অ্যা ডে উইথ যীশু/শ্রাবনী ভট্টাচার্য্য
অ্যা ডে উইথ যীশু
শ্রাবনী ভট্টাচার্য্য
হবি তো হ আজকের দিনেই সাইকেলটাকে বিগড়াতে হলো। আজকে পঁচিশে ডিসেম্বর। ছট্ পড়ুয়ার মিশনে কতো ভীড় হবে। বিক্রী বাট্টা ভালো হবে। আজকের দিনেই ব্যাটাকে বিগড়াতে হল।
মটকা গরম করেই ধ্যারধ্যারে সাইকেল টাকে নিয়ে ঐ মিশনের রাস্তাতেই এগোচ্ছি, হঠাৎ একটা মাঝবয়েসী লোক কোথা থেকে টপকে এলো পাশে। এসেই বলে "পুত্র আমাকে একটু সাহায্য করবে? আমি কোথায় এলাম, এখানেই বা এত লোকের সমাগম কেন, কিছু বুঝতে পারিছি না!"
আপাদমস্তক তাকালাম লোকটার দিকে। কোন গ্রহ থেকে এসেছে রে! বেশভূষা তো আদ্যিকালের ফরেনারদের মতো। খানিক রেগে গিয়েই বললাম, "কে রে তুই? আর মাইরি শোন সক্কাল সক্কাল এই যাত্রাপালা করবি না বলছি। আমার হেব্বি তাড়া আছে"।
লোকটি খানিক আত্মনিমগ্ন হয়েই বলল "লোকে তো আমাকে ইয়োশুয়ো বলেই ডাকত আমার জন্মভূমিতে"। "ইয়োশুয়ো?এ আবার কি নামরে বাবা? আবার বললাম "এ্যাই শোন, ঝেড়ে কাশ তো মাখনা। আসল নামটা কি তোর? আর এখানেই বা কি ধান্দায় এসেছিস?" লোকটি উদাস ভঙ্গীতে বলল "ইয়োশুয়োকে তোমরা এই দেশে কি বলো, বলো তো? যীশু নাকি! আচ্ছা যদি তাই হয়ে থাকে তবে তাই সই। আমি সত্যি যীশু"।
এবার খানিক স্তম্ভিত হয়েই বললাম "আপনি যীশু? তো এই সময় এখানে কেন?" যীশু উদাস ভঙ্গীতে বললেন "পরমপিতা বললেন যে পৃথিবীতে একবার আজকের দিনটাতে ঘুরে এসে আমাকে রিপোর্ট করো।আজকের দিনেই নাকি পৃথিবীতে আমার জন্মদিন পালন করা হয়। তা আমি যে কবে এই দিনেই জন্মালাম সে কথা আমি নিজেই জানি না।আমার তো যদ্দুর মনে পরে সেপ্টেম্বর মাস নাগাদ, ঐ যখন বেথলেহামের আকাশে তারা দেখা যায় তখন আমি জন্মেছিলুম। এরা যে কেন আমাকে এই ডিসেম্বরের পঁচিশে এনে ফেলল আমি বুঝছি না পুত্র"। আমি বললাম, "অত বুঝে কাজ নেই স্যার আপনার। পৃথিবীতে যখন টপকেই পড়েছেন তখন গীর্জাঘরটা ঘুরেই যান। দেখুন কত লোক সেখানে"। যীশু তার পরম করুণাঘন দৃষ্টিতে চেয়ে বললেন, "চলো পুত্র।"।
সাইকেলটা হরেনের দোকানে নিয়ে স্যারকে নিয়ে ঢুকলাম ছট পড়ুয়া মিশনে। এত লোক দেখে আবেগ তাড়িত যীশু বলে উঠলেন, "আহা পুত্র। কি অপরূপ দৃশ্য। আমার মৃত্যুর পরেও এত লোক আমাকে মনে রেখেছে! আমার কথা ভাবছে!"
