আত্মদর্শন ও পরমার্থের পথ/মমতা পাল চন্দ
আত্মদর্শন ও পরমার্থের পথ
মমতা পাল চন্দ
মানব জীবনে ক্ষুদ্রতা কখনো আত্মদর্শন করাতে পারে না। আত্মদর্শন তখনই ঘটে যখন মানুষ নিজেকে বৃহতের মাঝে দাঁড় করায়। একমাত্র তখনই তো মনে জীবনের সবচাইতে বড় জিজ্ঞাসা জন্ম নেয়। "Who I am", আমি আসলে কে ? আর এই প্রশ্ন যার মধ্যে যত তাড়াতাড়ি জন্ম নেয় সে তত তাড়াতাড়ি আত্মদর্শনের পথে অগ্রসর হতে থাকে। আর তার জন্য এক মার্গ বা পথ তৈরি হয়। যাকে আমরা বলতে পারি পরমার্থের পথ। জীবনের এই মোক্ষম সত্যকে আমি বুঝতে পেরেছিলাম অনেক ছোটো বয়স থেকেই যেদিন থেকে আমি পিতৃহারা হই। আমি যখন খুব ছোটছিলাম বাড়িতে অনেক ছবি ছিল তার মধ্যে জহরলাল নেহেরু, মহাত্মা গান্ধীর ছবি আমার কেমন যেন ভালো লাগতো না। আমার খুব ভালো লাগতো স্বামী বিবেকানন্দ আর ঘোড়ায় চড়া নেতাজী সুভাষ বোসের ছবি দেখতে। ওই দুটি ছবিতে আমি সবাইকে লুকিয়ে প্রণাম করতাম খুব ছোট বেলা থেকে। কেন প্রণাম করতাম ওই ছোট বেলায় কিছু না জেনে না বুঝে তা আজও আমার অজানা। হ্যাঁ পরবর্তীকালে আমি খুঁজে খুঁজে স্বামী বিবেকানন্দ আর নেতাজী সম্পর্কিত বই পড়তে শুরু করেছিলাম। এবং বাবার ও দাদার কাছে শুনে এবং নিজে নিজে অনেক কিছু জানতে পারি। নারায়ণ সান্যালের লেখা "নেতাজী রহস্য সন্ধানে", গান্ধীজি ও নেতাজী থেকে শুরু করে প্রায় সব বই পড়েছি নেতাজী সম্পর্কিত। আর শৈলেশ দের "আমি সুভাষ বলছি " এবং "ভারত পথিক " এর মত বই আমি পড়ে শেষ করেছি যখন আমি ক্লাস নাইন এ পড়ি। পড়ার বই ছেড়ে এসব বই পড়ার জন্য কত যে উত্তম মধ্যম জুটেছে আমার কপালে। আমার দাদা লুকিয়ে মাক্সিম গোর্কির "মা" মূলকরাজ আনন্দের "কুলি " পড়তে দিত। আর সেখান থেকেই জীবনে ত্যাগ করা, সব ছেড়ে সন্ন্যাসিনী হবার ভাবনা যেমন জন্মেছিল। তেমনি মনীষীদের জীবনী পড়ে পড়ে স্কুল এ ক্লাসের মধ্যে নেত্রীগিরি, উচিত কথা বলা শিখেছিলাম। তবে স্বাধীনতার ইতিহাস পড়ে মনে হতো ঐরকম কিছু করতে হবে আমায়। আমার মায়ের এক তুতো দাদা স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিল। তার সংসার করা হয়নি। আমার ওই দাদাগিরি ভাবসাব দেখে মা ভয় পেতেন - খুব ধমকাতেন আমায়, বোঝাতেন জেল, কালাপানি, দ্বীপান্তর এইসব। আবার আমার কাজের কেউ প্রশংসা করলে মাতৃদেবীর আবার গর্ববোধ- অহঙ্কারও হতো। রাতের বেলা পাশে শুয়ে ঘুমোলে খুব আদর করতেন। আর বোঝাতেন পড়াশোনা করে দিদিমণি হও - কিন্তু মেয়েদের সংসারটাই বড় কথা। কিন্তু আমি খুব আবেগ প্রবণ আর খাম খেয়ালী ছিলাম। দু দুবার চাকরি ছেড়ে দিলাম। লাস্ট অবধি চললাম