাজেই পালকির মাধ্যমেই তিনি মংপু যাতায়াত করতেন। দেখেছিলাম সেই পালকিটাও রবীন্দ্র ভবনে রক্ষিত আছে। রবীন্দ্র জাদুঘরে রয়েছে কবিগুরুর নানা স্মৃতিস্মারক। সংগ্রহশালায় রাখা ছিল রবীন্দ্রনাথের ছবি আঁকার রঙ-তুলি-কালি, আঁকা ছবি, আর অসংখ্য আলোকচিত্র। ছিল তাঁর নিজের নকশা করা আসবাবপত্র। স্নানের সুবিধার জন্য স্নানঘরে নিজের নকশায় ঠান্ডা ও গরম জল সরবরাহের কৌতূহলোদ্দীপক ব্যবস্থাটি কবির সৃজনশীল মানসের আরেকটি পরিচয়। তুলি রাখার একটি বাঁশদানি দেখেছিলাম যার গায়ে খোদাই করে এবং তার কালি ঘষে ছবি ফুটিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁর এমন সৃষ্টির কথা জানাই ছিল না।

দেখেছিলাম মূল ঐতিহাসিক কাঠামো ঠিক রেখে ওই ভবনের মেঝে সুন্দর করে তোলা হচ্ছিল। ভিতরে বাইরে রং করা হচ্ছিল। আগে বৃষ্টির সময় ভিতরে জল পড়ত। যাতে তা না হয়, তার ব্যবস্থা হচ্ছিল। হচ্ছিল আরো অনেক কাজ। পুরো ভবনটি নতুন করে রং করার পাশাপাশি ভিতরের মেঝের কাঠের পাটাতন নতুন করে তৈরি করা হয়। ২০১৮ সালের ২৫ বৈশাখ নতুন রূপে রবীন্দ্রভবনের দরজা পর্যটকদের জন্য আবার খুলে দেওয়া হয়। এর কৃতিত্ব অবশ্যি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এবং তৎকালীন পর্য্যটন মন্ত্রী গৌতম দেবের। আমাদের গাড়িটা রবীন্দ্রভবনের গেট পেড়িয়ে গিয়ে থামতেই এগিয়ে এসেছিলেন শিশির রাহুত। মংপু রবীন্দ্রভবনের কেয়ারটেকার তথা গাইড, তথা সব কিছু। সেই প্রথম পরিচয়। কুইনাইন ফ্যাক্টরির প্রবেশদ্বারের ঠিক উল্টোদিকে রবীন্দ্রভবনে ঢুকবার রাস্তা। ঢুকেই বাগান। বাগানে রবীন্দ্রনাথের আবক্ষ মূর্তি। বারান্দায় সাদা চাদরে ঢাকা চেয়ার, চেয়ারে রবীন্দ্রনাথের প্রতিকৃতি। প্রতিকৃতির পেছনে মৈত্রেয়ী দেবী-কৃত রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কিত তাম্রলিপি যাতে বাংলা, হিন্দি আর নেপালি ভাষার ব্যবহার করা হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ যখন পালকিতে সওয়ারি হয়ে সাড়ে ছ-মাইল থেকে মংপু যেতেন তখন কবিগুরুকে পালকিতে করে নিয়ে আসতেন ভীমলাল রাহুত। রম্ভি থেকে মংপু পর্যন্ত পথ উঠে গেছে একেবারে মংপুর পাহাড়ের শীর্ষে। তখনকার পালকির সর্দার ছিলেন ভীমলাল রাহুত। তাঁরই নেতৃত্বে ৮ থেকে ১০ জনে মিলে পালা করে মংপু পাহাড়ে নিয়ে আসা হতো কবিগুরুকে। বর্তমান রবীন্দ্র ভবনের কেয়ারটেকার শিশির রাহুতের ঠাকুরদাদা ছিলেন ভীমলাল রাহুত। শিশির রাহুত তাঁরই সুযোগ্য নাতি। দাদুর সুবাদে শিশিরবাবুর বাবাও কবিগুরুকে দেখেছেন। শিশিরবাবুর রক্তে তাই মিশে গেছেন রবীন্দ্রনাথ। শিশির রাহুতের কাছ থেকে জেনেছিলাম ১৯৫৪ সালে মৈত্রেয়ী দেবীর উদ্যোগে এই বাড়ি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের শ্রমকল্যাণ দপ্তর দেখাশোনার দায়িত্ব নেন। 
