আবার হয়তো দেখা/মণিদীপা নন্দী বিশ্বাস
আবার হয়তো দেখা...
মণিদীপা নন্দী বিশ্বাস
হায় হায় হায়! নাটকটা মাঠে মারা গেল। এত কষ্টের, এতদিন রিহার্সাল,ক্লাস বাঙ্ক করে নাটকের কপি করা সবার হাতে হাতে ধরানো, শেষমেশ বিখ্যাত একাঙ্কটার ভিতরের নির্যাসটুকু বুঝে ওঠার আগেই এখনি দর্শক হাসতে শুরু করবে! ছানা, হাবুল,মুকুল ওরা আর তাকাতে পারছে না। মুক্ত মঞ্চ উঁচুতে বাঁধা।নাটক গান বাজনা হয়ে যাওয়ার পর কি সব সভা টভা আছে। হোক গে। কোন পলিটিক্যাল পার্টি ডেকেছে জানার দরকার নেই চম্পকের। কল শোটা ঠিক মত করতে পারলে আর ও পাঁচটি জায়গায় ডাক পাবে। তা তো হওয়ার জো নেই এদের জন্য। রাগে ফুঁসছে উঁচু মঞ্চের বাঁশ বাঁধা সিঁড়িটার নীচে। চম্পক।অদৃষ্ট একেই বলে।
ঝাড়ুদারনী সেজেছে ময়ূরী। ঘ্যামা অভিনয় করে।এমনকি মৈথিল মেশানো হিন্দীটাও কি দারুন বলছে। ঝাড়ুদার পবনের সঙ্গে অভিনয়টাও করছে বেশ।চম্পকের নিজেরই হিংসে হচ্ছে। নিজে অফিসের ছোটবাবুর রোল অভিনয় করছে। পবনটা ভাল হিন্দী বলে তাই ঝাড়ুদার 'বিট্টুর' অভিনয়ে বেশ মানায় আর 'রুমনি' সেজে মঞ্চে ময়ূরীকেও লাগছেও চম্পা একেবারে। হাঁটুর একটু নীচ অবধি হলদে শাড়িটাকে গাছকোমর করে পরেছে। সবুজ ব্লাউজের পিছনে বেনীটাতে বেশ যাচ্ছে।... এই তো চলছিল দারুন স্পীডে 'মিছিল'নাটকটা। এর আগে বহু রজনী ওদের সিনিয়ররা এ নাটক অভিনয় করেছে। ভ্রাম্যমান ট্রাকে বিভিন্ন শহরে থেমে থেমে প্রায় তিনশো রজনী এ নাটক ইতিহাস বানিয়েছে। চম্পক নতুন সময়ে এ নাটকের নবীকরণ করতে চায়।ভেতরের নষ্ট সময়ের কষ্ট কথা তুলে ধরতে চায়। স্বপ্ন আছে জড়ানো মনের ভিতর আর চোখেও।...দেখেছ! এরা কি হতে দেবে! স্বর্গ থেকে নাট্যকার দাদুর নির্দেশ কেমন ফালতু ঠেকে চম্পকের। ওদের দলের নাম দিয়েছে 'কালকেতু'। আরে বাবা! সফল হলে তো! ময়ূরীকে হাজারবার বলেছে পার্ট মুখস্থ করবি ভাল মতো। কোন প্রম্পট্ চলবে না দাদুর আমলের মতো। ওদের এক্সট্রা ক্যারিশমায় মুখস্থ না করেও চালিয়ে গেছে বটে, অভিনয়ের জোরে দারুন দাঁড়াত ঠিক, সেটা কোন কাজের কথা না।তৈরি হতেই হবে। প্রম্পটারের উপস্থিতি না থেকেও এদের দেখ অবস্থা!