শ্বশুরবাড়ি। সেখানে সমর্থন যেমন ছিল লড়াইও ছিল ভীষণ। তবে কথায় বলে না ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে। আসলে ভবী তো ভোলার নয়। সংসার চাকরি সব কিছুর মাঝেই পড়া লেখা যতটা জারি রাখা যায়। কারণ ওপরে লোক দেখানো পরিপাটি সংসার করলেও ভিতরে বাস করতো এক চির তৃষ্ণার্ত বাউন্ডুলে। ঘর সংসারের ভিতরেও সে নীরবে নিশ্চিন্তে কোথায় যেন একা। ভীষণরকম একা, আস্ট্রেপৃষ্টে মায়ার বাঁধনে বাঁধা এক অসহায় পথচারী।
যখনই একটু একা থাকার সুযোগ হয় কিংবা দুঃখ পেলে কিংবা খুশির সময় ফুরসৎ পেলেই "চল মন নিজ নিকেতনে।" চুপি চুপি স্মৃতির খাতা খুলে পাওয়া না পাওয়ার হিসেব। যোগফল কখনো - শূন্য, কখনো জেতার আনন্দ। তখনই কখনো দুচোখ জুড়ে বর্ষা নামে - ভিজে যাওয়া বুকের গভীরে প্রবেশ - ঘটে যায় নিভৃত আত্মদর্শন। আর সেখান থেকেই জন্ম নেয় পরার্থ - পরমার্থ আর মোক্ষ লাভের এর লক্ষ্য।
কথায় বলে একজন মানুষ এক জীবনে তার নিজেকেই ঠিকমত চিনে উঠতে পারে না। সে কখন যে কি করতে পারে সে নিজে বুঝে উঠতে পারে না। এমন বহু সময়ই তো হয় যে একজন ভালো মানুষ এমন খারাপ কাজ করে ফেললো যা শত খারাপ মানুষের দ্বারা সম্ভব না। আবার একজন খারাপ মানুষ এমন ভালো কাজ করে ফেললো যা শত ভালো মানুষের দ্বারা সম্ভব না। তাই প্রতিটি মানুষের জীবনে নানা বাঁক আসে। আসে গলি থেকে রাজপথে ওঠার তাগিদ। এই পথ চলতে গিয়ে আমার নিজের সঙ্গে দেখা হয়েছে বারে বারে। আর এই আত্মদর্শন ঠিক আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখা নয় - দেখা নিজের অন্তর আত্মার সাথে। নিজের বুকের ভিতর যে মন নামক মন্দির রয়েছে সেখানে নিজের অজান্তে নিভৃতে একান্ত যাপন। সেখানে মানুষ তো দিনে যতবার খুশি প্রবেশ করতে পারে - পারে নিজের পূজার অর্ঘ্য সমর্পণ করতে। আসলে মানুষের বুকের ভেতর যে ছোট্ট চিলেকোঠা তাতে যে রক্তক্ষরণ - তাকে রক্তপাতে মুড়িয়ে রাখতে রাখতেই তো মানুষের নিজের সঙ্গে দেখা হয় কতবার। জীবনের নানা মোড়ের বাঁকে বাঁকে দেখা হয়েছে আমার নিজের সঙ্গে। আর সেসময় এক মানুষ হয়ে পরিবেশ পরিস্থিতি, ভবিষ্যত সব কিছু চিন্তা করে নিজেকে মানিয়ে নিয়ে যে ভিন্ন ভিন্ন রোলে প্রয়োজনে অভিনয় করে - কখনও জীবন সংসারকে সামাল দিতে যে বৈঠা হাতে নৌকো বাইতে হয়েছে। কিংবা বটবৃক্ষের ছায়া হয়ে ডালপালা বিস্তার করতে হয়েছে তার নিচেই তো সংসারটার দুঃখ সুখে বেঁচে থাকা। আর সংসার তো শুধু নিজের পরিবারই নয়। অফিস, কাছারী, আত্মীয় স্বজন, পাড়াপ্রতিবেশি সহযাত্রী, বৃহদর্থে সারা দেশবাসী, মাটির গোলার এই পৃথিবীর সবার সাথে