অরণ্যে একটি রাত/দেবাশীষ বক্সী
অরণ্যে একটি রাত
দেবাশীষ বক্সী
বৃষ্টিস্নাত নেওরা প্রজেক্ট ক্যাম্পের বনবাংলো সহ বিস্তীর্ণ জঙ্গল। এখন ভোর পাঁচটা পঁচিশ মিনিট। ছিপছিপে বৃষ্টিতে কটেজ থেকে বেরিয়ে বন বাংলোর ওয়ার্চ টাওয়ারে এসে বসেছি। জনমানবহীন নিস্তব্ধ নীরব চারিধার। অন্যরা কটেজে গভীর নিদ্রায় মগ্ন। এমনকি বন বাংলোর কেয়ারটেকার সহ কর্মচারীরা ডর্মেটারির নিচে কাঠের ঘরটিতে পর পর মশারি টাঙিয়ে অঘোরে ঘুমিয়ে রয়েছে।
অবশ্য তার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। গতকাল গভীর রাত থেকে ঘন ঘন বজ্রবিদ্যুৎ সহ প্রচন্ড বৃষ্টি হয়েছে। বজ্রপাতে ট্রান্সফরমার বিকল হয়ে যাওয়ায় কারেন্ট চলে গিয়েছিল গভীর রাতে। ঘুটঘুটে গহীন আঁধার নেমে এসেছিল চারিধারে। সেই আঁধারে আমরা কয়জন। এ এক অন্য ধরনের উত্তেজনা, উদ্দীপনা বা অভিজ্ঞতা। গুমোট গরম। সাথে ছেলেপুলে রয়েছে। একটু শীতল বাতাসের প্রত্যাশায় পোকা মাকড়ের ভয় কে উপেক্ষা করে, ঘরের সকল জানালা খুলে দিই। আহা সে এক অপরূপ দৃশ্য। অনেকদিন পর জোনাকি পোকা দেখলাম। কুচকুচে কালো অন্ধকারে মৃদু আলোর বিচ্ছুরণ, জমে থাকা জলে জোনাকির প্রতিবিম্বন অরণ্যকে অলঙ্কারে অলঙ্কৃত করে তুলেছে। বুকে পিদীম জ্বেলে বনদেবীর আরাধনায় তারা বুঝি নিমগ্ন। কোন যাদুবলে কৃষ্ণ বনভুমি মায়াকাননে রূপান্তরিত হয়েছে। পথ ভুলে দু একটি জানালা দিয়ে প্রবেশ করে কুশল বিনিময় করে গিয়েছিল। পিছনের ডোবায় ব্যাঙ ডাকছে, ঝিঁঝিঁ ডাকছে, গাছের ফাঁকফোঁকর দিয়ে ঠান্ডা বাতাস গায়ে লাগছে, রাতজাগা পাখি হুসহাস উড়ছে । প্রকৃতির এই আদিম সৌন্দর্য্য আমার অন্তর অন্তরীক্ষকে কল্পমেঘে আচ্ছন্ন করে তুলেছিল।
ঘুম সেইভাবে কারোই হয়নি। রাত শেষের মিঠে হাওয়ায় তাই সকলে অকাতরে ঘুমিয়ে পড়েছে। কল্পনার জগতে অতিরিক্ত সময় ব্যায় করায় আমি বোধকরি কিছুটা ক্লান্তিহীন। তাই প্রকৃতিকে আরো কাছ থেকে দেখবো বলে সকাল পাঁচটায় উঠে পড়েছি।
ওয়ার্চ টাওয়ার থেকে নীচে বিস্তীর্ণ বনভূমি সারা রাতের বৃষ্টিতে চুপসে রয়েছে। পাশে ডোবাগুলি হতে ব্যাঙের ডাক ভেসে আসছে। ডাহুক, ঘুঘু,কাঠঠোকরা সহ আরো কতশত লাল, নীল, হলুদ রঙা পাখি দিনের শুরুতে প্রিয়জনকে কাছে পেয়ে গাছের ডালে গালগল্পে মগ্ন। জঙ্গলে অন্য কোন জন্তুর উপস্থিতে কটেজের আশপাশে ময়ূরের দল, বানরের দল রহস্যালাপে ব্যস্ত। ওয়ার্চ টাওয়ারের উত্তর থেকে পশ্চিম দিক ধরে কুলকুল ধ্বনিতে বঁয়ে চলেছে নেওরা নদী। বর্ষার প্রারম্ভে বুক ভরা তার জলরাশি। তিরতির করে ঠান্ডা বাতাস বইছে। এত মনোমুগ্ধকর দিনের শুরু স্মরণকালে মনে পড়ে না।