রুমণির সাজে ময়ূরী ততক্ষণে গো গো স্টাইলের চশমা সেঁটেই দ্বিতীয়বার মঞ্চে ঢুকে গেছে।কি দরকারটা ছিল বাইরে এসে চশমা শাটার!! কপাল চাপড়াচ্ছে পরিচালক।
ও..ব্বাবা! ময়ূরীটা কি সাংঘাতিক মেয়েরে বাবা,বলছে, 'ঠারিয়ে। হাম রোদমে এ্যায়সান পরিসান থি, যো এ চশমা লাগানে পরি...ঠারিয়ে ঠারিয়ে হাম এ চশমা বাহার মে ব্যাগ মে ছোড় আতি হুঁ...' লে বাবা।ম্যানেজ দিচ্ছে ঝাড়ুদারনী রুমণি।
ঝাড়ুদার বিট্টু আর কি বলবে... সংলাপ বানিয়ে বলার ক্ষমতা কি আছে নাকি! মাথা নাড়ছে বোকা বোকা মুখে। হাত নাড়ছে। যাক গে।
চশমাটা কোনমতে বাইরে রাখা টেবিলে খুলেই দাঁত কিড়মিড়ে রাগী মুখের চম্পকের চোখে চোখ না রেখেই দৌড় মঞ্চে। আবার সুন্দর সাবলীল।
চম্পকের মাথা ঠান্ডা হওয়ার আগেই সামনের চেনা দর্শকেরা ব্যাপারটা খানিকটা বুঝে একটু উশখুশ বলাবলি হাসাহাসি শুরু করতে গিয়েও রুমনির'মার ঝাড়ু মার ঝাড়ু মেরে ঝেঁটিয়ে বিদেয় কর...' সুরের চোটে চোখ গোল্লা পাকিয়ে অভিনয় দেখতে শুরু করেছে।
আসলে নাটকটার মূলকথায় ঐ শ্রেণি বিভাজন। অফিসার, ম্যানেজার আর ডিগ্রুপ ক্লার্ক কিংবা ঝাড়ুদার ইত্যাদিদের ফারাক আর সমতা আনার চেষ্টার মুখ্যত বাতাবরণ,সেখানে গরীব দিন আনে দিন খাওয়া ঝাড়ুদারনীর কি শখ একখানা গো গো চশমার! চম্পক যখন এ ম্যাসাকার নিয়ে মাথা নামিয়ে ভেবে যাচ্ছে, ততক্ষণে ওর ছোটবাবু হয়ে ঢোকার কথা। বেমালুম ভুলে বেড়াবাঁধা সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে গেছে।
মঞ্চ থেকে ঝাড়ুর বেজায় শব্দ উঠছে তখন রুমনি বক বক করেই যাচ্ছে জোরে এ্যায়সান যে ছোটবাবুর কানে যাতে যায়।এবার হাবুল চম্পকের পিঠে চাপড় মেরেছে...'আরে ছোটবাবুর প্রবেশ'
হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়ে'ছোটবাবু' চম্পক। আর ঢুকেই দেখে ফোলিও ব্যাগ আনেনি। বিসদৃশ। খালি হাতে আপিস?
অগত্যা ময়ূরী আগ বাড়িয়ে ডায়ালগ বলে সামলে সুমলে নিয়ে উইংসের পাশ থেকে ফোলিও ব্যাগখানা এনে দিয়ে বাঁচিয়ে দেয় চম্পককে।
* * * * *
কলেজ জীবনের এই কথাগুলো এতদিন পর চায়ের টেবিলে ঝড় তুলেছিল। হাসাহাসি দেখে কে বলবে এরা সব ষাট ছুঁই ছুঁই বন্ধুর দল! ময়ূরীর আধ পাকা আধা কাঁচা বয়কাট চুলে সৌন্দর্য এখন অন্যরকম।...' আরে, সেদিন নাটকে চশমা পরে ঢুকে যাওয়াটা যেমন ঝাড়ুদারনীর পক্ষে বেমানান ছিল তেমনি নাচ করতে করতে উচ্চাঙ্গের আসরে ঐ এক ই ভাবে ছশমা পরে ঢুকে আবার ছন্দে ছন্দে উইংসের পাশে দাঁড়ানো মার হাতে চশমা খুলে দিয়েছিলাম একবার।কি করি!মাইনাস পাওয়ার, তখন তো লেন্স বসানোর ব্যাপারটাও জমেনি, একপাশে দাঁড়িয়ে স্ক্রিপ্টের কাগজটা পড়তে গিয়েই ঝামেলা পেকে গিয়েছিল...'
পুরোপুরি ষাটে পৌঁছে যাওয়া চম্পক সাদা চুল নেড়ে ততোধিক চওড়া হাসি তুলে বলে 'ভাগ্যিস রুমনি ছিল সেদিন তানা হলে কি দুর্দশাই না ঘটত...'
কলেজের শতবার্ষিকীর আলো তখন টেবিলের প্রৌঢ় প্রাক্তণদের উজ্জ্বল করেছে।ওদের হাসি কলরবে রাত ঘন হচ্ছে অন্ধকারহীন।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