মানিয়ে গুছিয়ে চলতে গিয়ে কতবার নিজের সঙ্গে দেখা হয় কত যে কথা হয় - কত যে ভাবনার অতলে ডুবে যেতে যেতে ব্যথায় কুকড়ে যায় এ মনরথ। আবার কে যেন সারথী হয়ে বয়ে নিয়ে যায় - ভাসিয়ে নিয়ে যায় কোন সে অজানা ঠিকানায় নিজেই বা জানলাম কোথায় ? শুধু এই তো জানলাম - এই তো বুঝলাম জীবনের আর এক নাম adjustment - সমঝোতা। তবেই তো জীবন স্রোতস্বিনী হয়। ছোট নদী, খাল বিল সবাইকে যে সাগরের কাছে যেতেই হয় ওই গলি থেকে রাজপথে যাবার মত। তবে সবাই হয়তো সঠিক গন্তব্যে পৌঁছতে পারে না। কারণ পথ যে বড় কাঁকর বিছানো। আর নদীপথ সাবলীল হলেও কত বাঁক কত খাঁড়ি ! তাই তো সবাই পারে না এক মোহনায় মিলিত হতে। তাই তো মানুষের শেষ অপেক্ষা - মৃত্যুর কাছে। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের মত কখনো ভাবতে হয় "মরণ রে তুহু মম শ্যাম সমান।" আবার কখনো মনে হয় "I will stand my pilot face to face. " কখনও মনে হয় I will embrace my death as my best bosom friend or as the best gift of God. মনে হয় "everything will be all right" because God is there. আবার কখনো মনে হয় Nothing could be done for want of actual devotion to God. আর এভাবেই আমার আত্মদর্শন ঘটেছে শোকে দুঃখে ব্যথা বেদনায়। আর অঝোরে নিজের অন্তরাত্মা থেকে উৎসারিত বিগলিত জলধারা অকাল বর্ষণের মত ঝরে পড়েছে। আসলে আমি আমার নিজের সঙ্গে দেখা করি নিয়মিত। কেননা নিজেকে নিজের জিজ্ঞাসার যে শেষ নেই। এই নিভৃত যাপন থেকে কি পেলাম - এ সংসার জীবন আসলেই আমায় কি দিল ? সে খেরোর খাতার হিসেব আমাকে বড্ড বেসামাল করে দেয়। মনে হয় সব কিছু থেকেও অনেক কিছু পেয়েও আসলে আমি বড় একা। প্রত্যেকটি মানুষই হয়তো একসময় বুঝতে পারে সে বড় একা। এ পৃথিবীতে আসলে কেউ হয়তো কারো হয় না। মানুষ আসলে হাজার মুখের ভীড়ে - হাজার মানুষের ভিড়ে একাই হয়তো বাঁচে। সবাই জানে মানুষ পৃথিবীতে একা আসে - একাই যায়। পরিণাম তার এক মুঠো ছাইয়ের সমষ্টি। কিন্তু অমৃতের পুত্ররা সেটা বোঝে বড্ড দেরিতে। আসলে চারপাশের মানুষের এত কোলাহল ঈশ্বরের ডাক - অন্তরের ডাক শোনা বড় মুশকিল। যখন ডাক শোনে - এবং বোঝে তখন জীবনের তিনভাগ পেরিয়ে যায়। তখন মনে হয় কেন জুড়লাম এ মায়ার জালে ??? হয়তো বা শুরুতেই জীবন পরার্থে নিবেদন করলে অন্যরকম হতে পারতো। নয়তো বা এ জীবনে যা পেয়েছি সেটাই মহার্ঘ্য। দুটোকে ব্যালেন্স করা খুব মুশকিল। মানুষ আসলে কি চায় সেই কি ঠিকঠাক জানে ? জানলে স্বয়ং সত্যদ্রষ্টা কবি কি লেখেন -
" যবে ঘরে আনি পাত্রখানি উজাড় করি..একি !
