অর্পিতা মুখার্জি চক্রবর্তী-র আলোচনায় অশোক কুমার গঙ্গোপাধ্যায়-এর 'পুনরুত্থান'
অর্পিতা মুখার্জি চক্রবর্তী-র আলোচনায় অশোক কুমার গঙ্গোপাধ্যায়-এর 'পুনরুত্থান'
বিশিষ্ট গল্পকার শ্রদ্ধেয় শ্রীযুক্ত অশোক কুমার গঙ্গোপাধ্যায়ের পুনরুত্থান উপন্যাসটির প্রথম প্রকাশ 2008 সালে হলেও,লেখকের হাত ধরে আমার হাতে এসে বইটি পৌঁছেছে খুব সম্প্রতি। এমন একটি অসাধারণ বই হাতে পেয়ে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করেছি,বইটির এমন দুটি অসামান্য গল্পের পাঠক হতে পেরে।
প্রথম গল্প পুনরুত্থান নিয়েই লিখলাম আপাতত স্বল্প পরিসরের এই লেখায়। এটি মূলত তিস্তা পাড়ের মাঝিভাইদের গল্প।লেখক নিজস্ব মুন্সিয়ানায় ও অসামান্য বর্ণনার গুণে গল্পটিকে পাঠকের সামনে উপস্থাপন করেছেন। তিস্তার ওপর প্রথম ব্রিজ হওয়ার সময়কালটিকে লেখক তুলে ধরেছেন অত্যন্ত সুচারু ভাবে।মাঝি মাল্লাদের যাপনের রোজনামচা, সংশয়, অভাব- অনটন,সৌহার্দ্য,শত্রুতা, কান্না, হাসি, অনুরাগ,বিচ্ছেদ এতটাই গভীরতার সঙ্গে উঠে এসেছে এ গল্পে,যা এককথায় অতুলনীয়। খুব সামনে থেকে প্রত্যক্ষ করে গভীর অনুভূতি ও উপলব্ধি দিয়ে সামগ্রিক পরিস্থিতির মধ্যে অবগাহন না করলে এমন কলম ধরা সম্ভব নয়। লেখকের সহানুভূতিশীল ও কোমল মনের প্রতিফলনও এমন একটি মনকাড়া লেখা।
পুনরুত্থানের নায়ক সনাতন মাঝি প্রকৃতই একজন ভালো মানুষ। স্ত্রী পুত্র কন্যা নিয়ে তাঁর আলো আঁধারি সংসার। সেখানে কায় ক্লেশ যেমন আছে,না পাওয়ায় বেদনা আছে আবার বকুলের মতো সংসারী লক্ষীমন্ত স্ত্রী আছে, ময়নার মতো বাপ- মা আকুল করা প্রাণ বুদ্ধিমতী মেয়ে আছে। অভাবের দাম্পত্যেও প্রেম খোলা জানালা দিয়ে হারিয়ে যায়নি। বরং বকুল সুগন্ধী হয়ে উত্তরোত্তর সুবাস ছড়ায় সনাতনের মনের বাগিচায় সেই ফুলশয্যার প্রথম দিনটির মতোই। হঠাৎ হঠাৎ জালে আটকানো সোনালী রঙের ডোরাকাটা বোয়াল মাছ বাজারে বিক্রি না করে সরষে বাটার রসা করে সবাই মিলে আনন্দ করে খাওয়াই শ্রেয় মনে করে মুহূর্তে বিশ্বাসী সনাতন মাঝি।
ভালো মন্দের দোলাচলের জীবনে চিন্তার ছায়া নেমে আসে ব্রীজ তৈরীর সময় থেকে। খেয়া পারাপার বন্ধ হয়ে যায়।মাঝিভাইদের লাগানো হয় ব্রিজের কাজে। কাজ শেষ হলে পারিশ্রমিকও শেষ। কঠোর সময় নেমে আসে। এরপর আটষট্টির সেই বিধ্বংসী বন্যা। তোলপাড় হয়ে যায় সবকিছু। জীবন,জীবিকা সব হারিয়ে কপর্দকশূন্য হয়ে পড়ে নদীর পাড়ের মানুষগুলি। সনাতন ঘোরতর আঘাতে কোমড়ের শক্তি খুঁইয়ে শয্যাশায়ী হয়ে পড়ে। ময়নাকে শহরে আয়ার কাজ নিয়ে চলে যেতে হয়। বকুল বাসাবাড়ির কাজ নেয়।
অল্পে সুখী সংসারটির চালচিত্র বদলে যায় এক নিমেষে। ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের খিদের কান্না অস্থির করে তোলে সনাতনকে।প্রিয়নাথ,যে ময়নাকে ভালোবেসেও নিজের আটকে থাকা দায়িত্ব পাশে তার জন্য কিছু করে উঠতে পারেনি, সে একসময় ফিরিয়ে আনে ময়নাকে,নিজের জীবনে বধূ রূপে বরণ করে নেয়। আবার দিন পাল্টায়। আশার আলো জাগে ছন্দপতনের জীবনে। বহুদিন পর আবার বকুলের গা থেকে বকুল ফুলের গন্ধ ভেসে আসে সনাতনের কাছে। পৃথিবীর সমস্ত সৌন্দর্য্য বকুলের মুখে দেখতে পায়। তাঁর আঁধার ঘরের আলোর দীপটি হয়ে যেন বকুল বসে আছে।
' তুমি পারবে মাঝি, নিশ্চয়ই পারবে। ঘাট না থাক,নৌকো না থাক। তোমার বকুল আছে, ময়না আছে। হাবুল,কাবুল, বাবুলের সঙ্গে প্রিয়নাথ আছে।পারতে তোমাকে হবেই।'
সনাতনের মনে হলো সে হারবে না। মাতলা হাওয়া কিংবা তুফান আসুক। তিস্তা নদীর মাঝি মাঝ দরিয়ায় হাল ছেড়ে পালিয়ে যেতে পারেনা....
এমন সদর্থক ভাবনায় গল্পটি শেষ হয়েও রেশ রেখে যায় অনেকখানি। রেশ থাকে নদীর, তুফানের,বৈচিত্র্য ভরা মাছেদের সংসারের, প্রকৃতির রূপ বর্ণনার,প্রাকৃতিক ভয়াবহতার,উত্তাল তিস্তার আর সবহারাদের ব্যাকুলতার। রেশ থাকে উত্তোরণের,আলোয় ফেরার, পুনরুত্থানের।
বইটি সংগ্রহ করে পড়লে অনন্য এক অনুভব হবেই হবে হলফ করে বলতে পারি।
বইওয়ালা প্রকাশনের এই বইটির মুদ্রক আনন্দ প্রিন্টার্স তাঁদের কাজ যথেষ্ট দায়িত্ব সহকারে পালন করেছেন। লেখকের বাবা ও দাদার অমর স্মৃতির উদ্দেশ্যে উৎসর্গিত এই বইটি সঙ্গে রাখবার মতো একটি অমূল্য সংগ্রহ। বেশ অনেকগুলো বছর পেরিয়েও লেখার গুণগত মানে সমকালীন এই বইটির আবার নতুন করে ঘুম ভাঙুক পাঠকদের হাত ধরে। পুনরুত্থান ঘটুক 'পুনরুত্থান' - এর।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