এখানে তখন দপ্তরের পরিচালনায় স্থানীয় ছেলেমেয়েদের নিয়ে নাচের স্কুল, সেলাই স্কুল ইত্যাদি চলত। তাদের জন্যে ব্যবস্থা ছিল ক্যারাম বা টিটি খেলারও। ২০০০ সালে তখনকার নগর উন্নয়ন দপ্তরের পরিকল্পনা অনুযায়ী বাড়িটিকে মিউজিয়াম বানানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সেইভাবে সংস্কার প্রক্রিয়া চলে। স্থানীয় মানুষ, সরকারি কুইনাইন ফ্যাকট্রি এদের নিয়ে গড়া হয় কমিটি। তখন থেকেই শিশির রাউত মিউজিয়ামের দায়িত্বে। শিশিরবাবুর কাছ থেকেই জানতে পেরেছিলাম ওই সময় থেকেই রবীন্দ্রভবনের রক্ষণাবেক্ষণের আর্থিক দায়িত্বে নিয়মিতভাবে আর কেউ থাকে নি। মুখে এক স্থায়ী বিষন্নতা নিয়ে জানিয়েছিলেন রবীন্দ্রভবনের নির্মাণটিকে ঠিকঠাক রাখা বড় অসম্ভব হয়ে উঠছে দিন দিন। না জিটিএ, না রাজ্য সরকার কারুরই দায়িত্বে নেই এমন মূল্যবান ঐতিহাসিক আবাস। কাজেই কোনও অসুবিধেয় পড়লে সরকারি অফিসে ছুটোছুটি আর ধরাধরির একশেষ হতে হয়েছে। ২০০৬ সালে স্থানীয় সাংসদের এমপি ফান্ডের টাকায় কিছু সংস্কার কর্মসূচি নেওয়া হয়। ২০১১ সালের ১৪ এপ্রিল ঝড়ে দুটো গাছ ভেঙে পড়েছিল। ফলত, বাড়ির ডানদিকের বেশ কিছু অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী অনেকবার পাহাড় সফর করেছেন। তিনি মংপুতে এসেছিলেন তিনবার এবং শিশির-দীপেনদের বক্তব্য অনুযায়ী রবীন্দ্রভবন নিয়ে এই সমস্যার সমাধান করবেন বলে মুখ্যমন্ত্রী নাকি কথাও দিয়েছিলেন। শিশিরবাবুর যুক্তি ছিল, কালিম্পং-এ রবীন্দ্রনাথের স্মৃতি-জড়ানো বাড়ি গৌরীপুর ভবনের অবস্থা এর চেয়ে অনেক বেশি গুরুতর। আইনের বাধা না থাকলে গৌরীপুর বা মংপুর রবীন্দ্র-মিউজিয়ামের দায়িত্ব নিতে পারে জিটিএ। যেহেতু মংপুর রবীন্দ্র ভবনের আরেক অংশের পরিচালনায় তারা আগে থেকেই নিয়োজিত আছে। শুধু দরকার এ ব্যাপারে তাদের একটু উদ্বুদ্ধ করা। রবীন্দ্র অনুরাগী অসংখ্য পর্যটক মংপু রবীন্দ্র ভবনে ভিড় জমান। শিশিরবাবুই পর্যটকদের গাইডের কাজ করে দেন। বাংলা, নেপালি, হিন্দি এবং কিছুটা ইংরেজিতেও কথা বলতে পারেন। কত আর আয় হয় তাঁর! 

