সহজ উঠোন

রেজিস্টার / লগইন করুন।

সব কিছু পড়তে, দেখতে অথবা শুনতে লগইন করুন।

Sahaj Uthon
26-May,2024 - Sunday ✍️ By- কাঞ্চন রায় 368

আমার বন্ধু রবীন্দ্রনাথ/কাঞ্চন রায় বণিক

আমার বন্ধু রবীন্দ্রনাথ
কাঞ্চন রায় বণিক 

আমাদের R.R প্রাইমারি স্কুলে রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন খুব ঘটা করে পালন করা হত। আমি তখন ওয়ানে পড়ি। সেদিন থ্রি ফোরের ছেলে মেয়েরা সকাল থেকে খুব ব্যস্ত। গোটা স্কুলের দরজা জানালায় ঝুলিয়ে দেওয়া হত কৃষ্ণচূড়া আর রাধাচূড়ার ডালসমেত ফুল। আর থাকত হরেক কিসিমের পাতাবাহার। সেসব অতি উৎসাহে স্কুলের আশেপাশের গাছ থেকে সংগ্রহ করে আনা। আমিও এনেছি কিছু ডালপালা বয়ে। একটা ক্লাসরুমের বেঞ্চ সরিয়ে একদিকে চেয়ারে পাতা সাদা কাপড়ের ওপর একটা লম্বা দাড়িওলা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাঁধানো ছবি। কপাল ছাড়িয়ে গাল অব্দি চন্দনের ফোঁটা। ফ্রেমে একটা সাদা ফুলের মালা। ফুলের মালাটি বুড়ি দিদিমণি নিজে হাতে গেঁথে পরিয়েছেন। চেয়ারের এককোণে হেডস্যারের বাড়ি থেকে আনা চিনেমাটির ফুলদানিতে একটা কলাবতী সহ কিছু পাতাবাহার। ধূপদানিতে কয়েকটা ধূপকাঠি। গন্ধে ক্লাসরুম ম ম করছে। আর চারদেয়ালে পাতাবাহার, রাধাচূড়া আর কৃষ্ণচূড়ার ফুল দিয়ে সাজানো। সামনে আমরা সবাই শান বাঁধানো মেঝেতে বসে। হেড মাস্টার গিরিজাকান্ত সেন ও অন্যান্য মাস্টার দিদিমণিরা ওই সাজানো চেয়ারের আশেপাশে বসে। একসময় গিরিজাকান্ত সেন মানে আমাদের সবার গির্জা মাস্টার উঠে বলা শুরু করতেন, 
আজ পঁচিশে বৈশাখ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিন। আরও অনেক কিছু বলতেন, আমি সবটা  বুঝতাম না। তারপর একে একে সুধীর মাস্টার, চারু দিদিমণি, কল্পনা দিদিমণিরা রবীন্দ্রনাথের কথা বলতেন। কল্পনা দিদিমণি সুন্দর সুর করে একটা কবিতা বললেন। এরপর ছাত্র ছাত্রীদের পালা।
আমি বসে আছি দুটো কারণে। আমাদের ক্লাসের লক্ষী আজ শাড়ি পড়ে এসেছে। ওর হাতে আর গলায় সাদা মালা, পায়ে আলতা ও নূপুর। ও আজ নাচ করবে। কেমন অদ্ভুত লাগছিল ওকে। বড়দের শাড়ি পরে ও একেবারে গোল। তারপর ওর নাচের দৃশ্য কল্পনা করে আমার খুব হাসি পাচ্ছিল । অনেক কষ্টে হাসি চেপে রাখছিলাম। দ্বিতীয়ত, আমাকে একটা ছড়া বলতে হবে। সাধনকাকু কদিন ধরে পুরো মুখস্ত করিয়েছে আমাকে। আর এমনিতে এমন পরিবেশে আমার ভালোই লাগছিল। আমি মাঝে মাঝে, "আমাদের ছোট নদী" আউড়ে নিচ্ছিলাম মনে মনে।
