সহজ উঠোন

রেজিস্টার / লগইন করুন।

সব কিছু পড়তে, দেখতে অথবা শুনতে লগইন করুন।

Sahaj Uthon
16-April,2023 - Sunday ✍️ By- রাজর্ষি দত্ত 422

অস্তরাগ/রাজর্ষি দত্ত

অস্তরাগ
রাজর্ষি দত্ত
---------------

চেনা পাখিটা সুরেলা গলায় ডেকে উঠল।

চেনা হলেও বহুদিন পাখিটাকে দেখেনি অবিনাশ। কোনওদিন আর দেখতে পাবে কি না সে জানে না।  হয়তো হারিয়ে গেছে ওর সঙ্গীদের মতন !    

 কি মনে করে সেদিন পাখিটার আওয়াজ রেকর্ড করেছিল। কাকভোরে ডাকছিল সেটা। মিতালি বা বাচ্চাদের কারুর ঘুম তখনও ভাঙেনি। ফরেস্ট বাংলোর গেট খুলে বেরিয়ে এসেছিল সে। বাইরেও তখন আরেক মশারির আচ্ছাদন। হালকা ধূসর আলোয় কয়েক মিনিট পরেই দেখতে পেয়েছিল সেই নাম-না-জানা পাখিটাকে। একটু বাদেই সেটা আর এক সঙ্গীকে পেয়ে ফুড়ুৎ করে উড়ে যায়, বাতাসে দোল খেতে খেতে।    

সেদিনের সেই রেকর্ড করা পাখিটির ডাক এখন অবিনাশের রিংটোন। বেশ কয়েক বছর ধরেই। রিংটোনের সাথে  সাথে দেয়ালে ফিট করা বাফার স্ক্রিনে ফুটে উঠেছে নাম, ঠিকানা, পেশা লেখা একটা অচেনা লোকের বিবরণ।  স্পিকার অন করে আধ মিনিট কথা বলে অবিনাশ ধীর পায়ে গিয়ে বসল বহুতল ফ্ল্যাটের ব্যালকণির চেয়ারে। 

হর্ন মারা বারণ তবুও নক্সা কাটা রাস্তায় অফুরন্ত ভিড় যানবাহনের। হেঁটে যাওয়া লোকজন খুব কম চোখে পড়ে। গ্রাফাইট রঙের রাস্তার দু-ধারে সারি সারি লাগানো গাছগুলিও যেন স্বাধীন নয়। ডালপালাগুলি একটু আয়েস করে হাত-পা ছড়াতে না ছড়াতেই এসে পড়ে ইয়া বড় ‘ট্রিমিং’ মেশিন। মাপে মাপে ছেঁটে দিয়ে যায়। ঝরে পড়া পাতা ও শুকনো ডাল ‘সাক’ করে নিয়ে যায় আরেক মেশিন, ঠিক সময়মতো। সবকিছুই অতিরিক্ত সাফসুতরো, চকচকে! নতুন কেনা খেলনার মতো। কোন একটা কবিতার লাইন মনে পড়ে যায় ‘মর্তের মাটি ময়লা বলেই এখানে প্রাণের মেলা…’। সেই ‘প্রাণ’ আজ হারিয়ে গেছে জীবন থেকে। 

ওয়ালেটের মধ্যে থেকে পাতলা কার্ডের মতো মোবাইলটা বের করে অবিনাশ। এবার সেটার ভাঁজগুলি পুরোটা খুলে সামনে রাখে। চোখ রাখে প্রায় পঁয়ত্রিশ বছর আগের সৃষ্টি ‘বনবীথি’ নামের হোয়াটসআপ গ্রুপে। গতরাতে অধিকারীও চলে গেছে পরপারের দেশে। এই মুহূর্তে বনবীথি গ্রুপের শেষ জীবিত সদস্য সে।

অস্ফুটে সে বলে ‘অধিকারী…’ 

মোবাইলের ঝকঝকে স্ক্রিনে তখুনি ভেসে উঠল অধিকারীর নানা ছবি, ভয়েস মেসেজ, গ্রুপ চ্যাট। থ্রিডি মোড অন করে দেখা গেল একটা ঝড়ের ভিডিও…সেখানে অধিকারীর গলায় রবীন্দ্রসঙ্গীত – ‘সব যে হয়ে গেল কালো…’

