আমার আলো/অলকপর্ণা সেনগুপ্ত ব্যানার্জী
আমার আলো
অলকপর্ণা সেনগুপ্ত ব্যানার্জী
এ জীবনের শ্রেষ্ঠতম ভালোবাসা যদি কারো থেকে পাওয়া যায়, সে একমাত্র মা। আমার জীবনও তার ব্যতিক্রম নয়, কিন্তু আমার মা ব্যতিক্রম... তার সাহসে, সব কষ্টের মধ্যেও তার অমলিন হাসিতে, সর্বোপরি তার অগাধ ঈশ্বর বিশ্বাসে। আমার মা আমার জীবনের আলো।
কত প্রতিকূল অবস্থায়ও মা নিজের মতো করে জীবন কে ছন্দে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে! সদা কর্ম ব্যস্ত, সবসময় পজিটিভ এনার্জি তে ভরপুর। আসে পাশে ও সেই এনার্জি ছড়িয়ে দিত সবসময়। জীবনের কঠিন সময়ে হতাশায় তলিয়ে যেতে গিয়েও একটা হাত সাহস দিত,পথ দেখাত । অথচ আমি দেখেছি কত অবহেলা, কত রকমের কষ্ট ছিল মায়ের কিন্তু সেসবকে হেলায় সরিয়ে নিজে দৃঢ় হয়েছে আরও।
মানুষটিকে একবার যে দেখেছে, কথা বলেছে, হলফ করে বলতে পারি সারাজীবন তার স্মৃতি অম্লান হয়ে থাকবে। অম্লান হয়ে থাকবে তার হাতের অনবদ্য কেকের স্বাদ, অসাধারণ সব রান্না, সযত্নে তৈরি সোয়েটারের উজ্জ্বলতা। যখন যেটাই করত মনপ্রাণ ঢেলে দিত, সে স্কুলের বাচ্চাদের পড়ানোই হোক বা অন্য কাজ। চিরদিন সাদাকে সাদা কালো কে কালো বলতে পারার সাহসী মানুষ টাকে নিয়ে কখনো কখনো যে বিব্রত হইনি তাও নয় কিন্তু মা নিজের মতামতে অটুট থাকত। মাকে দেখে শেখার বৃথা চেষ্টা করতাম হয়ত বা সাহস নিয়ে সঠিক চেষ্টা করতামও না। ভাবতাম এই বটবৃক্ষের ছায়াতেই কাটাব আমৃত্যু।
কিন্তু হঠাৎ এক অদ্ভুত দিকে বাঁক নিল জীবন, আবার আমি শিক্ষার্থী মা শিক্ষক।
কিভাবে বলব মাকে!! এক বিকেলে তোলপাড় মন নিয়ে যথাসম্ভব স্বাভাবিক স্বরে যখন মাকে বললাম মায়ের বায়োপসি রিপোর্ট ভাল নয়, বলতে পারলাম না বিষাক্ত কর্কট তার বিষ ঢেলেছে মায়ের শরীর জুড়ে, মা বুঝে নিল সবটাই, আর কি আশ্চর্য্য!! শান্ত মনে হালকা হেসে স্বাভাবিকভাবেই নিল সবটুকু। আমি অবাক হয়ে ভাবলাম কতটা মনের জোর থাকলে এমন হওয়া যায়!! কোথা থেকে পায় মানুষটা এত শক্তি?? আমি ঈশ্বরের কাছে অনুযোগ করেছি কেন এমন হল? আর মা বলেছে, "এ আমার জন্যে আমার ইষ্টের(শ্রীরামকৃষ্ণ) গলরোগের প্রসাদ।"
আবার আমি ভেঙে গুঁড়িয়ে যাচ্ছি আবার মা তার শীর্ণ হাত দিয়ে আমাকে সাহস জুগিয়েছে, "তুই একদম ভাবিস না, আমি ঠিক ভাল হয়ে যাব দেখিস"।
মায়ের চোখ দিয়ে আমি জীবনকে চিনেছি,
সংসারের প্রাত্যহিক জটিলতা,অভাব, হাজার অপ্রাপ্তির মধ্যেও সন্ধ্যার স্বল্প অবসরে ছোট্ট কোয়ার্টারের সিঁড়িতে বসে মায়ের খোলা গলায় "আজ জোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে…"গাওয়া, মায়ের হাতে লাগানো ম্যাগনেলিয়ার সুগন্ধের মতো আজও আমাকে ভরিয়ে রেখেছে। মা আমাকে ভালোবাসতে শিখিয়েছে,জীবনকে, প্রকৃতিকে, মানুষকে।
যদিও যে মাপকাঠিতে জীবনের সাফল্য মাপা হয় তাতে আমার স্কোর শূণ্য কিন্তু তবুও ওই যে... জীবনে সন্তুষ্টির সমান ধন হয়না, বুদ্ধদেবের এই আপ্তবাক্যটি হৃদয়াঙ্গম করা আমার মা, আমাকে নিয়ে ও আমি আমার অতি সাধারণ জীবন নিয়ে ভালো থাকা শিখেছি। ছোট্ট ছোট্ট আনন্দে জীবন সাজিয়ে নেওয়া শিখেছি মায়ের কাছ থেকে।
আমাদের পুরান, ইতিহাসে বা বর্তমানে কত মহিয়সী নারী সমাজ, সংস্কৃতি কে ঋদ্ধ করেছেন বা এখনও করে চলেছেন যাঁরা সবসময়ই আমার প্রণম্য কিন্তু যে মানুষটিকে দেখে আমি জীবনের সব লড়াই লড়ার শক্তি পেয়েছি, আমার অনুপ্রেরণা, তিনি এক অত্যন্ত সাধারণ নারী, যে ভুল করেছে, কিন্তু ভুল শুধরেছে, আঘাত পেয়ে কুঁকড়ে গিয়েছে আবার দৃঢ় পদক্ষেপে সামনে এগিয়েছে, লড়াই করতে গিয়ে হেরে গিয়েও ভয়ে পিছিয়ে যায়নি...কালের অমোঘ নিয়মে জীর্ণ শরীরটা ত্যাগ করলেও কিন্তু আমি বুঝতে পারি তার ভালোবাসা আজও আমাকে ঘিরে রেখেছে... আমার মা।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