আমার দুঃখিনী বর্ণমালার স্মরণে/অমিতাভ গোস্বামী
আমার দুঃখিনী বর্ণমালার স্মরণে
অমিতাভ গোস্বামী
কল্যাণীয়েষু সুমিত,
দীর্ঘদিন তোমাকে চিঠি লিখতে পারিনি। সময়ের হাত ধরে আর পাঁচটা বিষয়ের মত চিঠি লেখাও আজ বিলুপ্তির পথে। ব্যস্ত পৃথিবীতে মানুষ আজ হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে অতি সংক্ষিপ্ত বার্তা আদান প্রদানে অভ্যস্ত। তবু চিঠি লিখতে আমার ভালো লাগে।মনের ভেতরে বহু কথা, উদ্বেগ ও আশঙ্কার কালো মেঘ জমে আছে। আজ তোমার সঙ্গে সেসব ভাগ করে নিতে চাই। তুমি বহুদিন বিদেশে আছো যেখানে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির চরম উন্নতি ঘটেছে এবং যারা বিশ্ব অর্থনীতির নিয়ন্ত্রক। আমাদের মত তৃতীয় বিশ্বের দক্ষ , মেধাবী এবং ইংরেজি শিক্ষিত ছাত্ররা উন্নত জীবন যাপনের উদ্দেশ্যে অর্থ উপার্জনের লক্ষ্যে সেখানে পাড়ি দিয়ে চলেছে। কিন্তু সে তো মুষ্টিমেয় কয়েকজন। আমার মত অগণিত সাধারন মানুষ রয়েছে এই পোড়া বাংলায় যেখানে ভাষা, সংস্কৃতি ও অর্থনীতি ক্ষয়িষ্ণু। বাংলা নববর্ষ আগত প্রায়। চারিদিকে উৎসবের আবহ। মানুষ উন্মত্তের মত বাজার অভিমুখে ছুটে চলেছে। আমি হলপ করে বলতে পারি এদের মধ্যে হাতে গোনা কয়েকজন বাদ দিলে অধিকাংশই বাংলায় এখন কত সাল আসতে চলেছে সেটা বলতে পারবে না। শুদ্ধভাবে একটি বাক্য বাংলায় বলতে বা লিখতেও পারবে না। ইংরেজি বাংলা হিন্দি মিশ্রিত এক অদ্ভুত খিচুড়ি ভাষায় কথা বলে এরা শ্লাঘা বোধ করে। ভাষার দৈন্যতাই যেন এদের কাছে আভিজাত্যের নিদর্শন হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যালয়ে সন্তানকে ভর্তি করে এরা গর্বের সঙ্গেই বলে, 'জানেন দাদা আমার ছেলের বাংলাটা ঠিক আসে না।'
আ মরি বাংলা ভাষা নিয়ে অধিকাংশ বাঙালি আজ আর গর্ব ও করে না বা বিশেষ কিছু আশা ও করে না। অথচ আমাদের রয়েছে রবীন্দ্রনাথ নামক এক মহামানব যার বাংলা ভাষা , সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে বহুমুখী অবদানের সমতুল্য উদাহরণ বিশ্বের অপর কোন দেশে বা ভাষায় নেই। বাংলা ভাষা চর্চা এবং প্রসারের জন্য যিনি সারা জীবন ব্যয় করে গেছেন। এমনকি মৃত্যুর মাত্র চার বছর আগে ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে প্রথা ভেঙে তিনি বাংলায় বক্তৃতা করেন। তার নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির মধ্য দিয়ে সারা বিশ্বে বাংলা ভাষা সম্পর্কে যে আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছিল নিজেদের উদ্যোগের অভাবে আমরা সেটা ধরে রাখতে পারিনি। বাংলা সাহিত্য কে ভালো করে ইংরেজিতে অনুবাদের মধ্য দিয়ে সারা বিশ্বে আমরা ছড়িয়ে দিতে পারিনি। আবার অন্যদিকে বিজ্ঞান ও উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় পুস্তকাদি আমরা বাংলায় অনুবাদ করতে পারিনি। অথচ বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের চরম উন্নতি ঘটেছিল যখন অপরাপর ভারতীয় ভাষাগুলি ছিল বাংলার তুলনায় অনেকটাই পিছিয়ে। কিন্তু দেশ স্বাধীন হওয়ার পর রাষ্ট্রভাষা হিসেবে হিন্দির উত্থানের পরে বাংলা রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতা থেকে অনেকটাই বঞ্চিত হয়। এমনকি ধ্রুপদী ভাষা হিসেবে তেলেগু মালায়ালাম এবং উড়িয়া ভাষা রাষ্ট্রের স্বীকৃতি পেলেও বাংলার ভাগ্যে সেই স্বীকৃতি জোটেনি।
