আমার আমি/কবিতা বণিক
আমার আমি
কবিতা বণিক
মেয়েবেলায় আমি তখন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের প্রতিবিম্ব দেখে অবাক হয়ে ভাবতাম এটাই কি আমি? আয়নার সামনে হাসিমুখ, গোমড়া মুখ ,রক্ত চক্ষু ইত্যাদি নানান ধরণের অঙ্গভঙ্গি করে দেখতাম সত্যিকারের আমি কোনটা।
অন্য নামে কেউ ডাকলে আমি সাড়া দিতাম। তখন তাদের আপত্তি থাকত আমার সাড়া দেওয়ায়। আমার এইসব ভাবকে বাড়ির লোকেরা উদ্ভট ভাবনা বলত।এই যে নিজেকে নিয়ে আমার এত আকুলিবিকুলি তাই আমি মাঝে মাঝে চলে যেতাম সেই যেখানে আছে আমার সই, সে এক ছোট্ট শান্ত নদী ,নাম পঞ্চানই। আমার মনের কথা মাঝে মাঝে চিঠিতে লিখে দিতাম ওর জলে। কুলুকুলু শব্দে কত কথাই সে বলে! আমায় সে বলতো থেমে যেও না। অথচ আমি পড়তাম লজ্জায়। সই বলতো, আমার বুকে কত প্রাণী, মাছ খেলা করে শান্তি পায়। তেমনি সবাইকে নিয়ে আনন্দে কাটাও না। সই এর ইশারায় আমি লজ্জা কাটিয়ে এগিয়ে যাবার চেষ্টা করেছি, পারিনি বরং সই এর কাছে তার মাছ ধরতে আসার ছল ছিল বলেই হয়তো আমার আর যাওয়াই হয়ে ওঠেনি। পড়ন্ত বেলায় সূর্যাস্তের সময় মনে হতো তার মা যেন রাঙা শাড়ির ঘোমটা মাথায় কপালে সোনার টিপ পড়ে দেখতাম দিগন্ত জুড়ে দুহাত বিস্তৃত করে সইকে টেনে নিত কোলে। আবার আলো হয়ে ফুটে উঠত সকাল হলে। আমিও আমার মায়ের কোলে শুতাম এমনি করে দু হাত দিয়ে জড়িয়ে। মা বলত "কি হয়েছে ?" আমি মাথা ঝাঁকিয়ে আরো একটু চেপে শুতাম মায়ের কোলে। চোখ বন্ধ করে কোলে শুয়েও সেই অন্ধকার উপভোগ করার চেষ্টা করতাম। আলো আর অন্ধকারের দুটো অবস্থাই যেন সে বয়সে আমার হাসিমুখ আর গোমড়া মুখ মনে হত। ফলে আমার আয়নাই হয়ে উঠলো মালিনী নদী। সইয়ের জল এত চঞ্চল যে মালিনীর মত মুখ দেখার উপায় নেই। মন খারাপ হয় সই ! সই এর সাথে আমার কথা শুধু তীরে বসেই আলাপ , তা নয়। সই এর ঢেউ এর সাথে তীর ধরে হাঁটতাম কত সময় ! মনে হতো আমিও নদী হয়ে চলেছি দূর থেকে দূরে! থামতে আমি চাই না যে! কিন্তু সেই বড়শির টোপ বড় লজ্জায় ব্যবধান তৈরি করেছিল আমাদের। কিছুদিন পর আমার আঁচলে চাবি ঝুলিয়ে বাসা বদল হয়েছিল। আজ সাঁঝবেলায় মনে হয় আমি সইয়ের পাশে পাশে নদী হয়ে এখনো হাঁটছি। কিন্তু সইএর চেহারা আজ যেন রুগ্ন ভিখিরির মতো হয়েছে দেখছি। হয়তো সে অপেক্ষায় আছে আবর্জনার স্তূপে লুপ্ত হবার। আমি অপেক্ষায় থাকব শেষ গতিতে সইএর সাথে মন্দাকিনী হয়ে বয়ে চলার।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