যীশুকে বলতে বাধ্য হলাম, "কিছু মনে করবেন না স্যার। এত ভীড়ের মধ্যে এক পারসেন্ট লোকও আপনাকে মনে রাখছে না। লোকগুলো আপনাকে সামনে রেখে আমাদের এই পচামার্কা গরমের দেশে শীতকালটাকে এনজয় করছে। মেলা দেখতে এসেছে। এখানে আপনাকে কেউ ভালোবাসে না স্যার। এই আপনি ধরুন, আমাদের হিসেবে জষ্ঠ্যি মাসের গরমে জন্মাতেন আপনাকে থোরাই আম বাঙালী মনে রাখত? বড়ো জোর বাইরের মটকা ফাটানো রোদের হাত থেকে একদিনের জন্য হলেও বাঁচানোর জন্য ছুটি পেয়ে আপনাকে থ্যাঙ্কয়ু জানাতো। কিন্তু এ সব চার্চে যাওয়া,মোমবাতি জ্বালানো,কেক কাটা,ফেষ্টিভ্যাল এ সব থোরাই হতো। ছো! আসলে আপনার প্রতি এদের কোন ভক্তি টক্তি নেই স্যার।যা আছে সবটাই এই ওয়েদারের ওপর। আপনি স্যার বাঙালি জাতটাকে চেনেন না। এরা হুজুগ প্রিয়। এরা ঝালে ঝোলে অম্বলে সবেতেই আছে, আবার কিছুতেই নেই। আপনাকে স্যার আমরা আমাদের এক্স প্রভুর দেশের লোক মনে করে আপনার জন্মদিনে একটু ইংরেজ বা ফরেনার টাইপের সাজতে চাই। এটাও আমাদের একধরণের ট্রেন্ড। যেমন ধরুন কারো ছেলে মেয়ে যদি লন্ডন বা আমেরিকায় থাকে তবে, তাদের হাব ভাবে মনে হয় তারা যেনো স্বর্গেই থাকে। আসলে স্যার পোষ্ট কলোনিয়াল দেশেও কলোনিয়াল মনোবৃত্তি যায়নি। বরং অন্যরূপে বিকশিত হচ্ছে।"
যীশু অবাক বিস্ময়ে বলে ওঠেন, "আমি আবার ইংরেজ কবে ছিলাম? আমি তো আদতে ইজরাইলের লোক। আর শোন পুত্র ঐ যে চার্চের ভেতরে ব্যায়াম বীর মুষকো জোয়ান হাতে পেরেক ঠুকে দাড়িয়ে আছে, ওটা কে?" আমি বললাম, "কেন স্যার ওটা আপনি। টেক ইট লাইটলি স্যার। ঘাবড়াবেন না। ওটাও স্যার ইংরেজদেরই ইনভেনশান। সব পলিটিক্স। এনি ওয়ে স্যার আপনার আর কি কি দেখার আছে দেখে নিন।আমার একটু ইয়ে,মানে তাড়া আছে।" যীশু চার্চ ঘুরে দেখতে দেখতে হঠাৎ আমাকে বললেন, "পুত্র চার্চের মধ্যে,বাইরে দেখছি লাল জোব্বা পরা কতগুলো সাদা দাড়িওয়ালা লোক। ওরা কারা? আর সবাইকে হাতে হাতে কি যেন দিচ্ছে?" আমি বললাম, "স্যার, ওটা হলো সান্টা ক্লজ। ও যে কে, কেউ কিন্তু বিশেষ জানে টানে না। তবে ও ভীষন ট্রেন্ডি। কবে কোথায় সন্ত নিকোলাস বলে কে ছিলো তারই হাস্যকর বাঙালী ভারসান। এই আজকের দিনেই বাঙালিরা আবার সান্টা সেজে শিশুদের মধ্যে উপহার বিলোয়। তাও আবার বড়োলোকের গুডলু গুডলু বাচ্চাগুলোকে। আর যাদের সত্যিই অভাব আছে সেখানে স্যার এদের বিশেষ দেখা যায় না। এরা একটা উপহার বিলোলে ছবি তোলে পাঁচটা। আরে ঐ যে দেখুন দেখুন স্যার সান্টা সেজে সেলফি নিতে গিয়ে কেমন লোকটা পড়ে গেল!"
