আধমরাদের ঘা মেরে তুই বাঁচা
পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়
"নবীন" এবং "কাঁচা"দের গুরুত্ব যতটা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার সাহিত্যে এবং জীবন দর্শনে দিয়ে গিয়েছেন, ঠিক ততটা গুরুত্ব আর কোনো সাহিত্যিক দিয়েছেন কি না আমার জানা নেই। "সন্ধ্যা সংগীত" তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ নয়, তবুও সেই কাব্যগ্রন্থের কিছু কবিতা সম্পর্কেও তার নিজের অকপট স্বীকার সেই কাব্যগ্রন্থের সব কবিতাই নবীন। সন্ধ্যাসংগীতের মধ্যে দিয়েই তাঁর কাব্যস্রোত ক্ষীণধারায় প্রবাহিত হয়েছিল। তাঁর মনে সেই সময় কিছু কবিতা নিয়ে দ্বিধা দ্বন্দের দোলাচল চলতে থাকে। নিজেরই লেখা কিছু কবিতা বার বার সংশোধন এবং পরিমার্জন করতেন। কখনো কখনো ভাবতেন সম্ভব হলে তিনি কিছু কবিতা সন্ধ্যা সংগীত থেকে বাদ দিয়ে দেবেন । প্রকাশিত হওয়ার পর তাঁর মনে হয় "কথাগুলো যখন সদ্য উৎসারিত হচ্ছিল তখন নিশ্চয়ই তার মধ্যে একটা প্রচ্ছন্ন মানের ইংগিত ছিল। সেই অন্তর্যামীর কাজ সারা হতেই সে দৌড় দিয়েছে, এখন বাইরে থেকে ভেবে আমার মান বের করতে হবে।" এই বিষয় নিয়ে কবিগুরুর স্বগতোক্তি এই রকম ছিল। (জীবনস্মৃতি :রচনাবলী ১১, পৃ ৬৭ ৬৮) "কাব্য হিসাবে সন্ধ্যাসংগীতের মূল্য বেশি না হইতে পারে। উহার কবিতাগুলি যথেষ্ঠ কাঁচা। উহার ছন্দ, ভাষা, ভাব, মূর্তি ধরিয়া পরিস্ফুট হইয়া উঠিতে পারে নাই। উহার গুণের মধ্যে এই যে হঠাৎ একদিন আপনার ভরসায় যা খুশি তাই লিখিয়া গিয়াছি।সুতরাং সে লেখার মূল্য না থাকিতে পারে কিন্তু খুশিটার মূল্য আছে।" এই খুশির জন্য লেখা এবং সব লেখাই ভাবনার গভীর থেকে উৎসারিত একথা তিনি সবসময়ই বলে গেছেন।
তাঁর জীবনের দোরগোড়া থেকেই যে কাব্যের পথ তৈরি ছিল একেবারেই তা নয়। জীবনের আপনমনে চলার গতিতে,কখনো গতিবেগে আপনা আপনি সে পথ তৈরি হয়ে উঠেছে।শৈশবে শক্তি থাকে সামান্য, বাঁধা থাকে বিস্তর, তাই কবি সেই সময় তাঁর কাব্যের দুনিয়া দেখা তো দূরে থাক, উপলব্ধি অবধি করে উঠতে পারেন নি।সব কবি মাত্রই লেখা লিখির শুরুতে নিজস্ব ভালো মন্দ বিচার ক্ষমতা থাকে না। প্রথম প্রথম কবিতায় সত্যের ঘাটতি থাকে, থাকে অগাধ সংশয়। সত্য আস্তে আস্তে প্রকাশিত হয়। সত্যকে অনুভব উপলব্ধি করার আগেই কর্ম শুরু হয়ে যায়। কর্মের মধ্যে আবর্জনা থাকবে না তা হতে পারে না। কবিতা জন্ম নেওয়ার পর তার দেহ থেকে ক্লেদ, আবর্জনা