অর্ণব সেন-এর আলোচনায় রণজিৎ কুমার মিত্র-র 'নজরমিনার'
অর্ণব সেন-এর আলোচনায় রণজিৎ কুমার মিত্র-র 'নজরমিনার'
'নজরমিনার' রণজিৎ কুমার মিত্রর প্রথম উপন্যাস। অন্যান্য শিল্পকর্মের তুলনায় উপন্যাস স্বতন্ত্র এই কারণে যে পাঠক এখানে জীবনকে বাস্তব রূপে দেখতে চায়। জীবনের গতিপ্রকৃতিকে বুঝতে চায়। এই বোঝাপড়ার মধ্য দিয়ে রনজিৎ 'নজরমিনারে'র মধ্যে যে শিল্পগত ঐক্য রক্ষা করেছেন। তাই নজরমিনারকে উপন্যাস আখ্যা দেওয়া যেতে পারে। মহাকাব্যের যুগ এখন আর নেই। অর্থ- সামাজিক পরিবর্তনের সাথে সাথে উপন্যাসের জীবনচিত্রন জটিল হয়েছে। বহু বিচিত্র শ্রেণীবিভক্ত সমাজে বহু বিচিত্র চরিত্রের সমাবেশে উপন্যাস হয়ে উঠেছে। একালের মহাকাব্য নিয়ে শুধু রেলাফ ফক্স নয় , এমনটাই ভেবেছিলেন অনেকেই। রনজিৎ কুমার মিত্রর 'নজরমিনার' এমন এক উপন্যাস যার পটভূমিতে রয়েছে কোভিদ: ২০২০- র ভারাক্রান্ত সময়ের এক খন্ড ইতিকথা। উপন্যাসের শুরুতেই তার ইঙ্গিত "আজ আমার( ২৭ -৩ -২০২০) সামাজিক দূরত্ব রক্ষার বোধ হয় পঞ্চম দিন.......... সারা বিশ্বে ২৪ হাজার মানুষ মারা গেলেন এ পর্যন্ত। ভারতবর্ষে আক্রান্ত ৭২৪ জন মৃত ১৭ জন।"
উপন্যাসটির রূপকল্প এবং প্রযুক্তিতে আছে বহু রকম পরীক্ষা নিরীক্ষা। আখ্যান ভাগের বর্ণনা রীতিতে তিনটি কৌশল আছে- এক: উত্তম পুরুষে বিবরণ। দুই: মধ্যম পুরুষে বর্ণনা। তিন: প্রথম পুরুষে (থার্ড পারসন) বর্ণনা পদ্ধতি। এই পদ্ধতিটি সবচেয়ে বেশি প্রচলিত। এখানে লেখক সর্বত্রগামী। সব চরিত্রের ভেতরের কথা তিনি জানতে পারেন। 'নজরমিনার' উপন্যাসে উত্তমপুরুষে 'আমি' বা 'আমার' দিয়ে আরম্ভ, তিনি 'নজরমিনার' থেকে সব দেখেন।"আমার ঘরের উল্টোদিকে ঘোষ বাবুর ছেলেরা তাদের পুরনো বসতবাড়ি ভেঙে ফ্ল্যাট বানিয়েছে, নাম দিয়েছে 'প্রফুল্ল কানন'। আমার দোতলার বারান্দায় বসে তিনটে পরিবারের মানুষজনকে ভালো দেখতে পাই। যারা ঠিক আমার দোতলার মুখোমুখি থাকেন। উঁচু পাঁচ তলা অব্দি আমার দৃষ্টি যায় না। বারান্দায় বসে থাকলে গলির সামান্য দূরত্ব পেরিয়ে বড় রাস্তা দেখা যায়। লোকজন, গাড়ি, টোটো, রিকশা, সাইকেল, স্কুটারে কত মানুষ আসে যায়। এসব বারান্দায় একা বসে দেখতে আমার খুব ভালো লাগে। সঙ্গে কেউ থাকে না ঘরে - বারান্দায় আমি একাই থাকি।" তাই নজরমিনারে বসে দূরবীন থাকে তার কাছে চারপাশটা দেখবার জন্য। ফোনির মাধ্যমে আমরা জেনে যাই ব্যক্তিটির নাম রথীন সেন। ১১ পাতার শেষ অনুচ্ছেদে বর্ণনা মাধ্যম বদলে যায় প্রথম পুরুষে। "রথীন ফোনটা রেখে দিয়ে আবার বারান্দায় এসে বসল।" গোটা উপন্যাসে রূপকল্প এবং প্রযুক্তির ক্ষেত্রে আখ্যান ভাগের বর্ণনারীতি নিয়ে যথেষ্টই দক্ষতার পরিচয় দিয়ে ঘটনা ও চরিত্রগুলিকে একেবারে শেষ পর্যন্ত টেনে নিয়ে গেছেন উপন্যাসিক রনজিত শুধু তাই নয় চেতনা প্রবাহ রীতিকেও কাজে লাগিয়েছেন। উপন্যাসটির স্থান- কাল- পাত্র যথাযথ ভাবে চিহ্নিত। ফান তিস্তা তীরবর্তী এলাকার শহর জলপাইগুড়ি এবং কুমলাই জলঢাকা পাড়ের হুসলুডাঙ্গা। তপেশের ভাই দীপেশকে কেন্দ্র করে উপন্যাসের আখ্যানের সঙ্গে হুসলুডাঙ্গার সংযোগ। করোনার ভাইরাসের সঙ্গে হুসলুডাঙ্গাতে ও লোভ-লালসা ক্ষমতা দখলের নানা সংক্রমণ, সেসবের সাথে লড়াই করতে গিয়ে দীপেশ আক্রান্ত হয়। করোনা ভারাক্রান্ত পৃথিবীর একটা ছোটখাটো চলচ্ছবি তুলে ধরা হয়েছে উপন্যাসটিতে, বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত নানা ঘটনার সূত্রে , যা সামাজিক দলিল হয়ে থাকতে পারে আগামী দিনে করোনার সংক্রামিত জীবনের ছবি খোঁজ করতে হলে এই উপন্যাসটির অবশ্যই ডাক পড়বে। উপন্যাসের শুরু করোনা আক্রান্তর খবর দিয়ে শেষ ভ্যাকসিন এর হাহাকার নিয়ে। উপন্যাসের শেষ পর্বে মহাকাব্যিক ট্র্যাজিক ছায়া। মহাভারতের মৌষল পর্ব চলছে।" সময়ের অতলে ডুবে যেতে যেতে রথীন উত্তর খোঁজার চেষ্টা করলো,' বিষাদযোগ' থেকে নিস্তার কোথায়? হস্তিনা নগরী থেকে অনেক দূরে এক মফস্বল শহরের গলির মধ্যে দোতলার অন্ধকার বারান্দায় বসে থাকা নিঃসঙ্গ বরিষ্ঠ এক নাগরিক ভাবছে এই যুদ্ধে সে কোন পক্ষ নেবে, তার অস্তিত্বের ভূমিকায় বা কতটুকু? কুরুক্ষেত্রের অন্ধকার তার বারান্দাতেও নামছে।" করোনা কালের হতভাগ্য নায়ক রথীন সেন মহাকাব্যের নায়ক হতে পারেন না, তবে উপন্যাসের নায়ক হতে পারেন।
______________________________________
নজরমিনার: রণজিৎ কুমার মিত্র। জলপাইগুড়ি, চিত্রা পাবলিকেশন, ২০২১।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