ইকো টুরিজমের সন্ধানে লাটাগুড়ির জঙ্গলে/গৌতম চক্রবর্তী
ইকো টুরিজমের সন্ধানে লাটাগুড়ির জঙ্গলে
গৌতম চক্রবর্তী
ভ্রমণের ভূত কাঁধে চেপে বসে আছে বলে পায়ের তলায় যেন সর্ষে। পথে চলার আনন্দ পথিকই অন্তর দিয়ে অনুভব করে। আমি নিত্য চলার পথিক। ঘরের বাঁধন অসহ্য। তাই বেড়িয়ে পড়ার তাগিদ প্রতিনিয়ত অনুভব করি। যখন যেখানে ইচ্ছে দূরে অদূরে বেরিয়ে পড়ি। আসলে চরৈবেতি একপ্রকার নেশা। কবির ভাষায় ‘দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া’। এভাবেই মেটেলি হাট, চালসার চা বাগানে, গরুমারা, চাপড়ামারির জঙ্গলে ছুটে আসি বারংবার। এবারেও লাটাগুড়ি এসে পৌঁছলাম শনিবার বিকেলে। উঠেছি তাপসদার ‘ধুপঝোড়া সাউথ পার্কে’। খড়ের ছাউনি, বাঁশের বেড়া দেওয়া ছোট ছোট কুটির। সত্যি নান্দনিক, অপূর্ব শিল্পকর্ম। অনেক আগে থেকেই বিভিন্ন ঋতুতে সাউথ পার্কে গিয়ে থাকতাম। ঘোর বর্ষায়, শীতে, বসন্তে যারা না থেকেছেন তারা সে আনন্দ উপভোগ করতে না পারলে জঙ্গল সফর বৃথা। সন্ধ্যায় প্রদীপ ওঁরাওদের নাচ-গান, মাদলের ধিতাং ধিতাং বোল। বাঁশের মাচায় বসে জ্যোৎস্না প্লাবিত মূর্তি নদীর দৃশ্য বড়ই মনোরম। ‘ধূপঝোড়া সাউথ পার্কে' জ্যোৎস্নায় মূর্তির চরে গন্ডার আর দিনের বেলায় মূর্তি নদীতে হাতিদের গান। এ সবই জীবনের পরম পাওয়া। আজ বের হব উদ্দেশ্যহীন সফরে। শীত এলেই ডুয়ার্সে পর্যটকদের ভিড় বাড়ে। সারাবছর ধরে হাজার হাজার পর্যটক আসেন উত্তরবঙ্গে। সেবারে বেড়াতে এসে দেখেছিলাম ইকো রিসর্টে বেড়াতে আসা পর্যটকদের হাতে অতিরিক্ত কোন খরচ ছাড়াই ওয়েলকাম কিট তুলে দিচ্ছে রাজ্য বনদপ্তর। উত্তরবঙ্গের জঙ্গল এবং পাহাড় ঘুরে দেখার পাশাপাশি ডুয়ার্সের বনবস্তি স্বনির্ভর দলের মহিলাদের হাতে তৈরি পরিবেশবান্ধব পাটের সুদৃশ্য ব্যাগ দেশী-বিদেশী পর্যটকদের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছিল। নানা ধরনের পাটের উপহার নজর কেড়েছিল। ভাবলাম কারা বানায় এই ধরনের সুদৃশ্য ব্যাগ একটু খোঁজখবর করি। ধুপঝোরা সাউথ পার্কের তাপসদার কাছ থেকে বনবস্তির ঠিকানাটা চেয়ে নিলাম।
পত্রিকাতে পড়েছিলাম ডুয়ার্সের গরুমারা জঙ্গলের আদিবাসী স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মহিলারা সরকারি উদ্যোগে প্রশিক্ষণ নিয়ে পাটের ব্যাগ তৈরি করছেন, কাগজের মন্ড দিয়ে অদ্ভূত মুখোশ তৈরি করছেন। প্রতিটি ব্যাগ তৈরির জন্য মহিলারা ৩০ টাকা করে পাচ্ছেন, মুখোশের জন্য ১০ টাকা। ফলে ওই হস্ত শিল্পীরা উপকৃত হচ্ছেন। এতে একদিকে পর্যটকদের আকর্ষণ করা যাচ্ছে, অন্যদিকে মহিলাদের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হচ্ছে। ব্যাগ তৈরির খরচ বহন করে বনদপ্তর। ওয়েলকাম উপহার হিসাবে বনদপ্তর এর নিজস্ব উদ্যোগে তৈরি খাঁটি মধু, এছাড়াও টুথ ব্রাশ, সাবান, শ্যাম্পু পাউচ, সকালের জলখাবার ছাড়াও থাকে জলের বোতল। এতসব উপহার মিললেও পর্যটকদের এর জন্য অতিরিক্ত টাকা দিতে হয় না। বনবস্তির বধূদের স্বাবলম্বী হয়ে ওঠার খবর পত্রিকাতে পড়েছিলাম। আজ স্বচক্ষে দেখব বলে রওনা হলাম। আসলে লাটাগুড়িকে কেন্দ্র করে বিভিন্নরকমভাবে যে ইকো টুরিজমের বিকাশ ঘটছে তার খোঁজখবর কে রাখে? সোজা চলে এলাম গরুমারা জঙ্গল লাগোয়া সুশীলাদের বনবস্তিতে। দেখলাম সুশীলা, চিন্তামণি, রাধা কোরা সহ আরো অন্তত তিরিশ জন অতি সাধারণ আদিবাসী গৃহবধূ স্থানীয় মন্ডপের ছায়ায় বসে কাজ করছেন। পরিচয় হল সুশীলাদির সঙ্গে। সরু ফ্রেমের চশমার কাঁচ লাল শাড়ির খুঁটে মুছে নিলেন একবার। চিকন তুলির আঁচড়ে নিপুণভাবে দৃষ্টিদান করলেন। ডোরাকাটা বাঘের হিংস্রতা ফুটিয়ে তুলতে আরও কিছু রং দিলেন। কয়েক মিনিটের মধ্যে আস্ত একটা মুখোশ তৈরি করলেন ডুয়ার্সের গরুমারা জঙ্গলের বিচাডাঙা বস্তির আদিবাসী রমণী সুশীলা পাইক। পরিচয় হল চন্দ্রমা, চিন্তামণি, রাধা কোরার সঙ্গেও। কাজের সুবিধার জন্য সুশীলারা দুটো স্বনির্ভর গোষ্ঠী তৈরি করেছেন। প্রতিটি গোষ্ঠীতে রয়েছে পনের জন করে সদস্যা। গোষ্ঠীগুলির মধ্যে কোনো প্রতিযোগিতা নেই। প্রশিক্ষণ নিয়েছেন প্রত্যেকে।
“কিভাবে বানান মুখোশগুলো”? জিজ্ঞেস করলাম সুশীলাদিকে
"পুরনো খবরের কাগজ, মাটি, আঠা এবং রং লাগে মুখোশ তৈরীর জন্য। কাগজের মন্ড ছাঁচে ফেলে নানান রূপ দেওয়া হয়। আঠা শুকোলে খড়িমাটির প্রলেপ দিয়ে রং করা হয়"। জানলাম সুশীলাদির কাছ থেকে। চাতালের মেঝেতে বসে কাজ দেখতে দেখতে জানলাম সুশীলা দেবীর ছোট ছেলে সুমন একাদশ শ্রেণী এবং মেয়ে সবিতা দ্বাদশ শ্রেণীর পড়ুয়া। স্বামী অস্থায়ীভাবে বিভিন্ন কাজ করে যে রোজগার করেন তা দিয়ে পেটের ভাত জুটলেও অন্য কিছু হয় না। বনবস্তির গৃহবধূরা মুখোশ তৈরি করে যা পান তা দিয়ে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া ছাড়াও পুজোর কেনাকাটা হয়ে যায়। সংসারের বিভিন্ন কাজ সামলে সকাল দশটা থেকে দুটো পর্যন্ত খেটে একটা মুখোশ তৈরি করতে পারেন মহিলারা। একটি মুখোশের জন্য খরচ হয় প্রায় পনের টাকা। বনদপ্তর সেটা পঞ্চাশ টাকায় কিনে নেয়। রোজগারের বেশিরভাগটা ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার জন্য খরচ করেন তারা। গৃহবধূ রাধা কোরা, চন্দ্রমা এবং চিন্তামণির কথায় কাজ করে তারা মিলেমিশে। মুখোশ তৈরি করে মাসে মাথাপিছু গড়ে তিন হাজার টাকা রোজগার। তাদের কাজ পর্যটক নির্ভর। পুজোর সময় পর্যটকদের ভিড় বেশি থাকে। তাই মুখোশের চাহিদাও বাড়ে। রোজগারও বেশি হয়। ইকো ট্যুরিজমের দ্রুত বিকাশ ঘটায় লাটাগুড়ির অর্থনীতি চাঙ্গা হয়েছে ধীরে ধীরে। আসলে দুয়ার হতে অদূরে যা অনেকের নজর কাড়ে না সেই ছোট্ট শিশির বিন্দুর অসামান্য সৌন্দর্য মনকে আনন্দে ভরিয়ে তোলে।