মুক্ত করবার কাজটি রবি ঠাকুরের কাছ থেকে সকল কবিদের শিখতে হবে। তার জীবন দর্শনের এক বড়ো দিক আধমরা, দূর্বলদের বাঁচিয়ে তোলা। আবর্জনা মোচনেই পূর্ণতার প্রাপ্তি লাভ হয়ে থাকে। যুবক কখনো তার শৈশবের হামাগুড়িকে জমিয়ে রাখে না। সাহিত্য ভান্ডারের কাঁচা বা আবর্জনা দূরে ঠেলে সরিয়ে দিলে আপন সৃষ্টিরই অপমৃত্যু ঘটবে তাই, যা একবার প্রকাশ পেয়েছে তাকে কখনোই বিদায় দেওয়া উচিৎ নয়। একথা তিনি তাঁর জীবনস্মৃতিতে বলে গিয়েছেন।
সন্ধ্যাসংগীতের প্রকাশকাল ১২৮৮ বঙ্গাব্দ সেখানে তার "আমি হারা" কবিতাটি প্রকাশিত হলেও ১২৮৯ বঙ্গাব্দের বৈশাখ মাসে ভারতী পত্রিকায় "আমি হারা" আবারও ছাপা হয়েছিল। অনুরূপভাবে "বিষ ও সুধা" কবিতাটি ১২৯৯ সালে দ্বিতীয় সংস্করণে বাদ দেওয়া হয়। উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো " বিষ ও সুধা" কবিতাটি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাল্যকালে রচিত দীর্ঘ কবিতা। ১৯১১ সালে কাব্যগ্রন্থের সর্বশেষ "উপহার" কবিতাটি "সমাপন" নামে ১৯১৫ সালে দ্বিতীয় বার ছাপা হয়। পরে অবশ্য "উপহার" নামটা আবারও ফিরে আসে। শোনা যায় বিশ্বভারতীর রচনাবলী সংস্করণে প্রুফ দেখার সময় কবি নিজেই "সন্ধ্যা" কবিতাটি বাদ দেন। মার্জিনে নিজে হাতে লেখেন "এই কবিতাটি সংশোধনের অতীত এবং পরিত্যাজ্য।" আবারও "গান আরম্ভ" কবিতাটি প্রথম সংস্করণে ছিল ১৩৬ লাইনের। "কাব্যগ্রন্থাবলী" সংস্করণে "গান আরম্ভ " কেটেছেটে ৮২ লাইনের এবং সর্বশেষে প্রকাশিত হয় ৬৩ লাইনের কবিতা হিসেবে।
তিনি বলতেন কবিতা লিখছি বলেই তার সব মানে আমাকে জানতে হবে তার কোনো মানে নেই। "তারকার আত্মহত্যা " কবিতা প্রসঙ্গে তিনি এক মৌখিক আলোচনায় বলেছিলেন, "দায়িত্বহীন, কর্মহীন দিনগুলি। তখনও বিবাহ হয় নাই।" অর্থাৎ পরিবেশ পরিস্থিতি এক এক সময়ে এক এক কবিতার জন্ম দেয়। কোনো প্রাণী বা মানুষ দুর্বল বা নড়বড়ে থেকেই বলবান বা শক্তিশালী হবে এটাই প্রকৃতির নিয়ম। দুর্বলতা বাদ দিলে সবলতা অস্তিত্ববিহীন হয়ে পড়বে।
কবির জন্মমাসে তাঁর সম্পর্কে কিছু লিখতে গেলে তাঁর উদ্ধৃতি থাকবে না, অর্থাৎ গঙ্গাজলে গঙ্গাপূজা হবে না, এটা নিতান্তই কষ্টকল্পিত। আজীবন তাঁর পথ চলা মানুষকে নিয়ে। নবীন থেকে প্রবীণ এই দীর্ঘ জীবনে কি কবিতা, কি সমাজ, কি মানুষ বা মানুষের জীবন, তিনি আজীবন আধমরাদের ঘা মেরে বাঁচিয়ে গিয়েছেন, এবং ভাবি প্রজন্মকে শিখিয়ে গিয়েছেন।