এই কবিতা থেকেই আমার রবীন্দ্রনাথের সাথে ভাব ভালোবাসা অভিমান জন্মে যায়। আমাদের স্কুলের পেছনের নদীর কথা আর কী। ওই নদীর কাছে রোজ যাই আমি। সে নদীতে আমারও হাঁটু জল। গরু রোজ পার হয়। ঘোড়া পার হতে একদিন দেখেছি। তবে গাড়ি পার হতে দেখিনি। বাগানের ওদিকের বউদের থালা বাসন মাজতে দেখেছি। আঁচলে করে না হলেও ছোট মাছ ধরতে দেখেছি। ছোট মাছ আমিও ধরেছি। গামছায় করে। কিন্তু "দুইধারে কাশবন ফুলে ফুলে সাদা" এটা উনি কীভাবে লিখলেন! একধারে তো আমাদের স্কুল, তারপর হাইস্কুল আর অন্য ধারে চা বাগান। সাদা কাশফুলের লেশমাত্র নেই! তবে কচুরিপানা ফুল আছে অনেক।
আমার প্রিয় একটা নদীকে নিয়ে এমন একটা মিথ্যা কথা রবি ঠাকুর লিখে দিলেন! তবে ওই আমাদের ছোট নদী দিয়ে আমি ঢুকে পড়লাম রবীন্দ্রনাথে। 
তারপর টু তে উঠে, "ভক্তরামের নৌকা শক্ত কাঠে তৈরী", আমাদের বাড়ির চারপাশে করাতকলের সৌজন্যে এন্তার কাঠের গুড়িতে ভর্তি। আমি মাঝে ওই কাঠের গুড়িগুলো পরীক্ষা করে দেখতাম। ভাবতাম, ভক্তরামের এ রকম শক্ত কাঠের নৌকাই হবে। আর মঙ্গলবার এলেই "আজ মঙ্গলবার, পাড়ার জঙ্গল সাফ করবার দিন" স্কুল থেকে ফিরে খোঁজ নিতাম, জঙ্গল সাফ করেছে কি না। কিন্তু জঙ্গল পরিষ্কারের কোনো লক্ষণ না দেখে মনে মনে হতাশ হতাম।
ক্লাস ফাইভে উঠে স্থানীয় পাঠাগারে ভর্তি হয়ে গেলাম। জাগৃতি পাঠাগার। সেখান থেকে একদিন নিয়ে এলাম রবীন্দ্রনাথের "জীবনস্মৃতি"। সেটা পড়ে, বিশেষ করে ওই বইতে রবীন্দ্রনাথের আম খেয়ে আমের আঁটি কামড়ে সাদা করে ফেলা। রাস্তায় হাঁটার সময় পায়ের আগে আগে চপ্পলের চলা। শীতকালে একটা হাফ প্যান্ট ও জামার ওপর আরেকটা জামা পরা। হ্যারিকেনের আলোয় পড়তে বসে ঘুমে ঢুলে পরা। এসব আমার সাথে অক্ষরে অক্ষরে মিলে যাবার পর একরকম নিশ্চিন্ত হলাম, রবীন্দ্রনাথ আমার মতোই একজন রক্ত মাংসের মানুষ। কোনো ঠাকুর নন। কোনো ভিনগ্রহের জীবও নন। তবুও ওনাকে ঠাকুর বলে সবাই ! অনেকের বাড়িতেই দেখেছি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাঁধানো ছবি টানানো। 
