সহজ উঠোন

রেজিস্টার / লগইন করুন।

সব কিছু পড়তে, দেখতে অথবা শুনতে লগইন করুন।

Sahaj Uthon
11-December,2022 - Sunday ✍️ By- দেবপ্রিয়া সরকার 558

আশালতা সিংহ : এক বিস্মৃত কলম/দেবপ্রিয়া সরকার

আশালতা সিংহ : এক বিস্মৃত কলম
দেবপ্রিয়া সরকার
===============================

ছোটবেলায় মামাবাড়ি বেড়াতে গেলেই অবধারিতভাবে আমাদের গন্তব্য হত গোটা গ্রাম জুড়ে ছড়িয়ে থাকা বিভিন্ন মন্দির। বীরভূমের বাতিকার গ্রাম আমার মাতুলের দেশ। রাঢ়বাংলার গ্রাম বলতে সাধারণত যে ছবি আমাদের চোখের সম্মুখে ভেসে ওঠে, এ’গ্রাম তার থেকে খানিক আলাদা। মাটির দেওয়াল, খড়-টালির ছাউনি দেওয়া বাড়ি থাকলেও বাতিকার গ্রামের ইতিউতি ছড়িয়ে আছে বেশ কিছু পুরোনো দিনের বড় বড় অট্টালিকা। যেগুলি কোনও না কোনও জমিদার পরিবারের বসতভিটে। প্রত্যেক পরিবারের আরাধ্য দেবতার আলাদা আলাদা মন্দির। যেমন আমার মাতৃকুল আরাধনা করেন শ্রী শ্রী লক্ষ্মী- জনার্দনের। আবার মজুমদারেরা বংশ পরম্পরায় পুজো করেন দেবী দুর্গার। তেমনি সিংহ পরিবারের কুলদেবতা রাধাগোবিন্দ জিউ। আবার গ্রামের প্রাণকেন্দ্রে রয়েছে বাতিকার শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ আশ্রম। 
মামাবাড়ি গেলে আমরা ভাইবোনেরা মিলে কোনও না কোনও সময় ঢুঁ মারতাম এইসব মন্দিরে। লক্ষ্মী-জনার্দনের সন্ধ্যা  আরতী দর্শন, আশ্রমের নামগান শোনা বা রাধাগোবিন্দ মন্দিরের ভোগ খাওয়ায় কখনও আমাদের আপত্তি ছিল না। রাধাগোবিন্দ মন্দিরে গেলেই বারবার একটা ভগ্নপ্রায় দালান বাড়ির দিকে আমার নজর চলে যেত। বাড়িটার দিকে তাকালেই মনে হতো নাজানি কতশত গল্প লুকিয়ে আছে এই খন্ডহরের আনাচকানাচে। আর মনে হবে নাই বা কেন? মা-মাসিদের মুখে শুনেছি ওই বাড়িটা নাকি ছিল দাদুর মামাবাড়ি এবং সেই বাড়িতেই বাস করতেন এককালের বিশিষ্ট সাহিত্যসেবী আশালতা সিংহ। 
আশালতা সিংহের জন্ম হয়েছিল ১৯১১ সালের ১৫ জুলাই বিহারের ভাগলপুর শহরে। তাঁর বাবা যতীন্দ্রমোহন সরকার, মা যোগমায়া দেবী। যতীন্দ্রমোহন অত্যন্ত স্নেহপ্রবণ এবং সহনশীল প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। সেতার বাজাতে এবং ছবি আঁকতে ভালবাসতেন। যতীন্দ্রমোহনের প্রশ্রয়েই সেকালের রক্ষনশীল সমাজব্যবস্থার ভ্রুকুটিকে উপেক্ষা করে আশালতার সৃজনশীল সত্তা এবং শিল্পী মন বিনা বাধায় পল্লবিত হতে পেরেছিল। ভাগলপুরের মোক্ষদা গার্লস স্কুলে পড়াশোনা করতেন আশালতা। স্কুলে পড়াকালীন সেখানকার সেক্রেটারি সুরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় (শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মামা) এর কাছে আরও কয়েকজন ছাত্রীর সঙ্গে বাংলা ও ইংরেজি সাহিত্যের পাঠ নিতেন। শেলী, কিটস্, বায়রন, রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিমচন্দ্রের লেখনীর সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘটেছিল সেই কাঁচা বয়সেই। ন'দশ বছর বয়সে একবার কলকাতা ভ্রমণ কালে বেলতলা রোডে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের বাড়িতে তাঁর দেখা হয় গান্ধীজীর সঙ্গে। তখন ১৯২০-২১ সাল, অসহযোগ আন্দোলন চলছে। আশালতা একটি দামী বেনারসি শাড়ি এবং গা ভর্তি গয়না পরে এসেছিলেন গান্ধীজীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে। কিন্তু দেশের এই দুর্দিনে তাঁর সালঙ্কারা সাজ দেখে ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন মহাত্মা। আশালতা গান্ধীজীর ক্ষোভের কারণ অনুভব করে নিজের সমস্ত গয়না খুলে সঁপে দিয়েছিলেন তাঁর হাতে। এরপর থেকে কখনওই তিনি অতিরিক্ত অলংকারে নিজেকে সাজাননি।
১৯২৪ সালে মাত্র তেরো বছর বয়সে আশালতার রক্ষণশীল জমিদার বংশে বিয়ে হয়। তাঁর শ্বশুরের নাম অবিনাশ চন্দ্র সিংহ। বীরভূমের বাতিকার গ্রামে ছিল তাঁর জমিদারি। আশালতার স্বামী দ্বিজেন্দ্রনাথ সিংহ ছিলেন পেশায় চিকিৎসক। প্রথম জীবনে সিউরিতে প্র্যাকটিস করলেও পরবর্তীকালে পেশার খাতিরে চলে যান ভাগলপুর। 
আশালতা সিংহের প্রথম মুদ্রিত প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল ‘ভারতবর্ষ’ পত্রিকায় ১৩৩৫ সনের বৈশাখে। দ্বিতীয় এবং তৃতীয় প্রবন্ধ ছাপা হয়েছিল সেই বছরই যথাক্রমে আষাঢ় ও কার্তিক মাসে ‘বিচিত্রা’ পত্রিকায়। তিনটি প্রবন্ধেরই শিরোনাম ছিল ‘নারী’। ‘ভারতবর্ষ’ পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর আরও একটি উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধ হল ‘শরৎচন্দ্র ও গ্যালসওয়ার্দি'। প্রথম প্রবন্ধটি পড়ে রবীন্দ্রনাথ একটি দীর্ঘ চিঠি লিখেছিলেন আশালতাকে, যা পরে ছাপা হয়েছিল ‘বিচিত্রা’ পত্রিকায়। আশালতা সিংহের প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস ‘অমিতার প্রেম'। পরবর্তীকালে ‘একাকী’, ‘বিয়ের পরে', ‘কলেজের মেয়ে’, ‘ক্রন্দসী’ ইত্যাদি উপন্যাসে তৎকালীন নারী সমাজকে উপস্থাপিত করেছেন সুনিপুণভাবে।
আশালতা দেবীর রচিত প্রথম গল্প ‘সমর্পণ’। তাঁর মোট চারটি গল্পের বইতে প্রকাশিত গল্পের সংখ্যা একান্ন। এছাড়া আরও কিছু অগ্রন্থিত মিলিয়ে তাঁর এখনো পর্যন্ত প্রাপ্ত গল্প রয়েছে একশো পাঁচটি। আশালতা সিংহের দুটি অপ্রকাশিত ডায়েরি উদ্ধার করেছিলেন বাতিকার গ্রামের অধিবাসী অর্ণব মজুমদার। লেখিকার একমাত্র পুত্র নীরেন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর তাঁর যাবতীয় বই এবং কাগজপত্র কেউ মুদিখানার দোকানে ওজনদরে বিক্রি করে দেয়। অর্ণব মজুমদার সেগুলি উদ্ধার করে আনেন। তার মধ্যে ডায়েরি ছাড়াও ছিল বেশকিছু মূল্যবান চিঠিপত্র এবং তাঁর লেখা প্রবন্ধ ও গল্পের কপি। 