ভিক্ষা মাঝে একটি ছোট সোনার কনা দেখি ।
দিলেম যা রাজভিখারিরে
স্বর্ণ হয়ে এলো ফিরে,
তখন কাঁদি চোখের জলে দুটি নয়ন ভরে ..
কেন তোমায় দেইনি আমার সকল শূন্য করে।"
এ আত্মদর্শন - এ নিবেদন - যে যার মত করে যাবে মানুষ - এই তো জীবন। তবে পিপাসা ফুরোয় কোথায় ? ছেলে নতুন চাকরি পেয়ে যখন জিজ্ঞেস করে মা তুমি কি নেবে বলো ? সব কিছু ছেড়ে নির্দ্বিধায় নিজের অন্তর আত্মা থেকে বেরিয়ে আসে বাবা আমায় "স্বাধীনতা সংগ্রামে অচেনা লালবাজার" আর একটা 'গীতা ' এনে দিও। আবার একবার পড়বো। ছেলে বলল হ্যাঁ মা বেদ, উপনিষদ গীতা , এগুলো জীবনের বিভিন্ন বয়সে বিভিন্ন উপলব্ধি আনে। পড়ে আমায় বলো নতুন করে কি জীবন দর্শন অনুভব করলে ? শুনে আমি মনে মনে ভাবছি এ আত্মদর্শন যদি আত্মতৃপ্তির দিশারী-নতুন দিগন্ত রেখা হয়ে প্রজন্মান্তরে অন্তত রয়ে যায় সেটাও কি পরমার্থ নয় ? প্রত্যেকটি মানুষ যদি শেষের দিনে এই উপলব্ধি অর্জন করতে পারে যে আর কাউকে না হোক নিজের প্রজন্মের এক জনকেও এটা বোঝাতে পেরেছে যে তোমার নিজের আত্মাটাই হলো Sacred soul - a holy place of God. এটাকে কোনো মূল্যেই জীবনে অপবিত্র হতে দিও না। পরার্থে বাঁচো জীবন - আর আত্মদর্শনই হোক জীবনে চলার পথের একমাত্র মোক্ষ। "গীতা" পড়ে আমি একটি কথা আত্মস্থ করেছিলাম যে দুষ্কৃতীরা সমাজের যত ক্ষতি করে তার চেয়ে অনেক বেশি হয় ধার্মিক অথবা শিক্ষিত মানুষের সবকিছু দেখে বুঝেও নিষ্ক্রিয় থাকার ফলে। আর সে দর্শন থেকেই সারা জীবন নিজের স্বার্থের কথা না ভেবে সেখানে যতটা প্রয়োজন প্রতিবাদ করেছি। সে অর্থে সারাজীবন আমি এক আপোষহীন সংগ্রামী - এক ক্লান্ত পথচারী। জীবনে বহু ঝড় ঝাপটার কবলে পড়েছি - অসুস্থতা কাবু করেছে তবুও মেরুদণ্ডটা কোথাও বাঁকে নি এতটুকু। জীবনের শেষ দিনেও এই যেন থেকে যায় আমার শেষ পারানীর কড়ি হয়ে। নিজেকে নির্দ্বিধায় sacrifice করার আনন্দ ঠিক কতটা সেটা উপলব্ধির সময় এগিয়ে আসছে আর আমিও আজ তারই প্রতীক্ষায়। সে দিনের আত্মদর্শনও যেন পরমার্থ এর পথ প্রশস্ত করে এই কামনা।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