গতকাল রাতে ডিনারের পর এই ওয়ার্চ টাওয়ারেই বসেছিলাম। রাত্রি প্রায় দশটা থেকে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি শুরু হয়েছিল। জঙ্গল জুড়ে একটানা চলছে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক । রাতজাগা পাখির ডানা ঝাঁপটানো শব্দ ও তাদের বিচিত্র ডাক, অচেনা পশুর যাওয়া আসায় জঙ্গলের সরসর শব্দ এক রহস্যময় পরিবেশের সৃষ্টি করেছিল। গভীর জঙ্গলের ভিতর এই বনবাংলোর চৌহদ্দিতে হামেসাই নাকি বন্য হাতি, বন্য শুয়োর, বাইসন, লেপার্ডেরা ঘোরাঘুরি করে। রাত গড়িয়ে যাচ্ছে। প্রকৃতির এই অচেনা রূপকে কাছ থেকে দেখার বাসনায় ইচ্ছে করছিল সারাটা রাত এখানেই কাটিয়ে দিই। সত্যিই ইচ্ছে ছিল। তবে পরিবারের সদস্যরা রে রে করে উঠেছিল। কড়া হুকুম দিয়ে সবাই চলে গেলেও, ছেলে ও ভাগ্নে(রাজা বেটা) আমার সাথেই থেকে গেল। বৃষ্টি ধীরে ধীরে বাড়ছিল। শ্রেষ্ঠ ও রাজার হাতে টর্চ। গভীর জঙ্গলে ওদের টর্চের তীব্র আলো ঘোরাঘুরি করছে। হঠাৎ টর্চের আলো একটি নিদিষ্ট জায়গায় থেমে যায়। ছেলে ফিসফিসিয়ে বলে বাবা দেখ দেখ ঝুপসি জঙ্গলটা কিভাবে দাপাদাপি করছে। রাজাও নাকি দেখেছে কালো রঙের কিছু একটা উপরের গাছের ডাল থেকে সেই জঙ্গলে ঝাঁপিয়ে পরতে। হ্যাঁ, কিছু একটা যে রয়েছে, ঝোঁপের আন্দোলনে সহজেই বুঝতে পারলাম। এমন সময় একটি বার্কিং ডিয়ার ডেকে ওঠে আমাদের খুব কাছে। আবার ডাকে। রাতচরা পাখির সহসা ওড়াওড়ি এবং জঙ্গলের মাঝে খসখস শব্দের হিল্লোলে রহস্যঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়। মনে হল নিরীহ পশুরদল কারো আগমনের ভয়ে এদিক ওদিক লুকিয়ে পরতে লাগলো। অতি উৎসাহিত মনে হলেও ছেলে দুটি মুখমন্ডলে দুশ্চিন্তা ছায়া লক্ষ্য করলাম। কারন যা কিছু ঘটনা ঘটছে সবই আমাদের অতি নিকটে। বেশ কিছুটা সময় নিস্তব্ধতা বিরাজ করলো। আচমকা একটি মৃদু খক্ করে ডাক, পরক্ষনেই আবার, এবার আরো নিকটে। এরপর কয়েক মিনিটের জন্য নিঝুম ঘুমে ঘুমিয়ে পড়ল অরণ্য। অকস্মাৎ খুব কাছেই ঝুপ একটি শব্দ শোনা গেল। তারপরই রক্তহীম করা একটি নাদ। ক্রমশ কাছে এগিয়ে আসছে। আমাদের মুখে কোন কথা নেই, শ্রেষ্ঠ ও রাজার গরম নিঃশ্বাস আমার ঘাড়ে পরছে। তিন জনের জড়োসড়ো অবস্থা। পুনরায় বেশ কিছুক্ষন চুপচাপ। একটি পেঁচা কর্কশ স্বরে বিশ্রী ভাবে ডেকে উঠলো। এক ঝাঁক বাদুড় গা ঘেসে উড়ে গেল। রাজাবেটা ভয়ার্ত ফ্যকাসে গলায় বলে, “মেসো, লেপার্ড”। হঠাৎ করেই দমকা বাতাস বইতে থাকে। টিনের চালে শুরু হয় বড় বড় বৃষ্টির দানা। বেশ কয়েক মিনিটের নীরবতা ভেঙে শ্রেষ্ঠ অস্ফুট কাঁপা কন্ঠে ফিসফিসিয়ে বলে, “বাবা, অনেক হয়েছে, এবারে ঘরে চলো।”
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