অর্কেষ্ট্রা/শ্রাবনী ভট্টাচার্য্য
অর্কেষ্ট্রা
শ্রাবনী ভট্টাচার্য্য
সুমনা, ও সুমনা মা, উঠে পড় মা। দেখো ভোর হয়ে গেছে। আমার স্নান করে আহ্নিকে বসার সময় হল।এবার তুমিও উঠে রেওয়াজে বসো। এই তো সঙ্গীত চর্চার উপযুক্ত সময়। স্বর্গের দেব দেবীরাও নাকি এই সময় মর্ত্যে ভ্রমণ করতে আসেন। ওঠো, উঠে ভৈরবী রাগের আলাপ ধরো। - এই বলে কমলেশবাবু, সুমনার বাবা, ধুতি পরে পুজোর ঘরে গিয়ে ঢোকেন। সুমনার কানে আসে সূর্যার্ঘের মন্ত্র "ওম জবা কুসুম শংকাশম্"। সুমনা দ্রুত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে হারমোনিয়ামটা নিয়ে বসে যায় গানের ঘরে । ভৈরবীর আলাপ তখন সুমনার গলায়।সারা চক্রবর্তী বাড়িতে তখন স্বর্গীয় পরিবেশ। সুমনার মা মালিনী সবজি কাটছেন নিবিষ্ট মনে। কমলেশবাবু আটটার মধ্যে খেয়ে বেরিয়ে যাবেন।
সুমনা, এ্যাই সুমনা ওঠ মা। মায়ের ক্ষীণ গলা ভেসে আসে দরজার বাইরে থেকে। উঠে পর মা। রান্না বান্নাটা সেরে নে। আজ তো আবার তোর জলসা আছে। ঠাকুর! আমার কি অবস্থাটাই না করেছ। দু পা হাঁটতে গেলেও বুকে হাঁপ ধরে যায়। এই মেয়েটা আর কত করবে! বলতে বলতে গলা বুজে আসে মালিনীর।
ঘুম থেকে উঠে বাসি ঘর ঝাড় দিতে দিতে আজ সকালের স্বপ্নের কথাই ভাবছিলো সুমনা। মায়ের ঘরে টানানো বাবার ছবির দিকে তাকিয়ে সুমনা ভাবে তার বাবা কমলেশবাবুর হঠাৎ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত এগুলো তো সবই সত্যিই ছিল।আসলে হঠাৎ কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ার শকটা বাবা নিতে পারেনি। একদিন বান্ধবীর বাড়ি থেকে এসে সুমনা দেখে বাড়ির সামনে প্রচুর লোক। তার বাবা নাকি অসুস্থ। হসপিটালে নিয়ে যেতে যেতেই সব শেষ। কটা জেলা শহরের হাসপাতালেই বা হৃদরোগের চিকিৎসার ব্যবস্থা আছে!!
মাকে চা করে দিয়ে আনাজপত্রের ঝুড়িটা নিয়ে কুটনো কাটতে বসে সুমনা। বারবারই আজ তার মনে হচ্ছে বাবার কথা। কি গান পাগল ছিল লোকটা! নিজেও গাইত ভালো। সুমনার গানের তালিম শুরু হয়েছিল সেই ছ বছর বয়সে। শুক্রবার করে সন্ধে বেলায় মাষ্টারমশাই বাড়িতে আসতেন। আর আসত বাবার অভিন্ন হৃদয় বন্ধু রবীন সান্যাল। খুব ভালো তবলা বাজাত রবি কাকু। কোন কোন সন্ধ্যায় বাড়িতে গানের আসর বসে যেত যেন। সুমনা গাইত "ক্যা করু সজনী/আয়েনা বালোমো" আবার কখনো বা "জোছনা করেছে আড়ি/আসেনা আমার বাড়ি"। আজ বড় বেশি করে মনে পড়ছে সুমনার তার মিস মোনা হয়ে ওঠার আগের দিনগুলোর কথা। স্কুলে গানের জন্য কি সুখ্যাতিই না ছিলো সুমনার। সব অনুষ্ঠানে শর্বরী ম্যামের ভরসা ছিল সুমনার গান। আর ছিলেন কৌশিক স্যার। কি যত্ন করেই না রবীন্দ্রসঙ্গীত শিখিয়ে দিতেন। স্যারের তত্বাবধানে কতো নৃত্য নাট্যেই না গান করেছে সুমনা। ব্রাহ্মণ, অভিসার, চন্ডালিকা, তাসের দেশ। কৌশিক স্যারের কাছে রবীন্দ্রনাথের জীবনের নানা কথা শুনতে শুনতে কিশোরী সুমনাও উচ্চমাধ্যমিক পাশের পর গান নিয়ে বিশ্বভারতী অথবা রবীন্দ্রভারতীতে গান নিয়ে পড়াশুনো করার স্বপ্ন দেখত।