যীশু আবারও অবাক। প্রশ্ন করেন, "এই সেলফিটা কি পুত্র? আত্ম উপলব্ধি? না সেলফিস জায়েন্ট গোছের কিছু?"
আমি বললাম "স্যার সেলফি হলো গোদা বাঙলায় নিজের ছবি নিজে তোলা। এল সাথে আত্ম উপলব্ধি হ্যাজ নো কানেকশন। এই দেখুন না, ঐ যে, ঐ মেয়েটা আপনার স্ট্যাচুর গলা জড়িয়ে কত কায়দায় ছবি তুলছে ওটাই হোল সেলফি। এরা খানিকটা সেলফিস জায়েন্টের মতো প্রচুর প্রচুর নিজের ছবি তোলে। ঐ ছাপ্পান্নটা ছবি থেকে নিজের পছন্দের ছবিগুলো বাছাই করে ফেসবুকে পোষ্টাবে আর লিখবে ম্যারি ক্রিসমাস। এই এক ফ্যাশন হয়েছে স্যার, সব কিছুতেই হ্যাপি না হয় ম্যারি লিখবে। ম্যারিটা অবশ্যি আপনার জন্য যত্ন করে সিন্দুকে তুলে রাখে নিন্দুকদের ভয়ে। কিন্তু স্যার পূর্নিমা, অমাবস্যা, এই জয়ন্তী, সেই জয়ন্তী সবেতেই হ্যাপি ওমুক, হ্যাপি তমুক। ভাগ্যিস এখনো লেখে না হ্যাপি বাপের শ্রাদ্ধ, কি হ্যাপি মায়ের মৎসমুখ। আচ্ছা স্যার, সবেতেই কি হ্যাপি হওয়া যায়? হ্যাপিনেশ কি বাজারের আলু না কি স্যার? চাইলেই পাওয়া যায় বা হওয়া যায়?"
কথার বেগ এসে গেছে আমারো।আমিও বলতে থাকি "এরা কিন্তু স্যার আপনার জীবিতকালের কর্মকান্ড,আপনার সারমন এগুলো কিছুই জানে না।তবু ওরা বলে ম্যারি ক্রিসমাস।" যীশু আবারো আহত স্বরে বলে ওঠেন, "এরা কেউ আমাক তবে মনে রাখেনি পুত্র। এরা শুধুই হুজুগে চলে!" "আপনি কষ্ট পাবেন না স্যার। এরা আসলে কাউকেই মনে রাখে না। এরা শুধু ছুঁতো খোঁজে মৌজ মস্তি করার। ছবি তোলার। এরা আপনি কেন? বুদ্ধ, মহাবীর, নানক, মোহম্মদ, কারো সম্পর্কেই কিছু জানে না। জানতে চায়ও না। জানতে চাইলে কি স্যার দেশটার এমন অবস্থা হোত!! স্যার আর কি কিছু দেখবেন?" যীশু বলেন, "পুত্র তুমি যা দেখালে এর বাইরে আমার আর কাছু দেখার নেই এখানে। এখান থেকে যাই তবে এবার। পরমপিতার কাছে রিপোর্ট করতে হলে আমাকে অনেক দেশ দেখতে হবে। বিদায় পুত্র। ভালো থেকো।" এই বলে যীশু ভুস করে হাওয়ায় মিলিয়ে গেলেন। আমি চললাম একা, হরেনের দোকানে সাইকেল ফেরত পেতে।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