চোখ দিয়ে আপনা থেকেই গড়িয়ে পড়লো জল…

স্মৃতিতে ভেসে এল অনেক বছর আগের কথা। 

সেদিন এক পশলা বৃষ্টি শেষ হতেই ওরা বেড়িয়ে পড়েছিল ঠিক সন্ধ্যার মুখে মুখে। বড় বড় মহীরুহের পাতা থেকে টিপ টিপ করে জল তখনও পড়ছে। ছোট কাদামাখা একফালি বনপথের দুপাশে ঝোপ,পাতা আর ফুলগুলি নেতিয়ে আছে বৃষ্টির প্রকোপে। পাঞ্জাবী, পাজামা ভরে যাচ্ছে বিন্দু বিন্দু কাদার ছিটা লেগে। চলার ঘাম শুকিয়ে দিচ্ছে দমকা বাতাস। বীটবাবু বলেছিলেন বিশ মিনিট। কিন্তু পাক্কা সতেরো মিনিটের মাথায় ওরা পৌঁছে গেছিলো নদীটার ধারে। ছোট নদীটার নাম ডুংরি। 

আধো অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে। ওরা দেখতে পেল ওদের মতন আরও তিন চারটে ছায়ামূর্তি নদীর তীরে বসে। তাদের মধ্যে একজন একটু আলাদা, দূরে পাথরের গায়ে হেলান দিয়ে।

ভীষণ নিস্তব্ধ চারদিক। নদীর ওপাশের কালচে সবুজ জঙ্গলে ঝিঁ ঝিঁ পোকার বাজনার সাথে নদীর কুলকুল শব্দের সঙ্গত। ওরাও বসে পড়লো চুপচাপ। এখন কোনও কথা বলার সময় নয়। গভীর নিস্তব্ধতাকে সঙ্গী করে পৌঁছে যেতে হয় আরও গভীরে। ভেবে নিতে হয় আমরা যেন এখানেই বসে রয়েছি একশো বা দুশো বছর আগের ঠিক এই সময়ে ! সূর্য ডোবার পর অবশিষ্ট আলোর পাহারায়। সামনে দিয়ে বয়ে চলা ডুংরি নদীর কলতান যেন বিরামহীনভাবে বয়ে চলছে এক শতাব্দী ছেড়ে আরেক শতাব্দীতে। রাতের অন্ধকারে জেগে ওঠা প্রাণীকুল সুপ্রাচীন নিয়ম মেনে একে একে কোটর ছেড়ে বেড়িয়ে পড়ছে…জীবনের কর্তব্যে… 

‘মোরা সাঁইয়া বুলাবে আঁধি রাত…নদিয়া বৈরি...’ চাপা সুরেলা নারীকণ্ঠের গান-টি ভেসে এল পাথরের গায়ে যে হেলান দিয়ে আছে, সেখান থেকে। মনে হল এই পরিবেশের সাথে এমন মার্গসংগীতই যায় ! দৃশ্যের স্তব্ধতার পরে সুরের অভিঘাত সবাইকে আরও মূক করে দিল। গানের রেশ কাটতে না কাটতেই ডুংরির কালচে জলে লাগলো রূপালী ঝিলিক…যখন শ্বাপদের ডাকের নেপথ্যে দূরের শিমূল গাছের ফাঁক দিয়ে বনের মাথায় উঠে এল ধবধবে চাঁদ। তখন কোন জগতে আছি এটা ভেবে সবাই কথা কইতে ভুলে গেল।

আবার মেঘ এসে ঢেকে দিল চাঁদ। বইতে লাগলো জোর ঠাণ্ডা বাতাস। সবাই একসাথে ফিরে এল ফরেস্ট বাংলোতে। ওখানে পরিচয় ঘটলো আরও দুটি ফ্যামিলির সাথে। ওরা দেরিতে পৌঁচেছে কারণ একটা বড় দাঁতাল ওদের গাড়ি আটকে দাঁড়িয়েছিল অনেকক্ষণ। 

আলাপ পরিচয়ের পর্ব শেষ হলে বাংলোর চওড়া বারান্দায় বসলো গল্পগুজবের আসর। জয়ন্তদা, মিঃ মুখার্জি, সম্রাজ্ঞী, দ্বৈপায়ন, নন্দনাদেবী, ধীরেনবাবু, বলাই স্যার…প্রত্যেকেরই ভালবাসার জায়গা অরণ্য। খাওয়াদাওয়ার পর্ব শেষ হলেও অনেক রাত অবধি চললো কথামালা, রাতচরা পাখির ডাককে সাক্ষী রেখে।

হোয়াটসআপ গ্রুপটা করা হয় সে রাতেই। সব মিলিয়ে সদস্য ছিল ষোলোজন। আজ সেখানে এসে দাঁড়িয়েছে মাত্র একজনে। এভাবেই বুঝি একা হয়ে যেতে হয় শেষপর্যন্ত ! 

