আরশি-নগর পড়শি বাস করে/প্রশান্ত নাথ চৌধুরী
প্রশান্ত নাথ চৌধুরী
বাংলাদেশের কুষ্টিয়াতে গতবছর একটা বহুতল হোটেলে ছিলাম। ওখানে সে সময় 'পিঠে' উৎসব চলছিল। সকালেই আমাদের লালন সাঁইয়ের মাজার ঘুরে শিলাইদহ কুঠি বাড়ি যাওয়ার কথা। সবাই সকালেই স্নান ব্রেকফাস্ট সেরে নিচে নামলাম, কাজেই পিঠে আমাদের কপালে জোটেনি। বাগানে অনেক মরশুমি ফুল ফুটে আছে। ফেব্রুয়ারি শেষের হালকা শীত ভালই লাগছিল। নজর রাখতে হয় লাগেজ ঠিক ঠাক গাড়িতে উঠেছে কিনা!
বাস ছেড়ে দিল নানা অকেজো কথাবার্তার মধ্যে। খুব তাড়াতাড়ি পৌছে গেলাম লালন ফকিরের মাজার। যেন একটা তীর্থক্ষেত্র। প্রবেশ পথের ধারে নানা রকম পশরা সাজিয় বসেছে দোকানিরা।
দূর থেকে সুর ভেসে আসছিল সেই চেনা সুরে গান 'সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে'। বড় গেটটির সামনে জোতিরিন্দ্র নাথের চিত্র অবলম্বনে বেশ বড় একটা লালন সাঁইয়ের ম্যুরাল। চারিদিকে সবুজ গাছপালার মাঝ ফুলের বাগান। ম্যুরাল অতিক্রম করে সামনে এগোতেই ধূপের গন্ধে বিহ্বল চারপাশ। পাশেই কবরে শায়িত আছেন অবিভক্ত বাংলার অন্যতম সুরকার কবি, গায়ক, দার্শনিক লালন ফকির। কিছুটা সমুখে এগোলেই একটা চাতালে নরনারী একসঙ্গে বসে গাইছে লালনের অমর সব গান। আমাদের অনুরোধে গাইছিলেন একের পর এক গান, যার প্রতিটি লাইন হৃদয়ে ধারন করতে হয়, লালন করতে হয়।
আসলে লালনের জন্ম বৃত্তান্ত, তার পরিবার ও শৈশবকাল নিয়ে প্রামানিক কোন তথ্য পাওয়া যায় না। এমনকি তিনি হিন্দু না মুসলমান তাও অস্পষ্ট। তিনি অধুনা বাংলাদেশের ঝিনাইদহ জেলার হরিশপুর গ্রামে ১৭৭৪ সনের ১৭ ই অক্টোবর জন্ম গ্রহন করেন। লালন নিজের আত্ম পরিচিতির ব্যাপারে একান্তই উদাসিন ছিলেন।
কোন রকম প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা তিনি লাভ করেন নাই। লোকমুখে শোনা যায় একবার গ্রামের কিছু পূণ্যার্থী জগন্নাথ মন্দিরে তীর্থ যাত্রা করেছিলেন। সেই দলে কিশোর লালনও ছিলেন। যাত্রা চলাকালীন তিনি গুটি বসন্ত রোগে আক্রান্ত হন। রোগের প্রকোপে তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়লে সহযাত্রীরা তাঁকে কালিগঙ্গা নদীর পাড়ে ফেলে রেখে চলে যান।
সন্নিকটস্থ এক মুসলিম গ্রামের মানুষ মলম শাহ ও তাঁর পত্নী মতিজান বিবি অক্লান্ত সেবা করে লালনকে সুস্থ করে তোলেন। সারাজীবন লালন ওই দুই জনকে পিতা মাতার আসনে বসিয়ে শ্রদ্ধা ও সেবা করেছেন। বসন্ত রোগের প্রকোপে তাঁর একটা চোখ চিরদিনের জন্য অন্ধ হয়ে যায়।
