সহজ উঠোন

রেজিস্টার / লগইন করুন।

সব কিছু পড়তে, দেখতে অথবা শুনতে লগইন করুন।

Sahaj Uthon
22-December,2024 - Sunday ✍️ By- শঙ্খ মিত্র 101

অলৌকিক বিভা/শঙ্খ মিত্র

অলৌকিক বিভা
শঙ্খ মিত্র

কীভাবে এত সহজেই অপার বিস্ময়বোধকে দূরে সরিয়ে অনন্ত নির্লিপ্তির ভেতর আচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছে মানুষগুলো! মুক্তি, সে তো অনেক পথ। অথচ বিস্ময়ের আতিশয্যে আমি কেমন বিপন্ন বোধ করছি। 

ক্রমশ এক অপ্রকাশিত মানচিত্রের ভেতর থেকে ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসছে একটি প্রাগৈতিহাসিক ছায়া। পাবনিখড়ির মোড়ে চার্চের ভিড় উপেক্ষা করে ঘরে ফিরছে মধ্য চল্লিশের মারিয়ানুস। মারিয়ানুস বারলা ও সামাইমা বারলা, বাগানের রক্ষণাবেক্ষণের ভার আপাতত এই বারলা দম্পতির ওপর ন্যস্ত। বাগানের ঠিক মাখখানে কিছুটা ফাঁকা জমি পরিষ্কার করে তৈরি করা হয়েছে দোচালা দুটি ঘর, সেখানেই তাদের অলিখিত অস্থায়ী সংসার। পাশেই পাম্পহাউস। সারাদিনের তদারকি সেরে ফিরে গেছেন ম্যানেজারবাবু।

মারিয়ানুসের সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ 2010 সালের জনগণনার সময়। আমি তখন গ্রামেরই সরকারি বিদ্যালয়ের নবনিযুক্ত শিক্ষক। সরকারি আধিকারিক রূপে সম্পূর্ণ আনকোরা আমি, অচেনা এক পাড়া গাঁয়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে সার্ভে করছি। সে এক বিপুল আয়োজন। কার ক'টা ঘর, বাড়িতে কে কে আছেন, পরিবারের কর্তা কে, তাদের জন্মপঞ্জি থেকে শুরু করে সমস্ত সম্পত্তির যাবতীয় তথ্যের অনুপুঙ্খ হিসাব নিকাশ নথিবদ্ধ করা। 

বাগানের সরু রাস্তা পেরিয়ে উঠোনে গিয়ে যখন দাঁড়ালাম তখন দুপুর গড়িয়ে গেছে। বারান্দায় বসে মাটির উনুনে ভাত চাপিয়েছে সামাইমা। হাঁড়ি উপচে পড়ছে ভাতের ফ্যানে। অথচ খেয়ালই নেই তার, এককোণে রীতিমত ঝিমোচ্ছে সে। দুবার ডাকার পর সম্বিৎ ফিরতেই শশব্যস্ত হয়ে একখানা পিঁড়ি এগিয়ে দিল বসার জন্য। আমি কে, কোথা থেকে আসছি, কী উদ্দেশ্যে আসছি এসব বোঝানোর পর সামাইমা ঘরের ভেতর চলে গেল। ইতিমধ্যে সাইকেলে চেপে টলতে টলতে উঠোনে এসে দাঁড়াল দীর্ঘকায় মারিয়ানুস। আমাকে প্রথম দর্শনেই তার ভ্রূ যুগল কুঁচকে গেল। আমি যতটা সম্ভব বোঝানোর চেষ্টা করলাম কী কাজে এসেছি। কিন্তু সে যে সন্তুষ্ট নয় তা তার চোখে মুখে স্পষ্ট। বউ ঘরে নথি ও কাগজপত্র খুঁজছে একথা জানার পর সে অত্যন্ত রেগে গেল এবং বউ এর ওপর চড়াও হলো। ঘটনা এতটাই মারাত্মক আকার ধারণ করল যে তা হাতাহাতির পর্যায়ে পৌঁছে গেল এবং মারিয়ানুসের পায়ের আঘাতে ফুটতে থাকা ভাতের হাঁড়ি গেল উল্টে। এই অত্যন্ত অবাঞ্ছিত ও অপ্রীতিকর ঘটনায় মুহূর্তের জন্য মনে হলো আমিই দায়ী। কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে বেরিয়ে এলাম আমি।