রোমাঞ্চে ঘেরা এমনই একটি নাম লাটাগুড়ি। ঘুমিয়ে থাকা ছোট্ট এই জনপদ বিশ্ব পর্যটন মানচিত্রে সাড়া জাগিয়েছে প্রথম থেকেই। শিলিগুড়ি থেকে মহানন্দা অভয়ারণ্যের মধ্য দিয়ে সবুজ পাহাড় পেড়িয়ে মালবাজার, চালসা হয়ে গরুমারা জাতীয় উদ্যানের পাশ দিয়ে বিছাডাঙ্গা হয়ে লাটাগুড়ি বাজার যাওয়া যায়। ওদলাবাড়ি, যোগেশচন্দ্র, কৈলাসপুর চা বাগান, আপালচাঁদ ফরেস্ট, ক্রান্তি হয়েও লাটাগুড়ি বাজার যাওয়া যায়। জলপাইগুড়ি থেকে ময়নাগুড়ি, মৌলানি বাজার, লাটাগুড়ি। লাটাগুড়িতে ছিল গা ছমছমে পরিবেশ। দিনের বেলাতেই বাঘের গর্জন শোনা যেত। জনসংখ্যা বৃদ্ধি, মানুষের লোভ লালসা এবং জীবিকার তাগিদে ক্রমশ সংকুচিত হয়ে এসেছে জঙ্গল। খাদ্যাভাবে হাতি গন্ডার ঢুকে পড়ছে লোকালয়ে, বিঘ্নিত হচ্ছে নিয়মিত যাতায়াতের পথ। জঙ্গলের ভিতরে কংক্রিটের জঙ্গল। রিসর্টে দলে দলে আসছেন টুরিস্টরা। বনদপ্তর, পরিবেশ দফতর ঠুঁটো জগন্নাথ। পঙ্গপালের মতন হাতির দল ঝাঁপিয়ে পড়ছে শস্যক্ষেত্রে। গ্রাম বস্তির লোকজনেরা মশাল জ্বেলে রাত জাগে। মাঝেমধ্যে লাটাগুড়ি বাজারের স্টেশন পাড়ায় হাতিরা ঘোরাঘুরি করে। হাতির লাথির বাড়ি খেয়ে প্রতিবছর লোকজন মারাও যায়। নেওড়া নদী পার হয়ে খাগরিজান আমলকি বন, চা বাগান বনবস্তি। নেওড়া নদীর উপরে এখন কংক্রিটের সেতু। সাউথ পার্ক থেকেই আমাদের পর্যটন সঙ্গী বিনোদ। ধুপঝোরা সাউথ পার্কের তাপসদা স্থানীয় ছেলে বিনোদকে দায়িত্ব দিয়েছে আমাদের গাইড করার জন্য। জঙ্গলের রাস্তা। কখন কি হয়ে যায় কিচ্ছু বলা যায় না। বিনোদ চাষবাসের গল্প, হাতির অত্যাচার নিয়ে ভাষণ দিতে দিতে চলেছে। পাকা ধান নুইয়ে পড়েছে। দেখতে দেখতে চলে এলাম নেওড়া নদী চা বাগানের কাছে। সাপ্তাহিক হাট বসেছে। বিনোদকে বলি, ‘একটু থাম। হাটটা পরিক্রমা করি’। হাট জমে উঠেছে। তেলেভাজার দোকান। জিলাপি, বুন্দিয়া, নিমকি বিক্রি হচ্ছে। হাটের মধ্যে মাইক ফুকে বলছে ‘ষান্ডেকা তেল / মাদারিকা খেল’। ‘ছারপোকা মারা, উকুন মারার ঔষধ। বিফলে পয়সা ফেরৎ’।