জীবনের শেষ পর্বে এসে আশালতা সিংহ শরণাপন্ন হন আধ্যাত্মিক মার্গের। শ্রী শ্রী বালানন্দ মহারাজ এবং তাঁর মানসপুত্র শ্রী শ্রী মোহনানন্দ মহারাজের সান্নিধ্যে সন্ন্যাস গ্রহণ করে পরিচিত হন আশাপুরী নামে। মৃত্যুর দু'বছর আগে ১৯৮১ সালে প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর একটি আত্মকথা। সেখানে আশাপুরী লেখেন, “সাহিত্যের মধ্যে আমার হৃদয় কখনও পূর্ণ পরিতৃপ্তি পায়নি, তাই যখন আমি আধ্যাত্মপথের সন্ধান পেলাম-তখন তাতেই ডুবে গেলাম,সাহিত্যচর্চা ছেড়ে দিলাম'। ( সন্ন্যাসিনী আশাপুরী [আশালতা সিংহ] – ‘পর্দার আড়াল থেকে' / কল্লোল যুগ, শারদীয় কথাসাহিত্য, কার্তিক ১৩৮৮) 
আশাপুরী দেহ রেখেছিলেন ১৯৮৩ সালে। অবগুণ্ঠনের আড়ালে চলে যাওয়া গত শতাব্দীর এই বলিষ্ঠ কলমকে আজ হয়তো আর কেউ সেভাবে মনে রাখেননি। তাঁর পরিবারের লোকেদের স্মৃতিতে তিনি রয়ে গিয়েছেন জেঠিমা, মামিমা অথবা দিদিমা হয়ে। মায়ের মুখে তাঁর ‘ভাগলপুরের দিদিমা’ র কাহিনি শুনে সেই প্রতিবাদী নারী চরিত্র, যিনি সেসময়কার চরম রক্ষণশীল সমাজব্যবস্থার মধ্যে থেকেও নিজেকে আধুনিকমনস্কা হিসেবে গড়ে তুলতে পেরেছিলেন, তাঁকে জানার আগ্রহ লালন করতাম মনে মনে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত অনেক চেষ্টা করেও তাঁর কোনও সৃষ্টির হদিস আমি পাইনি। হঠাৎই কয়েকবছর আগে ডুয়ার্স বইমেলায় দে'জ পাবলিশিং এর স্টলে হাতে চাঁদ পাওয়ার মতো  আমি খুঁজে পাই আাশালতা সিংহের দু’খানা গল্প-সংকলন। 
বই দুটির দীর্ঘ ভূমিকায় তপোব্রত ঘোষ আশালতা সিংহের জীবন এবং তাঁর সাহিত্য নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। সেগুলি পড়েই কিছুটা হলেও এই বিস্মৃতপ্রায় সাহিত্যসেবী সম্পর্কে আমার কৌতুহল নিষ্পত্তি হয়েছে বলতে পারি। আশা করি আগামীদিনের  সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক এবং গবেষকরা আশালতা সিংহের লেখা নিয়ে আরও কাজ করবেন ও খুঁজে বের করবেন তাঁর হারিয়ে যাওয়া সৃষ্টির সম্ভারকে। হাজার হোক পূর্বজদের ফেলে যাওয়া সম্পদকে আগলে রাখা তো উত্তরপ্রজন্মেরই দায়িত্ব।  
তথ্যসূত্রঃ আশালতা সিংহের গল্প-সংকলন ১ ও ২, দে'জ পাবলিশিং।। কলকাতা এবং স্কুল অব উইমেনস্ স্টাডিজ।। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় 
ছবি : আশালতা সিংহ এবং তাঁর ভগ্নপ্রায় শ্বশুরালয়

আপনাদের মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴
software development company in siliguri,best
                          software development company in siliguri,no 1 software
                          development company in siliguri,website designing company
                          in Siliguri, website designing in Siliguri, website design
                          in Siliguri website design company in Siliguri, web
                          development company in Siliguri