ফিরে এলাম ঘন্টা খানেক পর। কারণ কাজটা ওঠাতে হবে। কিন্তু ফিরে আসার পর দেখতে পেলাম এক অন্য মারিয়ানুসকে। মারিয়ানুস এবার যেন বিনয়ের প্রতিমূর্তি। সমস্ত অনার্য জাতির প্রতিনিধি হয়ে সে বয়ান করে চলেছে তার দিনপঞ্জি। কথায় কথায় জানাল, তারা এসেছে বাগরাকোট অঞ্চলের ভেতরে এক বাগান বস্তি থেকে। মারিয়ানুসের আদি পুরুষেরা ছিল আসামের তিনসুকিয়া জেলার মার্গেরিটা টি-এস্টেটে। কালক্রমে বাগরাকোটে এসে বসতি স্থাপন করে, সেখানেই সংসার পাতে। নিঃসন্তান দম্পতি বিভিন্ন বাগান ঘুরে ঘুরে আপাতত এখানে থিতু হয়েছে। এখানেই বা কতদিন থাকতে হবে তাও তারা জানে না। কথার মাঝেই মারিয়ানুস নিজেই উঠে গেল আর গুড় দিয়ে লিকার চা বানিয়ে পরিবেশন করল আমাকে। এত আন্তরিক এত নম্র এই লোকটাকে কিছুক্ষণ আগের উগ্র লোকটার সাথে মেলাতে, আমার তখন অসুবিধা হচ্ছিল। চা-পর্ব মিটলে কানের পেছনে গোঁজা একটা বিড়ি এগিয়ে দিল আমার দিকে। আমি সবিনয় প্রত্যাখ্যান করলে সে নিজেই ধরিয়ে নিল। কথোপকথন চলতে লাগল। আমি আমার কাজ গোটাতে লাগলাম।

- তোমাদের তাহলে ছেলে মেয়ে নেই?
- না স্যর, আমরা দুইটা মানুষ। কুনোরকম চলছে।
- এই ঘরটা তো তোমাদের নয়?
- না, বাগান থিকে দিছে।
- কতদিন আছো এই বাগানে?
- 4 বছর হবে
- এখানে কতদিন থাকবে?
- সেইটা বলতে পারি না।
- তোমাদের গরু, বাছুর, ছাগল এসব আছে?
- না
- টিভি , রেডিও?
- কিছু নাই স্যর
- একটা সই দিতে হবে। পারবে সই করতে?
- সই দিয়ে কী হবে স্যর? আমরা কি কিছু পাবো? 
- না এই হিসাবগুলো কিছু পাওয়ার জন্য নয়। আমাদের দেশের লোকসংখ্যা কত, কতজন মহিলা, কতজন পুরুষ, তাদের বয়স, এগুলো তারই হিসাবপত্র। সরকারের কাছে জমা পড়বে। এতে তোমাদের কোন ক্ষতি হবে না। চিন্তা কোরো না। 
- কিছু যাতে পাই সেই ব্যবস্থা করেন স্যর
- এসব তো আমাদের হাতে নেই, কিছু হ'লে নিশ্চয়ই জানতে পারবে।
- আমরা কিছু পাব না স্যর। দেশ কী জিনিস আমরা জানি না। আমাদের ঘর নাই, জমি নাই, টাকা নাই, কিছু নাই। শুধু এই শরীরটা আছে।

সূর্য হেলে পড়েছে পশ্চিমে। চা বাগানের পাতায় পাতায় হলুদ আলো এসে পড়েছে। দিন শেষ হতে চলল। উঠতে হবে আমাকেও। ব্যাগ কাগজপত্র গুছিয়ে আমি উঠে পড়লাম। হঠাৎ কী মনে হলো, মারিয়ানুস পিছু নিল আমার। "স্যর, তুই আবার আসিস। আমাদের কিছু লাগবে না। যতদিন এই শরীর আছে, ততদিন আমরা আছি। তবু তুর সাথে কথা বইলে ভাল লাগল। দুটা মনের কথা কয়ে শান্তি পাইলাম।"
দূর থেকে ভেসে আসছে সাইরেন বাজার শব্দ। আমি পিছন ফিরে দেখতে পাচ্ছি, আদিমতম ভারতবর্ষের দুই প্রতিনিধি ক্রমশ মিলিয়ে যাচ্ছে সন্ধ্যার হেঁয়ালির ভেতর। 

আরও একটি বড়দিনের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে স্কুল থেকে ফেরার সময় হঠাৎই দেখতে পেলাম মারিয়ানুসকে, যেন বেথেলহেমের রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছেন এক দিব্যপুরুষ। আর ছড়িয়ে দিচ্ছেন তাঁর অলিখিত আইডেন্টিটি। আমি এক ঘোরের মধ্যে তখনও আওড়ে চলেছি, "ভোটার কার্ড আছে? ঘর আছে? রেডিও, টিভি....?" আমি দেখতে পাচ্ছি সেই সজল দৃশ্যের সামনে এখনও অবিকল দাঁড়িয়ে আছে মারিয়ানুস আর দুই হাত তুলে বিদায় জানাচ্ছে আমাকে, পেছনে ছড়িয়ে পড়ছে অলৌকিক আলো। 

আপনাদের মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴
software development company in siliguri,best
                          software development company in siliguri,no 1 software
                          development company in siliguri,website designing company
                          in Siliguri, website designing in Siliguri, website design
                          in Siliguri website design company in Siliguri, web
                          development company in Siliguri