আমি ভবঘুরের মতন হাটের মধ্যে ঘুরছি। শুটকি মাছের ঠেক, নদীয়ালি মাছও আছে। আছে শুয়োরের মাংস, হাড়িয়া। ডুয়ার্সের হাট শুধুই কেনাবেচা এবং লাভ লোকসানের খতিয়ান নয়। হাট তখন তুঙ্গে। বাবু শ্রমিকদের পকেট গরম। বাঁ দিকে তাকাতেই চক্ষু ছানাবড়া। মদের যেন ফোয়ারা ছুটছে। বাঁ দিকে তাকাতেই চক্ষু ছানাবড়া। মদের যেন ফোয়ারা ছুটছে। ভাটিখানা গমগম করছে। খোলা আকাশের নিচে হাঁড়িয়া, দেশী মদ গ্লাসে গ্লাসে ভর্তি করে আকন্ঠ পান চলছে। কোথাও সারি সারি বেঞ্চ, আবার কোথাও বা হাইবেন্চ। মাথায় একটু খানি কাপড় টানানো। সেটি ফাৎনার মত কাঁপছে। পরিবেশনকারিনীরা সেজেগুজে খুশিতে ডগোমগো হয়ে ঢেলে দিচ্ছে পাণীয়। ওপাশে আলুর দম, মাছ ভাজা এবং ঘুগনির চাট। এমন ওপেন বার সহসা চোখে পড়ে না। ক্যামেরা সঙ্গী বিনোদকে বললাম মদ্যপানের কিছু দৃশ্য নিয়ে নাও। হাঁটতে হাঁটতে ভিড় ঠেলে মাছের বাজারের দিকে এগিয়ে চলি। কত বিচিত্র রকমের মাছ। আমি কাছেই কাঠের খুপরি ঘরের দিকে এগোলাম বিশ্রামের আশায়। আমার উদ্দেশ্য ছিল একটু চা পান এবং বিশ্রাম। ঘরটিকে অন্তত বাইরে থেকে সেইরকম মনে হয়েছিল। ভেতরে আলো-আঁধারি পরিবেশ। মনে হল প্রাগৈতিহাসিক মাটির মেঝেতে কেউ চট পেতে কেউ বা আবার বেঞ্চে বসে ঢোঁকে ঢোঁকে গিলছে দেশি ধেনো। গেঞ্জি পড়া, খাঁকি হাফ প্যান্ট পরা এক যুবক টাকা গুনে গুনে নিচ্ছে। হঠাৎ আমার আগমনে চেহারা, পোশাক এবং বিশেষত ক্যামেরা, বুম ইত্যাদি দেখে একটু ঘাবড়ে গেল। সবিনয়ে বললাম, “একটু বসবো এখানে?” ছেলেটি বলল,”বসুন, মাল খাবেন? বিলিতি চাইলে এনে দিতে পারি”। ওপাশ থেকে মুন্ডা অথবা ওরাঁও জাতির কেউ একজন প্রলাপ জড়িত স্বরে বলল “বাবুরা হাঁড়িয়া আর পচাই খায় না, ফরেন মাল খায়”। নোংরা একটা পর্দার আড়াল থেকে মদ আসছে আর গ্লাসে ঢালা হচ্ছে। ভেতরে উঁকি দিয়ে দেখি জারকিনে প্রচুর মদ মজুদ রয়েছে।
আমার পাশে বসে থাকা এক আদিবাসীর হাতে দামী মোবাইল। পরনে টকটকে লাল জামা। গায়ের রং তামাটে। দু গ্লাস খাবার পর সিগারেট ধরিয়ে ধোঁয়া ওড়াতে থাকে এবং টলতে টলতে দোমড়ানো মোচড়ানো টাকা ছুঁড়ে দিলো ছেলেটাকে। টলতে টলতে কাস্টমার চলে যাবার পর ছেলেটি আমার কাছে এল। তার চোখে বিস্ময়। মদ পান না করে একটা অপরিচিত লোক কেন এই ঝুপড়ি ঘরের মধ্যে বসে থাকবে? ছেলেটিকে বললাম,“তুমি নিশ্চিন্ত থাকো। আমি পুলিশ, গোয়েন্দা অথবা এক্সাইজের লোক নই। স্রেফ হাট দেখতে এসেছি"। "কিছু লিখবেন টিকবেন নাকি স্থানীয় দৈনিকে?” সমাগত বিপদের সম্ভাবনাতে তার মন থেকে সন্দেহ দূর হয় না। “কোথায় লিখব? দেখার আনন্দে এসেছি। আমার এক বন্ধু এসেছে। ওর বড্ড ছবি তোলার শখ”। “তাই নাকি? কোথায় তিনি আছেন?” জানালাম, “ধারেকাছে”। ধীরে ধীরে ওর মন থেকে সন্দেহ দূর হয়। হঠাৎ করে আমার কানে কানে বললো “এসব মস্তানদের বিরুদ্ধে