অরণ্যে কিছুক্ষণ/অতনু চন্দ
অরণ্যে কিছুক্ষণ
অতনু চন্দ
---------------------
খুব বেরসিকও হয়তো অরণ্যের হাতছানি উপেক্ষা করতে পারে না! গভীর অরণ্যের মধ্যে একটা গা ছমছম করা সৌন্দর্য্য ও ভয়ের মাখামাখি পরিবেশ থাকলেও সে ভয়কে সহজেই উপেক্ষা করে অরণ্যের সে সৌন্দর্য্য দেখার ও উপলব্ধি করার গভীর আগ্রহ যেন ভেতর থেকে আসে।
এমনিতে বাগানিয়া হওয়ার সুবাদে শৈশব থেকেই নীরব প্রকৃতিপ্রেমি। স্বাভাবিক ভাবেই অরণ্য সম্পর্কে বেশ কিছুটা ভালোবাসা ও কৌতুহল মনে সব সময়ই ছিল এবং আছে। মালবাজার দমকলে চাকরির সূত্রে থাকাকালীন অনেক সময়েই জলপাইগুড়ির ডিভিশনাল অফিসে পৌঁছনোর জন্য লাটাগুড়ি অরণ্যের মধ্যে দিয়ে রাতবিরেতে যাতায়াত করতে হত। স্বাভাবিক কারনেই এই অরণ্যের কিছুটা ভেতরে গিয়ে এই অরণ্যের শোভা দেখার একটা সুপ্ত বাসনা ছিল। হঠাৎ করেই "বনদেবীর" পূজো উপলক্ষ্যে সে সুযোগও ঘটে গেল।
আদিবাসী যারা অরণ্য লাগোয়া স্থানে বসবাস করেন, সাধারণত তারাই বনদেবীকে তুষ্ট করার জন্য এই পূজো করে থাকেন। আমার এক আদিবাসী সহকর্মীর বাইকে নির্দিষ্ট দিনে সকাল সকাল আমরা লাটাগুড়ি যাওয়ার রাস্তায় "মহাকালের" থান পর্যন্ত গিয়ে তার ভেতর দিয়ে সরাসরি ঢুকে পড়লাম এবং দু'জনে "মহাকাল বাবাকে" পূজো দিয়ে বনের মধ্যে এগুতে থাকলাম। তখন অবশ্য বড় রাস্তার সমান্তরালেই "মহাকালের" থান ছিল। এখনকার মতন নামা ওঠার সিঁড়ি এবং সাজানো গোছানা এমন দর্শনীয় স্থান হয়ে ওঠেনি। লোকমুখে প্রচলিত যে পাশের ঝোরা থেকে হাতিরা (অবশ্য অরণ্যে হাতিকে সবাই মহাকালই বলে) শুঁড়ে করে জল নিয়ে জাতীয় সড়কের ধারে গাছের নিচে পরে থাকা কয়েকটা বড় শিলায় নাকি জল ঢালত! সেখান থেকেই এই পুজোর প্রচলন — তবে সত্যি মিথ্যে জানি না!
যাই হোক, আমরা ওখানে এক জায়গায় বাইকটা রেখে অরণ্যের মধ্যে লাঠি হাতে পায়ে পায়ে এগুতে লাগলাম। পায়ের চাপে পিষ্ট শুকনো পাতা ফুল-ফল যেন আর্তনাদ করে উঠল। তার শব্দে যে বনের নানান ধরনের পাখি উড়ে বেড়াতে লাগল, ছোট ছোট জন্তু জানোয়ার পালাতে লাগল, তা বেশ অনুভব করলাম। তবে সুন্দর বুনো গন্ধ আমাদের যেন আচ্ছন্ন করে ফেলল নিমেষেই। লাঠি দিয়ে যতটা সম্ভব বুনো লতাপাতা সরিয়ে এগুতে থাকলাম চলার মতন রাস্তা তৈরি করে। তা সত্ত্বেও গা হাত পা কোথাও কোথাও কেটে ছোঁড়ে গিয়ে জ্বালা করতে লাগল। এদিকে পায়ের কাছ দিয়ে আশপাশ দিয়ে কিছু যেন চলে যাচ্ছে বা দৌড়ে যাচ্ছে তা বেশ বুঝতে পাচ্ছি। আর ভয় পাচ্ছি সাপের। আমার আদিবাসী সহকর্মীর কিন্ত সেদিকে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। চারিদিকে কতরকমের অজানা ফুল-ফল পাখি-গাছ আমাকে এতটাই আকৃষ্ট ও মুগ্ধ করে রেখেছে যে ভয় ভুলে অবাক বিস্ময়ে আদেখলার মতন এগিয়ে চললাম তা দেখতে দেখতে।