সেই থেকে প্রতি বছর সবাই একসাথে হত – কোন না কোন অরণ্যের কোলে। যদিও প্রথমবারের কথা কেউই ভুলতে পারেনি। ব্যক্তিগত সমস্যা জড়িত সংসার জীবনে সারাবছরের জন্য অক্সিজেনের সিলিন্ডার ভরতে আসতেই হত শাল, শিমূল, সেগুন, পিপুল, শিশু আরও কত শত নাম না জানা গাছের ছায়ায়। এক অদ্ভুত, ভয়মিশ্রিত ভালোবাসা ও রোমাঞ্চের ঘেরাটোপে। ভোরবেলার মুক্ত বাতাসে শিরীষ পাতার ঝিরিঝিরি কাঁপুনি, আলোছায়ায় মাখানো সরু বনের পথ – যা টেনে নিয়ে যায় উঁচু উঁচু গাছের বেষ্টনীতে ঘেরা নিঝুম পুরীতে, চতুর্দিকে বেড়ে ওঠা আগোছালো জঙ্গুলে ঘাস আর লতাপাতা, তাদের মাথায় বাহারি নানা রঙের ফুল, কালচে-খয়েরী সাপের মত পেঁচিয়ে বা ঝুলতে থাকা লম্বা লম্বা ঝুরি, চলার পথে গুঁড়িয়ে যাওয়া মচমচে পাতা, কখনো বা গোড়ালি ডুবে যাওয়া ঘাসের গালিচা, হঠাৎ পথ আটকে থাকা ছোট পাহাড়ি ঝরনা তাদের আকুল করে তুলতো।মাটি আর গাছের বনজ কষা গন্ধ, দূর বনবস্তি থেকে ভেসে আসা আদিবাসী গান আর মাদলের ধুন সংক্রমিত হয়ে গেছিল সমমনস্ক প্রাণের মানুষদের মধ্যে। তাই বাৎসরিক সঙ্গলাভের লোভ কেউ ছাড়তে পারেনি যতদিন না পর্যন্ত বয়সটা অন্তরায় হয়ে দাঁড়ালো। গ্রুপে কথা হত…অনেক অনেক কথা…

সেই জীবন আর জগৎ আজ কোথায় ? 

গত দুই-তিন দশকে সারা পৃথিবীতে কতই না পরিবর্তন দেখা গেল ! অরণ্য, নদী, জনপদের ঠিকানা অদলবদল হল। ভূগোলের এইসব পরিবর্তন আজ ইতিহাসের পাতায় ! তার সাথে এল কত সংক্রামিত অসুখ। অনেকেই চলে গেল সময়ের আগেই। মানুষের জীবনটাই যেন হয়ে গেছে বিধি-নিষেধের কারাগার! 

তবুও স্বাগত পরিবর্তনকে ! অগ্নিপিণ্ড পৃথিবী শীতল হয়ে একদিন সৃষ্টি হয়েছিল উদ্ভিদ আর প্রাণীকুলের। তারপর লক্ষ লক্ষ বছরের বহু পরিবর্তনের হাত ধরেই না ধরাধামে এসেছি আমরা – মানুষেরা? বিধাতার সৃষ্টি সেই মানুষের হাতেই হয়েছে কত শত নতুন অবিস্মরণীয় সৃষ্টি ! আবার সবকিছু ধ্বংস হতে চলছে অনিবার্য পরিবর্তনের মাধ্যমে। কে আটকাবে তাকে? এটাই তো অসীম ব্রহ্মান্ডের আশ্চর্য খেলা ! 

ওর শেষ আশ্রয় ‘বনবীথি’ গ্রুপটা অবিনাশ মোবাইলের ওয়েস্ট বিন-এ ফেলে দিল। কেন জানি এবার প্রচন্ড ভারী লাগছে সেটা!

আপনাদের মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴
software development company in siliguri,best
                          software development company in siliguri,no 1 software
                          development company in siliguri,website designing company
                          in Siliguri, website designing in Siliguri, website design
                          in Siliguri website design company in Siliguri, web
                          development company in Siliguri