সহজ উঠোন

রেজিস্টার / লগইন করুন।

সব কিছু পড়তে, দেখতে অথবা শুনতে লগইন করুন।

Sahaj Uthon

আলোর পথ/অলকপর্ণা সেনগুপ্ত ব্যানার্জী

আলোর পথ
অলকপর্ণা সেনগুপ্ত ব্যানার্জী

গ্ৰামের চার্চ টার কাছে আসতেই সাইকেলের গতি কমে আসে রেখার, একটা হাসিমাখা মুখের ছবি উঁকি দিয়ে যায় মনে,তবে তা কয়েক সেকেন্ড মাত্র, আজ দেরি হয়ে গেছে অনেকটাই, নভেম্বরের শেষ, মাঠের ফসল ঘরের পথে, এ সময় রোজ রাতেই হাতির হামলা চলে। গতকাল রাতে ওদের গ্ৰামের অনেক গুলো বাড়ি ভেঙেছে হাতিতে, হৈ হল্লা আতঙ্কে জেগে কাটাতে হয়েছে। ভোরের দিকে চোখ লেগে এসেছিল তাই ঘুম থেকে সময়মতো উঠতে পারেনি। ছেলে দুটো তো এখনও ঘুমিয়ে কাদা। আজকে আর স্কুলে যেতে পারবে না। ওদের গ্ৰাম থেকে দুই কিলোমিটার দূরে বড় রাস্তার ধারে দুটো বাড়িতে কাজ করে রেখা। আর সন্ধ্যেয় চার্চের বারান্দায় ছোট্ট ছোট্ট বাচ্চাদের অক্ষর পরিচয় করায়, বড় আনন্দের কাজ এটা ওর। বর লেবারের কাজ করতে দিল্লি চলে গেছে বছর কয়েক আগেই। কখনো সখনো টাকাপয়সা পাঠায় কিন্তু আসেনি অনেক দিন। ওর মুখটাও কেমন যেন ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে রেখার কাছে। প্রথম প্রথম খুব মনখারাপ লাগত। এখন ওসব আর ভাবে না। দুই ছেলেকে নিয়ে রোজকার জীবনযুদ্ধ ওসব ভাবার সময় দেয় না। বড় ছেলেটা গীটার বাজিয়ে সুন্দর ক্যারল গায়, বড়দিনেরআগে ওকে একটা গীটার কিনে দিতে পারলে খুব ভাল হতো, মুখ ফুটে কিছু চায় না ওরা দুভাই, কিন্তু রেখা বোঝে সব। রেখাই একমাত্র অবলম্বন ওদের। আরে রেখা সানডে কো চার্চ নেহি আই কিউ?আয়ি থি ফাদার, জলদি চলি গয়ি, ফরেস্ট যানা থা, লাকড়ি লানে কে লিয়ে। অনেক দিন বাদে দেখা হল রেখার ফাদারের সাথে, সেই ঘটনার পরে সঙ্কোচে ফাদারকে এড়িয়ে থাকে ও। বাড়িতে ফিরে সাইকেল রেখে নদীর দিকে যায় গরু নিয়ে আসার জন্য। রোজ ই এ সময় কিছুক্ষণ একা একা নদীর পাড়ে বসে থাকে, কত কথার ভীড় জমে মনে, ক্লাস এইট অবধি পড়ার পর বাগানে বিঘা কাজে যেত, বাবা চা বাগানের লেবার, হাড়িয়া খেয়েই টাকা শেষ করে দিত, মা কোন ছোটতেই মরে গেছে, একটা আধাপাগল দিদি, ভাই আর ও। দমনপুর হাটে একদিন আলাপ হয়েছিল সুজনের সাথে তারপর প্রেম, একদিন ঘর বাঁধার স্বপ্ন আর পনের দিনের হাজিরা ব্যাগে ভরে চলে এল ওর সাথে কিন্তু রেখা জানত না বাড়িতে সুজনের মা ছাড়াও ছয় আর আট বছরের দুটো ছেলেও আছে!! তোর ছেলেও আছে? বৌ ও?? বিস্মিত ও আহত দৃষ্টিতে প্রশ্ন করে রেখা সুজনের নিকোনো উঠোনে দাঁড়িয়ে। বৌ ভেগে গেছে ছয় সাত মাস আগে তাই.. ও তাই আমাকে নিয়ে এসেছিস, তোর ঘর দেখভাল করার জন্য?? রাগে দুঃখে চিৎকার করে ওঠে রেখা, বাচ্চা দুটো অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে ওদের দিকে, সুজনের মা গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত করে ওকে। বাচ্চা দুটোকে দেখে কিন্তু রেখার মনটা নরম হয়ে আসে আস্তে আস্তে স্বেচ্ছায় ওদের সব দায়িত্ব তুলে নেয় নিজের কাঁধে, সাথে ছন্নছাড়া সুজনের সংসারেরও, শত অভাব অনটনেও ওদের আগলে রাখে, মনে চার্চে দেখা বিরাট কাঠের ক্রুশ বয়ে চলা এক ঈশ্বর পুত্রের ছবি ভাসে ওর। কিন্তু সুজনের মিথ্যে কথাকে ক্ষমা করতে পারেনি।ওর কাছ থেকে গুটিয়ে নিয়েছে নিজেকে। কিন্তু জড়িয়ে গেছে বাচ্চা দুটোর সাথে।বাচ্চা দুটোও রেখাকে মা ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারেনা, নিজের গর্ভের সন্তানের যে স্বপ্ন দেখত, তা আর আসত না ওর রোজকার যুদ্ধ ক্লান্ত ঘুমে। এই পাঁচ ছয় বছরে আর সবার মতো ও নিজেও ভুলে গিয়েছে যে আলোক আর আকাশ ওর পেটের ছেলে নয়। যেমন বোঝেনি শেখরন। ওদের এই গ্ৰামে প্রায় সবাই খ্রীষ্টান। চার্চের ফাদার ওদের জীবনের সুখ দুঃখের অংশ। ফাদারের বাড়ি নাকি কেরলে, সেখান থেকেই বছর খানেক আগে এসেছিল শেখরন, এসেই সবার মন জয় করে নিয়েছিল, সানডে স্কুলে বাচ্চাদের গান শেখানো, বাইবেলের গল্প বলা, রাতে সবার সাথে ক্ষেত পাহারা, রোগী নিয়ে হাসপাতালে ছোটা সব করত হাসিমুখে। আদিবাসী প্রধান এই গ্ৰামের অনেক পুরুষ মহিলাই কাজের জন্য ভিনরাজ্যে কেউ বা আশেপাশের চা বাগানের শ্রমিক আর অল্পস্বল্প চাষবাস, ফাদার খোঁজ খবর নেন সকলেরই তেমনি একদিন রেখার কাছ থেকে সুজনের খবর নিচ্ছিলেন তখনই শেখরন জানল আলোক, যে ছেলেটা বেশ ভালো গীটার বাজায় রেখার নিজের ছেলে নয়! এক এক দিন নদীর ধারে দেখা হয়ে যায় রেখার সাথে একটা দুটো কথা হতে হতে গভীর গিরিখাত দিয়ে সম্পর্ক বেগবতী নদীর মতোই বইতে থাকে। সুজন চলে যাওয়ার পরে মনের শূন্যতা বাইরের কঠিন আবরনে ঢেকে রাখত রেখা শেখরন সেই আবরনে ভেঙে দেয়, নিজের সর্বস্ব দিয়ে শেখরন কে গ্ৰহন করে রেখা। কিন্তু ফাদারের চোখকে ফাঁকি দিতে পারেনা ওরা। তীব্র ভর্ৎসনার মুখোমুখি হয় শেখরন, তবে ও নিজের দায়িত্ব পালন করতেই চেয়েছিল, বিয়ে করে নিয়ে যেতে চেয়েছিল রেখাকে, কিন্তু আলোক আর আকাশ? সুজনের মা? তার ও বা কী হবে? শেখরন চার্চের অনুমতি ছাড়া এখানে থাকতে পারবে না ওখানে যে ওর অনেক কাজ পড়ে আছে, আছে বৃদ্ধ বাবা মা!! শেখরন চলে যাওয়ার আগে বলে গিয়েছিল ও রেখার জন্য অপেক্ষা করবে, সেও আজ প্রায় মাস দুয়েক। এক রবিবার প্রার্থনার পরে ফাদার রেখাকে বলেছিল "সুজনের পরিবারের জন্য তোমার ত্যাগ তোমাকে ঈশ্বরের প্রিয় করবে রেখা" রেখা তাকিয়েছিল কাঁটার মুকুট পরা ঈশার বিরাট ছবিটার দিকে চোখের জলে যা ঝাপসা হয়ে উঠছিল ক্রমশঃ, ও তো ঈশ্বরের প্রিয় হতে চায়নি, ও তো মা ওর দুই ছেলের!! কিন্তু শেখরনকেও ভুলতে পারে না যে…কি রে রেখা তোর চোখমুখে এত কালি পড়েছে কেন? ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া করছিস না নাকি? না ভাবি খাই তো, আসলে জঙ্গলে লাকড়ি আনতে যাই তো, খুব খাটনি হয়।কদিন থেকে সত্যিই শরীর টা খারাপ রেখার, সামনে বড়দিন কত কাজ, ভাবিকে বলে ছুটি নিতে হবে তার জন্য, কিন্তু একটা অজানা আশঙ্কায় ওর বুক দুরুদুরু করছে কদিন থেকে। খাওয়া দাওয়া ও সত্যিই করতে পারছে না, গা গুলিয়ে উঠছে বার বার, গত মাসে মাসিক হয়নি। টি ভি তে দেখেছিল প্রেগন্যান্সি কিট, অনেকদিন আগে ভাবির কাছে শুনেছিল ব্যাপারটা কী। আজকে বাড়ি ফেরার আগে ওষুধের দোকান থেকে লুকিয়ে কিনবে একটা। ডিসেম্বরের রোদ লুটোপুটি খাচ্ছে ঝকঝকে উঠোনটায় আলোক, আকাশ আর ওর বন্ধুরা গীটার বাজিয়ে ক্রিসমাস ক্যারল প্র্যাকটিস করছে মহা উৎসাহে, যীশু আসছে যে!! দুটো লাল দাগ হওয়া প্রেগন্যান্সি কিট জানান দিচ্ছে আসছে সেও, রেখার না আসা স্বপ্নকে সত্যি করে সে আসছে! স্তব্ধ হয়ে রেখা ভাবে, তার গর্ভে বাড়ছে একটা প্রাণ!! একে এই পৃথিবীর আলো দেখাতে পারবে কি ও? মেনে নেবে কি ওর ছেলেরা?হয়ত পারবে না, গর্ভের অন্ধকারেই শেষ হবে ওর সন্তান!! পায়ে পায়ে এসে দাঁড়ায় চার্চের সামনে, ফুল বাগানে ছোট্ট যীশু কোলে মা মেরীর মূর্তির দিকে তাকিয়ে সাহস পেতে চায় মনে। কেটে গেছে আরও কিছুদিন, শত পরামর্শেও বাচ্চা নষ্ট করেনি রেখা, বরং সব সত্যি জানিয়েছে সুজনকে, জবাব পায়নি কোনও। সব জেনেছে শেখরনও, ফেরার আশ্বাস দিলেও রেখা জানেনা তা সত্যি কিনা, আশ্বাস দিয়েছেন ফাদারও রেখার একটা কাজের, তবে ওর প্রত্যাশা নেই কিছু,এ সন্তানের সম্পূর্ণ দায়িত্ব ও মনে মনে স্বীকার করে নিয়েছে। সামনের পথ ভীষণ কঠিন! এখন রেখা তিন সন্তানের জননী। ওর দুই কিশোর সন্তান, ওর বৃদ্ধা শাশুড়ি যত্নে ঘিরে রাখে রেখাকে, তাই সমস্ত ভার নিয়ে এই নতুন যাত্রা বধ্যভূমির দিকে না হয়ে স্বর্গীয় উপত্যকার দিকেই হবে এটুকু আশা আলোকিত করে রাখে ওর মনকে।

আপনাদের মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴
software development company in siliguri,best
                          software development company in siliguri,no 1 software
                          development company in siliguri,website designing company
                          in Siliguri, website designing in Siliguri, website design
                          in Siliguri website design company in Siliguri, web
                          development company in Siliguri