আত্মঘাতী প্রগতি/মমতা পাল চন্দ
আত্মঘাতী প্রগতি
মমতা পাল চন্দ
রোজই তৃষ্ণা হিল কার্ট রোড থেকে অটো করে বাস স্ট্যান্ড এ যায়। আর প্রতিদিনই ওই সকাল আটটার দিকে ও সেবক মোড়ে যায় সেখান থেকে পি সি মিত্তাল বাস স্ট্যান্ড। তারপর সেখান থেকে বাস ধরে মালবাজার। কিন্তু তৃষ্ণার কাছে প্রতিদিনই মনে হয় ওই সেবক মোড়টা যেন অষ্টাদশী কিছু ললনাদের ramp walk এর প্রদর্শনী ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে। প্রতিদিনই তৃষ্ণা দেখে দু তিন জন করে অল্প বয়সী মেয়ে যাদের পরনে কোনরকমে কোমর টুকু ঢাকা আর হাতকাটা বড় গলার খুব টাইট অর্ধনগ্ন একটা ছোট্ট গোলাপী পোশাক। এবং ওই গোলাপী সুন্দরীদের একটা অতি উগ্র সাজ। তারা যখন রাস্তা দিয়ে হেঁটে যায় প্রত্যেকটি পুরুষ তো বটেই মহিলারাও সুন্দরীদের দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে থাকেন। আর সমগ্র পুরুষেরা মেয়েগুলোর high heel জুতো পায়ের লম্বা লম্বা নখ থেকে আপাদমস্তক যেন গিলে খায় দুচোখের চাহনিতে। আর ওই মেয়েরাও অপরূপ বিভঙ্গে যেন মাংস মেদের স্থাপত্য উপস্থাপন করতে করতে চলে যায়। আর পথচারী , যানচালক , নিরাপত্তারক্ষী সকলে অনাবৃত নারীদেহের দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে শিকারী ঈগলের মত অন্তর্ভেদী দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। তৃষ্ণা মায়ের মুখে শেমিজ পড়ার গল্প শোনা আভ্রুতে অভ্যস্ত সেকেলে শাড়ি পড়া দিদিমনি। প্রায় দিনই এই পথচারী জনসাধারণকে এইভাবে নারীদেহ চোখে চেটে খেতে জিভ বের করে ঠোঁট চাটতে দেখেছে তৃষ্ণা। কয়েকমুহূর্ত কেমন আনমনা হয়ে লজ্জায় অবনত হয়ে থাকতো তৃষ্ণা। কেননা সৌন্দর্য্য পিপাসু সরীসৃপদের ছুড়ে দেওয়া ব্যঙ্গ বিদ্রুপ শুনে মেয়েরা তাদের মরালী গ্রীবা নাড়িয়ে কোথায় একটা চলে যায় রোজ। তৃষ্ণা ভেবে পেত না এরা যায় কোথায় ? পরে শুনেছিল কোনো এক কোম্পানিতে নাকি কাজ করে এরা। যাইহোক তৃষ্ণা ভেবে পায় না প্রত্যেকটি মেয়েই কি করে এত সুন্দরী হতে পারে ? তাহলে কি এদের চুল, চামড়া, দাঁত, চোখ, নাক ,মেদ মজ্জা সবই কি মেশিনে দেহের ছিরি ছাদ ঠিক করে একই রকম ভাবে সৌন্দর্যের আঁকর হিসাবে উপস্থাপন করা। এই যে মেয়েরা নারী স্বাধীনতা, নারী প্রগতি, নারীর ক্ষমতায়ন , সমানাধিকার নিয়ে এত লড়াই করছে মেয়েরা সেটা কি "হাইব্রিড উইমেন" হয়ে উঠতে ? তাহলে কি নারী প্রগতি আসলেই একটা আত্মঘাতী প্রগতি ? যা প্রগতির নামে আরও খারাপের দিকে ধাবিত করছে ? হবে হয়তো। নাহলে এত ধর্ষণ এর সংখ্যা এত বাড়ছে কেন আজকাল ? এই যে দেহ ব্যবচ্ছেদ - মানে কাটা ছেড়া করে সুন্দরী হয়ে ওঠার প্রতিযোগিতা প্রত্যেকটি মেয়ের ভেতরেই আছে। তবেই না বিউটি পার্লারগুলোর এত রমরমা ব্যবসা। নিজের সৌন্দর্য্য বাড়ানো হতেই পারে একটা শিল্প। কিন্তু তৃষ্ণা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারেনা এই সৌন্দর্য্য শিল্পের দিকে মেয়েদের যত আগ্রহ তত আগ্রহ কিন্তু নেই মেয়েদের আত্মসম্মান- আত্মশ্রদ্ধা আত্মনির্ভরতা বৃদ্ধিতে। অথচ মা ঠাকুমার আমলে মেয়েরা অন্তঃপুরচারিনী হলেও আত্মসম্মানী ছিলেন যথেষ্ট।
কিছুদিন আগেই তৃষ্ণা গিয়েছিল ব্যাঙ্গালোর। চিকিৎসার কারণে পরীক্ষা নিরীক্ষার প্রয়োজনে বেশ কয়েকমাস থেকেছে সেখানে। সেখানে চিকিৎসা করা এবং মন ভালো রাখতে প্রতিদিন পার্কে যেত সে।সেখানে গিয়ে দেখেছে মেয়েদেরকে স্বনির্ভর করতে অসম এবং বাংলা থেকে প্রচুর মেয়ে দক্ষিণ ভারতে নার্সিং এবং ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে গেছে। বেশির ভাগই খুব গরীব ঘরের মেয়ে - বাবা মা হয়তো অনেক অভাবের মধ্যেও জমি বিক্রি করে ঋণ এ টাকা নিয়ে মেয়েদের পড়তে পাঠিয়েছেন। কিন্তু সেখানে ওই গ্রাম গঞ্জের মেয়েগুলোর বেল্লেলাপনা এবং ব্যভিচারী জীবন যাপন দেখে স্তম্ভিত হয়ে যেত তৃষ্ণা আর তার স্বামী পিয়াস। ছেলেমেয়েরা অনায়াসে লিভ ইন করছে। একসাথে থাকছে। তৃষ্ণা যেখানে থাকতো পাশেই একটি ফ্ল্যাট এ একটি লিভ ইন সম্পর্কে থাকা মেয়েকে টুকরো টুকরো করে কেটে ফ্রিজ এ রেখে পালিয়েছিল তার বন্ধু। তৃষ্ণা ভেবেই পেত না মেয়েদেরকে পড়তে পাঠিয়ে মা বাবা কি করে এত উদাসীন থাকতে পারেন? মেয়ে পড়তে গিয়ে সেখানে কি করছে তার খোঁজ রাখবেন না অভিভাবকেরা ? এত কম বয়সে পড়তে এসে যদি এত উশৃঙ্খল জীবন যাপন করে পরবর্তী জীবনে সমস্যা তো আসবেই। ফলে বাড়ছে ডিভোর্স, আত্মহত্যা, গর্ভপাত - মানসিক অবসাদ। কিন্তু তৃষ্ণা ভেবে পায় না এই প্রবণতা কমানো যায় কিভাবে? নাহলে মহিলাদের জীবন আরো অন্ধকারে ডুবে যাবে। কারণ মেয়েরা যদি স্বাধীনতার নামে নিজেদের প্রদর্শনের বস্তু করে তোলে - কিংবা স্বাধীনতা - ব্যভিচার বা স্বেচ্ছাচার এর পার্থক্য করতে না পারে তবে সে ভয়ংকর দিনটি কিন্তু মেয়েদের দিকেই ধেয়ে আসবে ব্যঙ্গ হয়ে - প্রতিধ্বনি হয়ে।