সমাজ সংস্কারক কাঙ্গাল হরিনাথ ছিলেন লালনের প্রাণের বান্ধব। গান বাজনায় ছিল হরিনাথ ও লালনের আজন্ম ভালবাসা। সিরাজ সাঁই-এর ভাবধারায় অনুপ্রাণিত হয়ে লালন গান রচনা, সুর দেওয়া ও পরিবেশন শুরু করেন।
লালন তার জীবনের অনেকটা সময় কুষ্টিয়ায় ঠাকুর পরিবারের জমিদারিতে বসবাস করেছেন। জানা যায় জ্যোতিরিন্দ্রনাথ পদ্মা নদীর বুকে বজরায় লালনকে বসিয়ে তার একটা স্কেচ অঙ্কন করেছিলেন। তা ব্যতীত লালনের আর কোন ছবির খোঁজ পাওয়া যায় না।
"খ্যাঁচার ভিতর অচিন পাখি
ক্যামনে আসে যায়,
ধরতে পারলে মন-বেড়ি
দিতাম পাখির পায়। "
১৮৯০ সনের ১৭ই অক্টোবর লালন ১১৬ বছর বয়সে ওই কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী উপজেলার ছেউড়িয়াতে তিনি দেহ রক্ষা করেছিলেন।
বাল্যকালে মাতৃ বিয়োগের পর ১৮৭৫ সনে পিতা দেবেন্দ্রনাথের সঙ্গে প্রথম রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহ আসেন। তখন তিনি অনুসন্ধিৎসু কৈশরে পা রেখেছেন। দু চোখ ভরে তিনি পদ্মাকে অনুভব করেছেন স্পর্শ করেছেন। গ্রাম বাংলার বন্ধনহীন জীবন তাকে প্রাণিত করেছে আলোড়িত করেছে। তখন তো লালন নিকটে ছেউড়িয়াতেই থাকেন কিন্তু সে সময় তার সঙ্গে লালনের সাক্ষাৎ হয়নি।
ঠিক পরের বছর রবীন্দ্রনাথ জ্যোতিরিন্দ্রনাথ অর্থাৎ তাঁর নতুনদাদার সঙ্গে আবার এলেন শিলাইদহ। সেবার তো সাক্ষাৎ হওয়ার অবকাশ ছিল। সে সময় রবীন্দ্রনাথ অনেকটাই বন্ধনহীন, উন্মুক্ত। সে সময়ের মধ্যে কবিগুরু অনেক কবিতা, গান ইত্যাদি রচনা করেছেন; আশ্চর্য তখনও রবীন্দ্রনাথ ও লালন ফকিরের সাক্ষাতের কোন সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায় না। এমনকি জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সঙ্গে লালনের দুটি সাক্ষাতের তথ্য পাওয়া যায়। প্রথম সাক্ষাতের একটা ঘটনার কথা বলি। সেদিন কাঙ্গাল হরিনাথ বাড়ি ছিলেন না। খাজনা আদায়ে ঠাকুর (জমিদার) বাড়ির এক আমলা কাঙ্গালের বাড়ি এসে জাঁকিয়ে বসেছেন। খবর গেল গড়াই নদীর ওপারে লালন সাঁই-এর কাছে। লালন এলেন। জমিদারদের লেঠেল বাহিনীকে মেরে তাড়ালেন। পরে জমিদারদের কুঠিবাড়ি থেকে তার ডাক এলো। বড়সর একদল মানুষ সঙ্গে নিয়ে লালন এলেন জমিদারের সাক্ষাতে।