বতারপর স্কুল বা কলেজে সঙ্গীত শিক্ষকতার চাকরি! সঙ্গীতময় একটা জীবন।মনে পড়ে যায় কৌশিক স্যার একবার তার মাথায় হাত রেখে বলেছিল, গানটা ছাড়িস না সুমনা।রবীন্দ্রসঙ্গীত তোর গলায় দারুণ খোলে। চোখের জল চোখেই চেপে কোনরকমে সুমনা বলে ওঠে, "আমি গান ছাড়িনি স্যার!" হঠাৎ বেজে ওঠে সুমনার মোবাইল ফোনটা। ওপর প্রান্তে ভেসে আসে স্যান্ডির গলা। "মোনা ডারলিং আজ একটু হট হয়ে এসো প্লিজ। আজকের প্রেজেনটেশনটা খুব ভাইটাল" "আসবো" বলে দ্রুত ফোনটা কেটে দেয় সুমনা।তারপর দাঁতে দাঁত চেপে রান্না করে, জামাকাপড় কাচে, ঘর মোছে, বাসন মাজে।
উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের আগেই কমলেশবাবুর মৃত্যু সুমনার সব স্বপ্ন তছনছ করে দেয়। তবু মায়ের ইচ্ছেতে বাবার অফিস থেকে পাওয়া সামান্য কিছু টাকা আর মায়ের টিউশনির কয়েকটা টাকায় কলেজে ভর্তি হতে হয় সুমনাকে অন্ততপক্ষে বি এ টা পাশ করার জন্য। বিয়ের বাজারে বি এ না পাশ করলে মেয়েদের দাম কমে যায় কিনা! কলেজের নবীন বরনের অনুষ্ঠানেই আলাপ সন্দীপ দা ওরফে স্যান্ডির সাথে। নবীনবরণের সুমনার গানের উচ্ছ্বাসিত প্রশংসা করেছিলেন উপস্থিত অধ্যাপক, অধ্যাপিকারা। তার বন্ধুরাও আনন্দ পেয়েছিল খুব। কিন্তু তারা বোধহয় আরো বেশি কিছু চাইছিলো। আরো ঝিনচ্যাক কিছু। যাতে বেশ নাচা যায়। কিন্তু শিক্ষক শিক্ষিকাদের উপস্থিতিতে তারা সেটা করে উঠতে পারে নি।সুমনাদের সংসার যে কিভাবে চলে তা বেশ ভালোই জানতো স্যান্ডি। তাই একদিন সুযোগ পেয়ে ড্রামার স্যান্ডি সুমনাকে তাদের অর্কেষ্ট্রা পার্টিতে গান গাওয়ার অফারটা দিয়েই ফেলে। প্রথমে রাজি না হলেও পরে দারিদ্র্যের কাছে মাথা নত করে সুমনা।স্যান্ডির প্রস্তাবে রাজি হয়। সদ্য তরুণী, সুশ্রী সুমনা ভেবেছিল অর্কেষ্ট্রা পার্টিতে গান গাওয়া এমন কি আর কঠিন কাজ! কিন্তু গান গাইতে এসে বুঝলো এখানে শুধু গান গাইলেই হয় না। তার সাথে ছাড়তে হয় অনেক কিছু। অনেক কিছু মানিয়ে নিতে হয় নিজের ইচ্ছে ও রুচির বিরুদ্ধে।অর্কেষ্ট্রা পার্টির বেশিরভাগ শ্রোতা উন্মত্তের মতো নাচতে চায় শুধু। সঙ্গীত সুধা পান করতে চায় না। কারণ তারা আগের থেকেই মাতাল। ষ্টেজের ঝলমলে আলো, নানান যন্ত্রের উত্তেজক আওয়াজ মাত করে দেয় শ্রোতাদের। অর্কেষ্ট্রা পার্টির নাম যতো ছড়াতে থাকে ততো ছোট হয় সুমনার পোশাক। মাঝে মাঝে তো অনুষ্ঠান আয়োজকদের মধ্যে দাদা টাইপের লোক ষ্টেজের মধ্যে উঠে আসে।জাপটে ধরতে চায় সুমনাকে। ঘেন্নায় গা গুলিয়ে আসে সুমনার।তখনই মনে পড়ে যায় মায়ের হার্টের অপারেশনটা করাতেই হবে। আরো চটুল হয় সুমনা। টাকা চাই আরো টাকা।