কিছু লিখুন তো, ওদের যন্ত্রণায় ব্যবসা-বাণিজ্য লাটে উঠেছে। মদ খাবে বিনা পয়সায়”। আমি মাঝে মাঝে জেনে নিচ্ছি কয় বোতল বিক্রি হয়, জল মেশায় কিনা। ছেলেটি বলল, “একটা কিছু পেলে এই নোংরা ব্যবসাটা ছেড়ে দেব। স্টেশনারীর দোকান দেওয়ার ইচ্ছে আছে”। চিৎকার হৈ হট্টগোল শুনে বাইরে বেরিয়ে এসে দেখি বিনোদকে টানাহেঁচড়া করছে কয়েকজন। বিনোদ নির্বিকার। বিনোদের গলায় ঝুলছে আমার ক্যামেরা। ছেলেটিকে বললাম “কি করে উদ্ধার করি বলতো”? মদের দোকানের ছেলেটি বলল, “আমি গেলে আর রক্ষে নেই। রক্তারক্তি কান্ড বেধে যাবে। আমার সঙ্গে ঝগড়া বেধে যাবে"। আমি এগিয়ে যেতেই কিছু মদেশিয়া, নেপালি এবং বাঙালি যুবক প্রায় জাপ্টে ধরে এই মারে তো ওই মারে। একটি বাঙালি যুবক নেশায় টলমল, মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছে না।
আমার বুকে আলতো করে একজন ধাক্কা দিয়ে বলল, “রিপোর্টারগিরি বের করে দেবো"। আর সেইসঙ্গে অশ্রাব্য ভাষায় গালাগালি দিতে দিতে আমাদেরকে টেনে নিয়ে চলল যেখানে মদেশিয়া রমণীরা মদ বিক্রি করছে সেখানে। টেনে নিয়ে বসালো। মদেশিয়া মেয়েটিকে ফুলিয়া সম্বোধন করে তাকে বলল, “দে দেখি, রিপোর্টারকে এক গ্লাস হাঁড়িয়া”। আমি হাসবো না কাঁদবো কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না। কিভাবে উদ্ধার পাব তাও বুঝে উঠতে পারছি না। এই অবস্থায় মাথা ঠান্ডা রেখে মাতালগুলোকে বললাম, “কি হলে খুশি হবেন বলুন”? এক মাতাল বলল, “কাগজে লিখে দিতে হবে, কোথাও ছাপা হবে না”। সমবেত মাতালেরা বলল, “রাইট”। শুঁড়িখানা থেকে একখানা কাগজ ছিঁড়ে আনল একজন। গড়গড়িয়ে দু চার লাইন লিখে দিলাম। এক মাস্তান ছোঁ মেরে কাগজখানা নিয়ে বলল, “এখন এখান থেকে মানে মানে কেটে পড়ুন, না হলে ভারী ঝামেলায় জড়িয়ে পড়বেন”। ফটোগ্রাফার বন্ধুকে মুক্ত করে রাস্তার ওপরে আসি। রাস্তার দু’ধারে কেনাকাটি চলছে। এক কোণে দাঁড়িয়ে চিন্তা করি কোথায় যাওয়া যায়। আকাশে ঘন মেঘ। শীতল হাওয়ায় মনে হলো এই বুঝি বৃষ্টি এলো। দুজনে ঘেমে স্নান। হঠাৎ দেখি স্যান্ডো গেঞ্জি পরা সেই ছোকরা হাঁপাতে হাঁপাতে আমাদের কাছে এলো। আমার কানে কানে বললো, “দিন, খবরের কাগজে ছেপে দিন। এদের যন্ত্রণায় আমার ব্যবসা লাটে উঠল। চলুন চা খাওয়া যাক”। আমি বললাম, “আমি চা খাব না। তুমি বরং আমাদের হাটটা ভালো করে ঘুরিয়ে দেখিয়ে দাও। “এক মিনিট দাঁড়ান। দোকানে কাউকে বসিয়ে রেখে আসি। বুঝতেই পারছেন বিনা পয়সায় নেশা করার দল আবার ঝামেলা পাকাবে। এক দৌড়ে যাব আর আসব”। ভাটিখানার ছোকরার জন্য অপেক্ষা করলাম অনেক্ষণ। কিন্তু সে আর আসে নি।