কারণ নারী প্রগতির মূল লক্ষ্য হলো বিশ্ব অর্থনীতির দায়ভার পুরুষদের সাথে সমানভাবে বহন করা। মহিলাদের শ্রমকে অদৃশ্য শ্রম হিসাবে গণ্য করার চিরাচরিত ধারণার বাইরে এনে মেয়েদের গার্হস্থ্য শ্রমকে মূল্যায়নের মধ্যে আনা। ফলে সমানাধিকার - দক্ষতা - মেধায় পুরুষের সমকক্ষ হওয়ার বদলে যদি কসমেটিক সার্জারি - আর প্রসাধনী দ্রব্য কিনে নিজেদের প্রদর্শনের বস্তু হিসেবে তুলে ধরতেই যদি মেয়েরা বেশি আগ্রহী হয়ে উঠে তাহলে ভারতবর্ষটা প্রসাধনী বিক্রির বাজার হয়ে উঠবে সারা বিশ্বের কাছে। যেহেতু বিদেশিনী মহিলারা ভারতীয় নারীদের মত এত সাজগোজ করতে ভালোবাসেন না। ফলে ভারতীয় নারীদের পণ্য হিসাবে চিত্রিত করতে বা তুলে ধরতে পারলে বিশ্ব বাণিজ্য লাভবান হবে। ভারতবর্ষ হয়ে উঠছে বিশ্বের প্রসাধনী বিক্রির বাজার। নারীদের সৌন্দর্য্য পিপাসা যদি তাদের স্বাধীকার বোধকে বিষিয়ে বা বিকৃত করে তোলে তবে তা অত্যন্ত বিপদজনক। আবার মেয়েরা কিছুতেই বার্ধক্য চায় না। ফলে যৌবন ধরে রাখতে দৈহিক সৌন্দর্য্য ধরে রাখতে ডায়েটিং করে - না খেয়ে থাকে। ফলে এই শারীরিক দুর্বলতা সকলের অবচেতনেই নব প্রজন্মের ভবিষ্যতকে ডুবিয়ে দেবে বিশ্ব বাণিজ্যের কাছে। ফলে মহিলাদের মহীয়সী হয়ে উঠা যদি সুন্দরী হয়ে ওঠার কৃত্রিমতায় নিমজ্জিত হয় তাহলে নারী প্রগতির প্রকৃত দর্শনটাই পাল্টে যাবে। তাই তৃষ্ণার মন খুব ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে সে তার স্বামী পিয়াসের সঙ্গে আলোচনায় মেতে ওঠে। তার কপালে ভাঁজ পড়ে যখন সে ভাবে নারী স্বাধীনতার নামে মহিলাদের সুন্দরী হয়ে উঠার প্রতিযোগিতা আসলেই একটি রোগ - একটি মানসিক অসুস্থতা। কিছু কর্মরতা অতি আধুনিক মহিলা আবার নিজের সৌন্দর্য্য নষ্ট হতে দেবেন না ভেবে অন্যের গর্ভ ভাড়া নিয়ে সন্তানের জন্ম দিচ্ছেন। পৃথিবীর সবচাইতে পবিত্রতম দায়ভার যে মাতৃত্ব তাকেই যদি মহিলারা অস্বীকার করে নিজের সৌন্দর্য্য টিকিয়ে রাখতে তাহলে এই মানসিক প্রতিবন্ধকতাকে দূর করার দায় কার?
তৃষ্ণার স্বামী পিয়াস সুযোগ বুঝে স্বদর্পে বলে ওঠে আসলে মেয়েরা যতই গলাবাজি করুক মেয়েদের বুদ্ধি সত্যিই কম তাই তোমাদের কপালে এত দুর্ভোগ বুঝলে? নাহলে প্রগতির মানে প্রসাধনী বোঝে মেয়েরা কখনও?
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