ওয়ান টুর সহজপাঠে সব লেখার সাথে  ক্লাস ফোর পর্যন্ত যা যা পড়েছি, সব যেন আমার কথা। আমার ভাবনা, আমার কল্পনা, আমার ইচ্ছে, আমার বাস্তবের প্রতিফলন। আমি যেন দেখতে পাই, পদ্মাপাড়ের বক্সীগঞ্জ যেন আমার পাশের গ্রাম। শুক্রবারে ভাগ্নে মদনকে নিয়ে হাটে চলেছে। গরুর গাড়ি বোঝাই মাটির হাঁড়ি কলসি। আরেকটু দূরে অঞ্জনা নদী তীরে চন্দনী গাঁ। গঞ্জের জমিদার সঞ্জয় সেন। পোড়ো মন্দিরের সামনে কুঞ্জবিহারী ভিক্ষে করছে। সাথে লেজকাটা ভক্ত কুকুর। ছোট্ট মেয়ে বেগুনি রঙের শাড়ি রোদ্দুরে দিচ্ছে। রান্নাঘরের চালে দুটি শালিকের ঝগড়া। মধু বিধু দুই ভাই ছুটোছুটি করছে। বাজারের তালগাছটি এক পায়েই দাঁড়িয়ে। আমাদের বাড়ি থেকে দেখা যায় যে পাহাড়, ওটাই বুঝি পাঁচমুড়া পাহাড়ের গাঁ। যে পাহাড়ি গাঁ থেকে দইওয়ালা দই বিক্রি করতে আসে। তার আগে খুঁটিমারী বন। ওই বনেই বাঘ থাকে। গায়ে চাকা চাকা দাগ। এসব যেন আমার চারপাশে আবর্তিত হয়ে চলে। 
বড়বেলায় বুঝে ভালোবাসা আর ছোটবেলার না বুঝে ভালোবাসার মধ্যে পার্থক্য এই যে ছোটবেলার ভালোবাসা খাদহীন। তাতে পাটোয়ারী বুদ্ধি থাকে না। তাতে চাওয়া পাওয়া থাকে না। মায়ের বুক আঁকড়ে থাকার মতো আমি ও রবীন্দ্রনাথ যেন পরস্পর আঁকড়ে ধরে আছি। যেন আমার পরম বন্ধু রবীন্দ্রনাথ। 
তারপর, আমাদের ছোট নদী দিয়ে অনেক জল বয়ে গেছে। জীবনও বয়ে চলেছে তার নিজস্ব ছন্দে। রবিন্দ্রনাথকে নিয়ে প্রাইমারীর গন্ডি পেরিয়ে,ছোটদের ভালোবাসা পেরিয়ে যখন বড়োদের ভালোবাসায় পৌঁছালাম, জীবনের প্রতিটি পদে পদে অনুভব করলাম, দুঃখে, কষ্টে, উৎসবে,আনন্দে, ভালোবাসায়, বিরহে হে ঠাকুর, তুমি ছাড়া জীবন অচল। আমার আমার হিসেব নিকেশের গোলকধাঁধার দুঃখকষ্টগুলো উনি যেন আড়াল থেকে মুছিয়ে দিয়ে আলোকের ঝর্নাধারায় স্নাত করে চলেছেন। আগুনের পরশমণি ছুঁইয়ে চলেছেন প্রাণে।
আজ পৌঢ়ত্বের দোরগোড়ায় এসে দিনের শেষে ঘুমের দেশে যাবার সোনার তরী ঘাটে ভেড়ার অপেক্ষায়। আয়, ওরে আয়, আমায় নিয়ে যাবি কে রে দিন শেষের শেষ খেয়ায়।
এখন উপলব্ধি করি, জীবনের পরতে পরতে জড়িয়ে থাকা রবীন্দ্রনাথ রক্তমাংসের মানুষ নন। উনি সত্যিই ঠাকুর। আমাদের প্রাণের ঠাকুর।

আপনাদের মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴
software development company in siliguri,best
                          software development company in siliguri,no 1 software
                          development company in siliguri,website designing company
                          in Siliguri, website designing in Siliguri, website design
                          in Siliguri website design company in Siliguri, web
                          development company in Siliguri