হাট পেরিয়ে নেওড়ানদী চা বাগান। বাবু, ম্যানেজারদের কোয়ার্টার বাংলো, শ্রমিকদের ঘরবাড়ি। টাটাদের মালিকানা। তাই চাকচিক্য যথেষ্ট। বেশ ভাল লাগছে। চা বাগানে ঢুকে পড়ি। ছায়াগাছকে জড়িয়ে পেঁচিয়ে গোলমরিচের গাছ। চা পাতা থেকে যেমন রোজগার, তেমনি গোলমরিচ থেকেও ভালো আয়।
নাগরাকাটা থেকে চালসাগামী পানঝোড়া এবং চাপড়ামারি জঙ্গল লাগোয়া ৩১ সি জাতীয় সড়কে দেখলাম ভিড়। শুনলাম একটু আগেই ওই রাস্তার একপাশে জঙ্গল থেকে আরেক পাশের জঙ্গলে একটি বাইসন ছুটে গিয়েছিল। ভিড় দেখে নামলাম। শুনলাম গাড়ি থামিয়ে বুনোদের দেখার চেষ্টা করছিলেন ডুয়ার্সে বেড়াতে আসা একদল পর্যটক। সেই রাস্তা দিয়ে সেই সময় গাড়ি করে আসছিলেন বনদপ্তরের অনারারি ওয়াইল্ড লাইফ ওয়ার্ডেন সীমা চৌধুরী। ওই দৃশ্য দেখে তিনি গাড়ি থামিয়ে পর্যটকদের সঙ্গে কথা বলে তাদের কাছে এটা যে কতটা ঝুঁকির তা বোঝাচ্ছিলেন। ভীষণ ভালো লাগল। জঙ্গলের রাস্তায় অকারণে গাড়ি থামানো আইনবিরুদ্ধ তো বটেই, এর সঙ্গে সবচেয়ে বড় যে বিষয়টি জড়িয়ে রয়েছে তা হলো জীবনের ঝুঁকি। অকারণে গাড়ি থামিয়ে বন্যপ্রাণীদের উত্ত্যক্ত করার বিষয়টি মেনে নেওয়ার প্রশ্নই নেই বলে বনদপ্তর মনে করে।
বিভিন্ন জঙ্গলপথে সবকিছু লিখে সাইনবোর্ড টানানো হয়েছে বহু আগেই। তবুও আইন ভঙ্গের কাজ চলছে। ময়নাগুড়িতে বাইসনের ছবি তুলতে গিয়ে মৃত্যু হয় এক ব্যক্তির। ২০১৭ সালের নভেম্বর মাসে লাটাগুড়িতে পাকা রাস্তার ওপর হাতির আক্রমণে কর্তব্যপরায়ণ এক নিরাপত্তাকর্মীর মৃত্যু হয়। নাগরাকাটা থেকে মুর্তি যাবার পথে হাতির ছবি তুলতে গিয়ে মারা যায় একজন যুবক। মৃত্যু এবং আহত হওয়ার সংখ্যা বাড়লেও ঝুঁকি নিয়ে বন্য প্রাণীর ছবি তোলা বন্ধ হয়নি। বনদপ্তরের নিষেধাজ্ঞা উড়িয়ে ডুয়ার্সের বিভিন্ন এলাকায় প্রায়ই বন্যপ্রাণীর সঙ্গে সেলফি তোলার খবর পাওয়া যায়। মাত্রাতিরিক্ত উৎসাহ মাঝেমধ্যে বিপদ ডেকে আনছে। বন্যপ্রাণীদের উত্ত্যক্ত করায় তারা খেপে যাচ্ছে। একাধিকবার বোঝানোর শর্তেও মানুষ সচেতন হচ্ছে না। আইন ভঙ্গের কাজ চলছে বলে বনদপ্তরের কর্মীদের নজরদারি আরও জোরদার করতে হবে। আইন আইনের পথেই চলুক। যাতে জঙ্গলের রাস্তায় সেলফি এবং ছবি তোলা বন্ধ হয় সেই জন্য কঠোরভাবে নজরদারি শুরু করুক বনদপ্তর। পাশাপাশি গরুমারা এবং লাটাগুড়ি জঙ্গলের বুক চিড়ে চলে যাওয়া লাটাগুড়ি চালসা ৩১ নম্বর জাতীয় সড়কে বাইক চালিয়ে যাওয়া চালকদের থামিয়ে তাদের সাবধানে বাইক চালাবার জন্য সচেতনতামূলক কর্মসূচি নেওয়া প্রয়োজন বনদপ্তরের।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