তখন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর জমিদারির দায়িত্বে। তিনি বললেন এই জমিদারি চালনা করেন আমলারা। জমিদার কলকাতায় থাকেন। তাদের টাকা পেলেই হলো। তিনি লালনের পরিচয় পেলেন। শোনা যায় জ্যোতিরিন্দ্রনাথ লালনের জমি জায়গার সব রকমের খাজনা মকুব করে দিয়েছিলেন। কাঙ্গাল হরিনাথের বাড়িতে আর লেঠেল বাহিনী যায় নাই। হয়ত কিশোর রবীন্দ্রনাথ সেদিন শিলাইদহ কুঠিবাড়িতে ছিলেন এবং তিনি নবতিপর লালন সাঁইকে দেখেওছিলেন কিন্তু তার প্রামাণ্যতথ্য পাওয়া যায় না। সমসাময়িক কালেই জ্যোতিরিন্দ্রনাথ পদ্মা বোটে বসিয়ে লালনের একটা স্কেচ এঁকেছিলেন। সেই স্কেচ ছাড়া লালনের আর কোন ছবি দেখা যায় না।
কাঙ্গাল হরিনাথ ওরফে হরিনাথ মজুমদার সেসময় বেশ কিছু বইও লিখেছেন। রবীন্দ্রনাথ কিশোর বয়সে দ্বিতীয়বার যখন তার নতুন দাদার সঙ্গে শিলাইদহ এসেছিলেন তখন কাঙাল হরিনাথের 'বিজয় বসন্ত' পড়েছিলেন। সেসময় ছাপার যন্ত্র তিনি বিদেশ থেকে আনিয়েছিলেন। সে যন্ত্র দেখতে মাঝে মাঝেই ভিড় লেগে যেত। লালন একদিন হরিনাথের বাড়িতে এসে গেয়েছিলেন:
'আমি একদিনও না দেখিলাম তারে;
আমার ঘরের কাছে আরশি-নগর,
তাতে এক পড়শী বাস করে। '
লালন ৮৫১ টি গান রচনা করেন ও তাতে সুর দেন। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, এমনকি অ্যালেন গিন্সবার্গ পর্যন্ত লালনের গানের দর্শন ও সুরে প্রাণিত হয়েছিলেন। হরিনাথও লালনের প্ররণায় বেশ কিছু গান রচনা করেছিলেন। তার একটি গান সত্যজিৎ রায় 'পথের পাঁচালী' ছায়াছবিতে ব্যবহার করেছিলেন। সেটি হলো:
'ওহে দিন তো গেল সন্ধ্যা হল, পার কর আমারে।
তুমি পারের কর্তা, শুনে বার্তা, ডাকছি হে তোমারে।।
(ওহে দীন দয়াময়)
আমি আগে এসে ঘাটে এসে রইলাম বসে,
(ওহে আমায় কি পার করবে নাহে অধম বলে)
যারা পাছে এলো, আগে গেল, আমি রইলাম পড়ে। '
গীতিকার হিসেবে হরিনাথের নাম সত্যজিৎ রায় ব্যবহার করেননি। হরিনাথ তার শিষ্যদের নিয়ে ফিকির চাঁদ নামে গানের দল গঠন করেন, তাদের গান রবীন্দ্রনাথ শুনেছেন বোটে বসে। তাঁর ভাইপো এমন তেরটি গান লিপিবদ্ধ করেন। কিন্তু না কাঙাল হরিনাথের সাথেও রবি ঠাকুরের দেখা হয়নি। এটা কি অদৃষ্ট নির্ধারিত কুমারখালি উপজেলার যে দুটি মানুষ রবীন্দ্রনাথকে প্রভাবিত করেছেন একটা সময় একসঙ্গেই তারা সেই এলাকায় বাস করলেন অথচ তাদের সাক্ষাৎ হল না?
কবিগুরু লিখেছিলেন:-
একদিন এই দেখা হয়ে যাবে শেষ,
পড়িবে নয়ন 'পরে অন্তিম নিমেষ।
পরদিনে এইমত পোহাইবে রাত,
জাগ্রত জগৎ 'পরে জাগিবে প্রভাত।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