সেদিনের ফাংশনটা ছিল একটু অন্য রকমের। কোন এক উঠতি নেতা ভোটে জিতেছে।তাই শহরের উপকন্ঠে একটা বাগানবাড়ি মতো জায়গায় বসবে গান বাজনা খানা পিনার আসর। নেতা দাদার ছেলেদের আব্দার। সেখানেই ডাক পড়েছে সুমনাদের অর্কেষ্ট্রা পার্টির।আজ তাই একটু বেশিই হট সাজতে হয়েছে সুমনাকে। উর্দ্ধাঙ্গের খোলামেলা পোশাক থেকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে ক্লিভেজ। হট প্যান্টের নীচ থেকে দৃশ্যমান ওয়াক্সিং করা নিটোল ঊরু। সন্ধে থেকেই জমে উঠেছে পার্টি। যত রাত বাড়ছে,উন্মত্ততা বাড়ছে ততো। খোলা মঞ্চের চারদিক দিয়ে উঠে আসছে মাতাল যুবকদের দল। 'এক বিড়ি জ্বালাইদে,জিগর মে পিয়া" সুমনাকে জড়িয়ে ধরে চুম্বন করছে দাদার ছেলেরা।জাপটে ধরছে, হাত দিচ্ছে নিতম্বে, স্তনে।নেতা দাদা ওঠেন একেবারে শেষে।ফাংশন তখন প্রায় প্যাক আপ। বেহেড মাতালের দল পড়ে আছে এখানে সেখানে। নেতা দাদা নেশার ঘোরে সুমনাকে টানতে টানতে নিয়ে যায় একটা ঘরে। স্যান্ডিরা বাঁধা দেওয়ার চেষ্টা করেছিল।তবে অর্কেষ্ট্রা পার্টির ভবিষ্যৎ আর নেতা দাদার আর্থিক আনুকূল্যের কাছে সেই প্রতিরোধ ছিল সামান্য।
কিছুক্ষণ পর বিধ্বস্ত সুমনা টলতে টলতে বাইরে বেরিয়ে আসে।সারা শরীরে নরপশুর কামড়ের দাগ।সে ব্যাগ থেকে গা ঢাকা গোল লম্বা কূর্তিটা বের করে পরে নিয়ে স্যান্ডিকে শুধু বলে,"বাড়ি পৌঁছে দাও আমাকে"। গভীর রাতে নিঃশব্দে ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে গেট খুলে বাড়ি ঢোকে সুমনা।মা শুয়ে পড়েছে।ঘুমের ওষুধ খাওয়া ঘুম, ভাঙে না সহজে। টেবিলের উপর ঢাকা দেওয়া তার রাতের খাবার।কোনদিকে না তাকিয়ে বাড়ি পরার নাইটি টা আলনা থেকে কোন রকমে নিয়ে বাথরুমে যায় সুমনা।বেসিনে গিয়ে অনেকটা বমি করে। তারপর শাওয়ারের নীচে দাঁড়িয়ে স্নান করে সুমনা।অনেকক্ষন।স্নান করলে কি শরীর আর মনের ক্লেদ ধুয়ে যায়?স্নান সেরে চুপি চুপি মা'র ঘরে ঢোকে সুমনা। ওষুধের বাক্স থেকে দুটো ঘুমের ওষুধ নেয়। নিজের ঘরে এসে ওষুধ দুটো খেয়ে নেয়। টেবিলে রাখা বাবার ছবিটা হাতে তুলে নিয়ে বিছানায় উঠে লাইট বন্ধ করে দেয়। নিঃশব্দে কাঁদতে থাকে সুমনা বাবার ছবিটা আঁকড়ে ধরে।কতক্ষন কে জানে! চোখ দুটো ঘুমে জড়িয়ে আসে। বাইরে বোধহয় বৃষ্টি নেমেছে।অস্ফুটে গাইতে থাকে সুমনা "যে রাতে মোর দুয়ারগুলি ভাঙলো ঝড়ে/জানি নাই তো তুমি এলে আমার ঘরে"।
আস্তে আস্তে ঘুমিয়ে পড়ে সুমনা। আজ একটু বেশিক্ষণ ঘুমোবে সে। একটু বেশিক্ষণ।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