অবশেষে কিছুটা ফাঁকা জায়গায় ক'য়েকজন আদিবাসী সম্প্রদায়ের নারী-পুরুষকে দেখলাম পূজোর ও রান্নার সামগ্রী নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন আমাদের অপেক্ষায়! ওনাদের সঙ্গে এগিয়ে চললাম আরো কিছুটা। পূজোর আয়োজন সম্পূর্ণ হলে, আদিবাসী নিয়মকানুন মেনে অদ্ভূত সুন্দর লোকাচারে পূজো আরম্ভ হলো। এরকম বন্য প্রাকৃতিক পরিবেশে ধূপধুনোর গন্ধে, মন্ত্র উচ্চারন ও তার ছন্দে যেন এক অদ্ভুত মায়াবী পরিবেশ সৃষ্টি করল! এদিকে কয়েকজন আদিবাসী ভাই তীর-ধনুক ও টিনের বাক্স হাতে নিয়ে সজাগ দৃষ্টি রেখে চারিদিকে পায়চারি করে পাহারা দিচ্ছিলেন আমাদের সকলের নিরাপত্তার কথা ভেবে! এমনিতেই সূর্যের আলো এখানে কম, তায় বেলা বাড়ার সঙ্গে তাল রেখে সূর্যর আলো যেন হয়ে পড়ল আরো ক্ষীণ। পুজো হলে আমরা সকলে লাইন করে বসে কলার পাতায় ফলমূল ও খিঁচুড়ি প্রসাদ খেতে খেতে মশগুল হয়ে পড়লাম বনের বিষয়ে নানান আলোচনায়। তারপর সন্ধ্যায় বনববস্তির কিছু আদিবাসীর সাথে দেখাসাক্ষাৎ করে, লবন দেওয়া লাল চা ও মকাই রুটি খেয়ে, রাতের দিকেই অফিসের দিকে পা বাড়ালাম ।
রাতের অরণ্যের রূপ তো আরো অপূর্ব, বিশেষ করে পূর্ণিমার রাতে। অফিসের বিশেষ কাজে যখন জলপাইগুড়ি ডিভিশনাল অফিস থেকে ফিরেছি—হয়ত কোন কারনে ফিরতে দেরি হয়েছে—অথবা বেশ রাতে কোন "Fire Call" পেয়ে এই অরণ্যের মধ্যে দিয়ে যেতে গিয়ে আমাদের ফেরার পথে “Fire Tender”-এর "Fuel Tank" Air-নিয়ে নেওয়াতে, এই অরণ্যের মাঝখানে ঘন্টার পর ঘন্টা গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে থেকেছি। কখনও বা হাতি বা বাইসনের (Gaur) পালের মুখোমুখি হয়ে দাঁড়িয়ে থেকেছি। Headlight এর আলোতে ওদের জ্বলন্ত চোখ দেখে আগুনের থেকেও বেশি ভয় পেয়েছি। তবে সে ভয় পুষিয়ে দিয়েছে যখন দেখেছি, আমাদের গাড়ির শব্দ পেয়ে হঠাৎ করে কয়েকটা হরিণ (Jumping Deer) পরপর লাফিয়ে রাস্তা পার হচ্ছে। রাতের অন্ধকারের অরণ্য যে কি ভয়ংকর রকমের সুন্দর তা যে না দেখেছে তাকে বোঝানো যাবে না কারন সে বর্ণনা দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমি আমার পঞ্চেন্দ্রিয় দিয়ে শুধু তা অনুভব করেছি মাত্র! যদি দূর থেকেও বন্যপ্রাণীদের চলা ফেরা দেখা যায়, সে তো বিরল এবং অসাধারণ দৃশ্য। কথায়ই আছে, "বন্যেরা বনে সুন্দর, শিশুরা মাতৃক্রোড়ে"।
এখন যখন সপরিবারে যাই এই রাস্তা দিয়ে, সকলে খুব দুঃখ পাই যখন দেখি পরপর সব গাছ কেটে পিল দিয়ে রেখেছে অথবা অরণ্যের বুক চিড়ে Flyover হয়েছে দেখে। মনে প্রশ্ন জাগে, নগর সভ্যতার কিছুটা সুখ সুবিধা সাচ্ছন্দের জন্য, এর কি খুব প্রয়োজন ছিল?!
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