অসীম ছুঁয়ে ছুঁয়ে/বেলা দে
অসীম ছুঁয়ে ছুঁয়ে
বেলা দে
খুব মেরেকেটে হয়তো মাত্র তিন এ আমি,প্রথাগত বিদ্যায় যাইনি তখনো, টেবিলে রাখা হাসমুখ রবীন্দ্রনাথ, ছবিটা দেখিয়ে মা' কে জিজ্ঞেস করি এই দাড়িবুড়োটা কে মা? মা বললে ওকথা বলতে নেই, উনি একজন ঠাকুর প্রনাম করো, হাতজোড়ে প্রণাম জানাই। এদিনের হাইব্রিড শিশুদের মতো উর্ব্বরা ছিল না আমাদের শৈশব, বুলি ফুটতেই ওদের কৌতুহল ঢাকনা খোলে। শ্লথ গতিতেই পাঁচে পা রেখে বিদ্যারম্ভ, জানলাম তাকে প্রভাত সংগীতে, জন্মদিনে দিদিমনিদের মাল্যদানের শ্রদ্ধা জ্ঞাপনে ২৫শের নাচ,গান, আবৃত্তি মুখর রাবীন্দ্রীক নিবেদনে।
এই সব কিছুই নাকি তাঁর লেখা, যতই শুনছি ততই অবাক বিস্ময়ে উপভোগ করে চলেছি। এত্তো লেখা উনি লিখতে পারেন,অবনত প্রণামের বহর আর ঠাকুরের কাছে প্রার্থনাও গেল বেড়ে - "আমাকে
দু চার লাইন ছড়ার পংক্তি দাও না!" দিয়েছেন চতুর্থ শ্রেণিতে। আর এক ধাপ এগিয়ে সেই ২৫শে পাড়ায় কচিকাঁচাদের নিয়ে দল বাঁধে রেবতীকাকু, উনি বোসবাড়ির নায়েব মশাই অত্যন্ত সংস্কৃতিমনস্ক এবং সাহিত্যিক। তাদের দাড়িয়াঘরের বারান্দায় শুরু হল "ডাকঘর " নাটকের প্রাত্যহিক রিহার্সাল এবার খুব শক্ত করে ধরেছি ঠাকুরকে। বসে গেলাম অমলের চরিত্রের ভিতরে ঢুকে। বালকের সমস্ত সত্ত্বা জুড়ে অসীম কল্পনা, কল্পছবিতে এঁকে ফেলেছে দইওয়ালার গ্রাম, পাচমুড়া পাহাড়, শ্যামলী নদী আর লালপেড়ে মেয়েদের চালচিত্র।রাজার চিঠির অলীক বার্তায় ক্ষয়িত অবসন্নশিশুটির পরিসরে ঢুকে তুলে ধরেন তার সংবেদনশীল মন, সে আকুতি তার নিজস্ব।মিঠেল সুরে দই দই ভালো দই, এই সুরের সাথে মিলিয়েছেন দূর আকাশে ডেকে ডেকে নীড়ে ফেরা বিহঙ্গের কন্ঠস্বর। বন্দী বালকের ভিতর খুঁড়ে তুলে এনেছেন তার কৌতুহলী চোখে বাস্তব জীবন চিত্র।মালিনী সুধার সাথে বাল্য প্রেমের সঞ্চার বড়ই বিচিত্র, ছোট্ট একটা আপ্তবাক্য "অমল উঠলে বলো সুধা তাকে ভোলেনি।" শিহরণ জাগায় অনুভূতির প্রকাশে।বয়:সন্ধির দোরগোড়ায় এসে অন্ধকারময় ডুয়ার্সপল্লিতে একমাত্র তুমি ছিলে কবিগুরু আমার অন্তরতম সাথী। "গোরা"কে চেপে নিয়েছি পাঠ্যপুস্তকের আড়ালে।
মাতৃহীন আইরিশ সন্তান গোরা বড় হয়েছে হিন্দু মাতা আনন্দময়ীর কোলে চোখ ভিজে উঠেছে জলে।শিলাইদহের গ্রাম গ্রাম ঘুরে কাব্যগল্পের রসদ খুঁজে ঝোলায় ভরেছো উদার অসীম প্রকৃতিকে।সেখানে খোলা আকাশ ভোরের বাতাস চন্দ্রালোকিত সন্ধ্যা আর গ্রাম্যজীবনের উদার মনের ভাষার কাছে সীমার গন্ডি অতি তুচ্ছ। অসীমের ছোঁয়া থেকে তোমার ছোট গল্পের কিশোর চরিত্রগুলিও বাদ পড়েনি। অতিথির" তারাপদ" "ছুটি " গল্পে পাড়াগেঁয়ে বাউন্ডুলে "ফটিক" মেনে নিতে পারেনি মামাবাড়ি কলকাতায় শাহরিক যাপনরীতি, তাই অভিমানে ছুটি নিয়েছে জীবন থেকে। "শেষের কবিতার" লাবণ্য আর অমিত র প্রেম
সার্থকতা পায়নি শুধু অসীমকে সীমায় বাঁধতে চাওনি বলে।ঠাকুর মেনেছি আজন্মকাল তোমাকেই তাই বুঝি মৃত্যু যন্ত্রণা থামাতে পারেনি তোমার শব্দ তরঙ্গের ঢেউ। আজও জনমানসে চলছে তোমার যাওয়া আসা হয়তো বা অন্য কোনো রূপে। নিজেই তো বলেছ "তখন কে বলে গো নেই আমি/আসব যাব চিরদিনের এই আমি "।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