গত শতাব্দীর নব্বই এর দশকের প্রথম থেকেই বিশ্বায়ন নামক এক সর্বগ্রাসী দানবের আবির্ভাব ঘটেছে যার প্রভাবে পৃথিবী আজ এমন একটি গ্রামে পরিণত হয়েছে যেখানে প্রবেশদ্বারের চাবি রয়েছে ইংরেজি ভাষায় শিক্ষিতদের হাতে। বাংলা সেখানে অপাংক্তেয়। প্রযুক্তির উন্নতির হাত ধরে এসেছে অডিও ভিস্যুয়াল মাধ্যম যার ফলে বিশেষভাবে বাংলা সাহিত্য পাঠকের সংখ্যা ক্রমশ কমছে।
দুর্ভাগ্যের বিষয় যে বাংলা ভাষার অধিকারের প্রশ্নে ওপার বাংলা এবং এপার বাংলার মানুষ একসময় আত্ম বলিদান করেছিল তারাই এখন সেসব ভুলে বাংলা ভাষার গরিমা রক্ষার প্রয়াসে অগ্রসর হওয়ার পরিবর্তে অর্থহীন কার্যকলাপে লিপ্ত। এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে মাইকেল মধুসূদন দত্তের কথা। যিনি ইংরেজি সাহিত্য চর্চার মধ্য দিয়ে বায়রন, শেলি প্রভৃতির সমকক্ষ হওয়ার ইচ্ছা ত্যাগ করে একদা বাংলা ভাষায় সাহিত্য রচনায় উদ্যোগী হয়েছিলেন। তিনি বাংলায় লেখা তাঁর প্রথম নাটক 'শর্মিষ্ঠা'র মুখবন্ধে লিখেছিলেন-"অলীক কুনাট্য রঙ্গে,/মজে লোক রাঢ়ে বঙ্গে,/নিরখিয়া প্রাণে নাহি সয়'। মনে হয় তিনি যেন আজকের বঙ্গভাষীদের কার্যকলাপ অনুমান করেই এ কথা লিখেছিলেন।
যে ভাষার চর্চার ইতিহাস চর্যাপদের সময়কাল থেকে ধরলে বারোশো বছরের বেশি সেই সমৃদ্ধ ও ঐতিহ্যময় ভাষা কি তবে কালের গর্ভে হারিয়ে যাবে? আমরা কি উদ্যোগী হয়ে প্রশাসনিক স্তরে বাংলাকে অফিস আদালতে বাধ্যতামূলক করতে পারি না? আমরা কি বাংলার প্রতিটি বিদ্যালয় মহাবিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষায় পঠন পাঠন আবশ্যিক করতে পারি না ? আমরা কি পারিনা এই নিশ্চয়তা প্রদান করতে যে আমাদের ছেলেমেয়েরা বাংলা শিখে এই রাজ্যে ন্যূনতম কর্মসংস্থানের সুযোগ পাবে? উচ্চশিক্ষার প্রয়োজনীয় পুস্তকাদি জার্মান বা ফরাসি ভাষায় অনূদিত হতে পারলে বাংলা ভাষায় কেন তা করা যাবে না সে বিষয়ে কি আমরা ভাববো না? অনুবাদের ক্ষেত্রে বাংলা পরিভাষাকে আমরা কি আরো সরল নমনীয় এবং গ্রহণযোগ্য করতে পারি না? আমরা যদি অবিলম্বে এসব বিষয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে উদ্যোগী না হই তবে সেই দিন আর বেশি দূরে নেই যেদিন বাংলার ঘরে ঘরে যেসব সন্তানেরা থাকবে তাদের বাংলা অক্ষর জ্ঞান থাকবে না।
তবুও আমি আশাবাদী। অন্ধকারের উৎস থেকে একদিন আলো উৎসারিত হবেই। স্মরণ করি গুরুদেব রবীন্দ্রনাথের সেই মর্মস্পর্শী আবেদন-"বাংলা যার ভাষা সেই আমার তৃষিত মাতৃভূমির হয়ে বাংলার বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে চাতকের মত উৎকণ্ঠিত বেদনায় আবেদন জানাচ্ছি : তোমার অভ্রভেদী শিখর চূড়া বেষ্টন করে পুঞ্জ পুঞ্জ শ্যামল মেঘের প্রসাদ আজ বর্ষিত হোক ফলে-শস্যে ,সুন্দর হোক পুষ্পে-পল্লবে ,মাতৃভাষার অপমান দূর হোক, যুগশিক্ষার উদ্বেল ধারা বাঙালি চিত্তের শুষ্ক নদীর রিক্ত পথে বান ডাকিয়ে বয়ে যাক, দুই কুল জাগুক পূর্ণ চেতনায় , ঘাটে ঘাটে উঠুক আনন্দধ্বনি।"
আমার এই দীর্ঘ আত্মবিলাপ ধৈর্য ধরে পড়বে কিনা জানি না তবু না লিখে পারলাম না। ভালো থেকো। ভালোবাসা নিও।
ইতি তোমার
৩০শে চৈত্র,১৪৩০ অমিতাভদা
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