সকাল সকাল এসে শিশিরবাবুর কাজ রবীন্দ্রভবন পরিষ্কার করা। পর্যটকেরা এলে চাবি নিয়ে এগিয়ে আসেন দরজা খুলে দিতে। কোনো পর্যটক না থাকলে রবীন্দ্রভবনের দরজা বন্ধ করে গাছতলায় কিছুক্ষণের জন্য বসেন, গাছের ছায়ায় বসে মাথা কাত করে গান গেয়ে যান শিশিরবাবু। শিশিরবাবুর কথা বলা এবং গান গাওয়ার একটা নিজস্ব ভঙ্গিমা রয়েছে। এই নিয়ে চলেছে তাঁর জীবন সংগ্রাম। জেনেছিলাম ১৮৬৪ সালে তৈরি হওয়া যে গভর্নমেন্ট কুইনাইন ফ্যাকট্রি রবীন্দ্রভবনের ঠিক মুখোমুখি রয়েছে তার পরিচালকেরা একজন মালিকে বহাল করেছেন বাড়ি-বাগান সাফসুতরো রাখার কাজে আর রবীন্দ্র মিউজিয়াম দেখাশোনা করেন শিশির রাউত। তাঁকে কারখানা কর্তৃপক্ষ দিচ্ছেন মাসে খুব সামান্য মাসোহারা যা দিয়ে শিশিরবাবুর সাংসারিক দায় কোনমতেই মেটে না। রবীন্দ্রভবনেই একটা গ্রন্থাগার রয়েছে এরিয়া লাইব্রেরির নামে। তার লাইব্রেরিয়ান দীপেন তামাং জিটিএ-র বেতনভোগী কর্মচারি। তিনিও একমত ছিলেন মিউজিয়ামের রক্ষণাবেক্ষণ আর তার  ইন-চার্জের পরিশ্রমের বিনিময় মূল্য এই দুটোর ব্যবস্থা করা একান্ত দরকার। শিশিরবাবুর কাছ থেকেই জেনেছিলাম রবীন্দ্রনাথ মংপুতে শেষ এসেছিলেন ১৯৪০ সালের ২১ শে এপ্রিল। ২৫ শে বৈশাখের অনুষ্ঠান পালন করে চলে যান কালিম্পঙে। সে বছরই সেপ্টেম্বরে আসতে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু অসুস্থ শরীর নিয়ে প্রথমে কালিম্পঙে এলেও মংপুতে আর আসতে পারেন নি। কিন্তু মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলেন আসবার জন্য। তাই হয়তো আসবার আগে  পাঠিয়েছিলেন নিজের ওষুধের কৌটো। কিন্তু শারীরিক অসুস্থতার জন্য তিনি নিরুপায় হয়ে কলকাতায় ফিরে  যান। রবীন্দ্রস্মৃতি ধন্য মংপুর ভবনে  আজও রক্ষিত সেই কৌটোগুলি। শুধু ওষুধের কৌটোই নয়, ষোলোটি ঘরের এই বিরাট ভবনটিতে রয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ব্যবহৃত খাট, তোশক, বিছানা। তাঁর নিজের নকশায় তৈরী চেয়ারটিও যত্নে রাখা। চেয়ারের ওপর রয়েছে তাঁর ব্যবহৃত কুশনটিও। রক্ষিত কবি ব্যবহৃত রঙের বাক্স। প্রতিটি ঘরেই রাখা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অসংখ্য নিদর্শন, ব্যবহৃত সামগ্রী। রয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্য আনা এক আনা দামের ন্যাশনাল হেরাল্ডের একটি কপিও। বেশ কিছু দামি ফোটোগ্রাফও রয়েছে, তবে অযত্নে সেগুলির দশা অত্যন্ত সঙ্গীন। 
আজ এই বাড়িটি জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত। দেখে নেওয়া যায় স্মৃতিভবনের সবকিছুই, এমনকি ইট ও বালি দিয়ে বানানো বাথটবটিও। রবীন্দ্রস্মৃতি ভবনের বর্তমান কেয়ারটেকার শিশির রাউত উদাত্ত কণ্ঠে রবীন্দ্রসংগীত গাইতে গাইতে গাইড করেন পর্যটকদের। নেপালি মানুষটার কন্ঠস্থ কত-কত কবিতা, নিখুঁত সুরে গাইতে পারেন কত যে রবীন্দ্রসংগীত কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে তা ভাবাই যায় না। ইতিহাস এবং ঐতিহ্য রক্ষা করেন শিশিরদা, অথচ সম্মানজনক পারিশ্রমিক প্রদান করে তাঁকে ও তাঁর পরিবারকে কি রক্ষা করতে পারে না রাজ্য সরকার বা জিটিএ?

আপনাদের মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴
software development company in siliguri,best
                          software development company in siliguri,no 1 software
                          development company in siliguri,website designing company
                          in Siliguri, website designing in Siliguri, website design
                          in Siliguri website design company in Siliguri, web
                          development company in Siliguri