অলক পর্ণা সেনগুপ্ত ব্যানার্জী-র আলোচনায় সৌগত ভট্টাচার্য-র বই 'হুজুগ রায়ের পা'
অলক পর্ণা সেনগুপ্ত ব্যানার্জী-র আলোচনায় সৌগত ভট্টাচার্য-র বই 'হুজুগ রায়ের পা'
কথাকার সৌগত ভট্টাচার্যের প্রকাশিত দ্বিতীয় বই, “হুজুগ রায়ের পা” দশটি ছোটগল্পের সংকলন। বইটি পড়ে আমার পাঠ অনুভব লেখার চেষ্টা করছি মাত্র।
প্রথমেই বলি গল্পগুলো পড়তে পড়তে কখনও একটানা বেহালার করুন সুর বেজে যাওয়ার স্বাভাবিক একঘেয়েমি আসতে চাইলেও, লেখার গুনে পাঠক বাধ্য হবেন পড়ে যেতে।
আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে থাকা অতিসাধারণ মানুষজন আমরাও যার অংশ, এ বইয়ে সেসব মানুষের আখ্যান বুনেছেন লেখক। প্রথম গল্পে প্রোটাগনিস্ট কালু, মানুষ নয়, কিন্তু সীমান্তের তাড়া খাওয়া, ক্ষুধার্ত মানুষগুলোর প্রতীক। সেই মানুষ, যাদের দেশের ভাগ বাটোয়ারা, সীমানা, বোধের অগম্য, যাদের প্রাণের থেকে একটা বুলেটের দাম শাসকের কাছে অনেক বেশি।
আরেকটি গল্প, যেখানে একটা পা ক্রমাগত ছোট হয়ে যাচ্ছে এমন মনে হওয়া ভ্যানচালক হুজুগ রায় কাঁটা তারের ওপারে দাঁড়ানো উত্তম কবিরাজের চোঙা লাগানো গাড়ি থেকে মাইকের আওয়াজ শোনে, এ দেশ থেকে ওদেশে পাখিদের উড়ে যেতে দেখে, ফিরতেও, সে কি পারবে তার সীমানা পেরিয়ে কবিরাজের থেকে তেল এনে পায়ে লাগাতে?
কিংবা সারাদিন রোদে জলে ঘুরে ঘুরে অচেনা মানুষের নাম ঠিকানা নোটবুকে লিখে রাখার বাতিক আলোকের যাকে আড়ালে সবাই পাগল বলে, সেই আলোক নোটবুকে কিন্তু কমলের নামের সাথে কিছুই লিখতে পারে না কারন “কমল ভুলি নাই” মাঠের সিমেন্টের বেদিতে “কমল তোমাকে আমরা ভুলি নাই” লেখা থাকলেও সেই কমলকে কেউ মনে রাখেনি। হ্যাঁ এভাবেই তো মানুষ বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যায়, সাধারনের স্মৃতি সরিয়ে কোনো অসাধারণ তার জায়গা নেয়।
আপাতদৃষ্টিতে যা সাধারণ হয়ত বা এলেবেলে, লেখকের মননশীল কলমের ছোঁয়ায় পাঠক তার সুক্ষ্ম সুক্ষ্ম ভাঁজ, স্থির জলের নীচে তোলপাড় ঢেউ প্রত্যক্ষ করে।
“তোক কয়া ছচ মালতি, মুই চাও মুই মরি গেলে মোর মতন চাষার চখু ঝিনি দ্যাশের কুনো একঝন বড় গোয়েন্দা বাবু পায়। চাষার চখু দিয়া ওই গোয়েন্দা ঝিনি পশ্চিম মৌয়ামারি গেরামটা দেখিবার পায়!” চাষার চোখ দিয়ে কেউ কখনও তার গ্ৰাম দেখেনা…সুভাষের এই আর্তি তার অস্তিত্ব সংকটের। সাধারণের ভীড়ে স্বস্তি পাওয়া গুরুত্বহীন একজন মানুষের হটাৎ গুরুত্বপূর্ণ ও একা হয়ে যাওয়া বা যে ঘটনা রোজ সাধারণের সাথে ঘটে চলে তার উল্টোটা হওয়া সুভাষ কে ব্যাথিত ও বিস্মিত করে!
ভোলেনের কালীর মুখোশ চোখের জলে ভিজে যায়, দেনা শুধতে গিয়ে মুখোশ খুলে মেয়েকে নিয়ে মেলায় যাওয়া হয়না। মনাইয়ের দোকানের পুতুল গুলোর মতো অদৃশ্য সুতোর টানে অনিচ্ছুক নাচ নেচে চলে ভোলেন।
আমাদের জীবন তো এমনই, চাওয়া পাওয়ার হিসেবে ফাঁক থেকে যায় বিস্তর, জীবনের ধার শোধ করতে করতে জীবনকেই আর ফিরে দেখা হয়না। আবার ফেলে আসা জীবনে ফিরতে চেয়ে অদৃশ্য বিধাতা বোর্ড ঝুলিয়ে দেয় “পরিচয় পত্র ছাড়া প্রবেশ নিষেধ।”
হলুদ শাড়ি গল্পের মায়া সৎ মা আলোর হলুদ শাড়ির কোচড়ে মুড়ি মুড়কি বেঁধে রাতের অন্ধকারে দাদাদের হাত ধরে নিরাপদ জীবনের খোঁজে ইন্ডিয়ায় আসে কিন্তু কিছু বছর বাদে ও রাইস মিলের কোনে ছাপরা ঘরের সংসার নিয়ে আবার উদ্বাস্তু হয়। মায়ার ভাবনার মধ্যে একটাই সোজা রাস্তা যা ওর জন্মভিটে বুড়িমারির তিপ্পান্ন পাড়া গ্ৰাম থেকে ওই রাইস মিলে এসে ফুরিয়ে গেছে। যেখানে এখন ওর “প্রবেশ নিষেধ।”
সাতচল্লিশের উদ্বাস্তু আমার পরিবার, আমার বাবা,কাকা, আমার ঠাকুমার গল্পে ফিরে ফিরে আসা সোনালী স্মৃতি যা কাঁটাতারের ওপারে কোথাও গচ্ছিত রেখে এসেছিল তারা, এ গল্প আমাকে সেই শৈশবের দিনগুলো মনে করালো।
ব ইটির শেষ গল্প, সুইটি ও সানগ্লাস। সুইটি ও মানিকের মাত্র ছয়মাসের বিবাহিত জীবনে কঠিন অসুখের ঘুন ধরে। অপ্রাপ্তি জীবনের সব দরজায় খিল এঁটে দিলেও আমাদের একটু ভালো থাকার ইচ্ছে ঢেউয়ের মতো সেই দরজায় ধাক্কা দেয় প্রায়শই। অযাচিত ভাবে প্লেনে সফরের সুযোগ এলে বা বড় শহরে পা রেখে তাই সুইটি স্মৃতি জমাতে চায় সেলফি তুলে, বুকে গোপন ইচ্ছে লুকিয়ে রাখার মতো করে হাতব্যাগে লুকিয়ে নিয়ে আসে মেলা থেকে কেনা সানগ্লাস। হয়ত আর হাসপাতালে আসার প্রয়োজন হবে না জেনে মাতৃসমা কনকের কাছে নিজের ফুচকা খাওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করে ফেলে। এমন ঘটনা আমাদের সাথেও হয় কখনো কখনো, তুলকালাম ঝড়ের মাঝেও ক্ষণিকের জন্য আমরা শ্লেটরঙা আকাশ দেখে বিভোর হই।
দূর্দান্ত ফটোগ্রাফার ও লেখক সৌগত ভট্টাচার্য তার ফটোতে যেমন চেনা জিনিস কে অন্য রকম মায়াবী করে উপস্থাপন করেন তেমনি রোজকার তথাকথিত গল্প হীন জীবনের পেছনেও যে আলোছায়া মাখা উদাসী গল্প রয়ে যায়, যে গল্পকে আমাদের বেগবান জীবন স্থির বৃক্ষের মতো পেছনে ফেলে আসে, সবার অলক্ষ্যে হয়ত তার পাতা ঝরে পড়ে বা ফুল ফুটে ওঠে সেই আপাত তুচ্ছ ঘটনাকে আমাদের দেখান। আমরা দেখি, হ্যাঁ ওনার লেখা ওনার তোলা ছবির মতোই যা পাঠক শুধু পড়ে না দেখেও… অতিসাধারণ মানুষের কথা, তার খুব সামান্য পাওয়ার আর বেশিরভাগই না পাওয়ার গল্প। বাংলা সাহিত্যে সৌগত ভট্টাচার্যের লেখা থেকে যাবে বলেই আমার বিশ্বাস। ইতিমধ্যে ওনার তৃতীয় বই প্রকাশিত হয়ে গিয়েছে। উনি আরও ভাল ভাল লিখুন আমরা সমৃদ্ধ হই এটাই চাওয়া থাকল।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