অরণ্যকে পেয়েছি মায়ের মতন/বেলা দে
অরণ্যকে পেয়েছি মায়ের মতন
বেলা দে
উত্তরবঙ্গের ডুয়ার্স জুড়ে যেদিন শুধুই অরণ্য, সে দশকে চোখ খুলে অরণ্যকে পেয়েছি চারপাশ ঘিরে ঠিক মায়ের মতো করে। হিংস্রদের সহবাসে কেটেছে সমস্তদিন, নিশুতি রাতে গৃহপোষ্যদের বাঁচার করুণ আর্তনাদ, প্রায় প্রতিরাতে লেপার্ডের হামলা, দিনে খড়বিচালির মশাল তৈরি করে রেখেছে গৃহস্থেরা আর টিনের ঘর প্রায় প্রতিটি পড়শীর, বাজনার কাজ করেছে। ছেলেবেলায় স্বচক্ষে দেখা, জনপদঘিরে যত্রতত্র ইচ্ছেগাছ আকাশচুম্বী মহীরুহ ছড়িয়ে ছিটিয়ে, বিদ্যুৎহীন জনপদে দিবাসূর্যের দেখা মিলেছে মাথায় গলছে যখন। সিংহভাগ স্বজনেরা সেদিন বাগিচাকর্মী, মামাবাড়ি মাসিবাড়ি। ছুটিছাটা হলেই বাগান আর বাগান মানেই জঙ্গল জড়ানো। পরবর্তীতে বৌদিরাও এসেছে সবাই চা বলয় থেকে, সেজবৌদি কলেজে আমার সহপাঠী ছিল একবার গ্রীষ্মের ছুটিতে সিংহানিয়া চা বাগানে তার সাথে গিয়ে মনস্থ করি গোপালপুর চা বাগানে মেজবৌদির বাপের বাড়িতে যাব, বাগান পেরিয়ে জঙ্গলের পথ ধরি আমি, বৌদি তার দুই বোন, মানা করেছিল বৌদির দাদা আগের দিন নাকি বাগানে লেপার্ড ঢুকেছিল। তখন অল্প বয়স আমরা সবাই কলেজ ছাত্রী স্বভাবতই আবেগ উন্মাদনা একটু বেশিই! সেসময় তার কথা না শুনেই শর্টকাট রওনা হলাম। কিছুদূর যাওয়ার পর পাখিদের কিচকিচ ডানা ঝাপটানো, অভিজ্ঞ বৌদির বোন বলে ওরা কিছু একটা দেখেছেই। সবার সতর্ক চোখ ঘুরছে, এর মধ্যেই ছোট বোন বলে ওই যে হাতি! সে তখন শাবক আদরে ব্যস্ত পিছন ঘুরে। নি:শব্দে এগোতে থাকি হামাগুড়ি দিয়ে একসময় মাঠ ধরে দুদ্দাড় দৌড়ে একেবারে গোপালপুরে লেবার বস্তিতে। ওরাই আমাদের কোয়ার্টার পর্যন্ত এগিয়ে যেতে সাহায্য করল। ফেরার বেলায় আর নৈব নৈব চ, ঘুরপথে বীরপাড়া হয়ে সিংহানিয়া ফিরি। পরের দিন রামঝোরা চা বাগানে বৌদির ভাগ্নের জন্মদিনে গেলাম দলবেঁধে, রাতে নিমন্ত্রিতরা চলে গেলে বাড়ির সদস্যেরা খেতে বসব। সো সো দুমদাম শব্দ, ক্রমশ বেড়েই চলেছে সে শব্দ কি ভয়ংকর যে বলে বোঝানো সম্ভব নয়। চালে পড়ছে সুপুরি, আম, জাম, কাঠাল ও কলাগাছ, কাঁপছে যেন ঘর। জানালার ফোঁকরে চোখ লাগিয়ে দেখি ১৫/১৬ টা হাতির একটা দল ঘিরে রয়েছে রান্নাঘর, আমরা তখন শোবার ঘরে আলো নিভিয়ে, নি:শব্দে খাটখানা জুড়ে দিল উৎপলদা দরজায় (বৌদির জামাইবাবু)। আতঙ্কে কাঁপছি সবাই ভেবে নিয়েছি আর বেঁচে ফিরব না এযাত্রায়, সিদ্ধিদাতার নাম জপছি মনে মনে। এর মধ্যেই বাজি পটকা মশাল টিনবাজনা তীর ধনুক সহকারে লেবার বস্তি বনবস্তির মানুষেরা হো হো আওয়াজ করতে করতে এগিয়ে আসছে আর বিপদ বুঝে পিছটান দিয়েছে হাতির পাল, ওরা তাড়িয়ে দিয়ে এসেছে জঙ্গল অব্দি। মাছ মাংসের তীব্র গন্ধেই নাকি ওরা ছুটে এসেছিল। ধীরে ধীরে যুগ এগিয়ে এসেছে অনেকটা পথ, মেয়ের বিয়ের পরে জামাই মাঝেমধ্যে গাড়ি নিয়ে হাজির বাড়ির সামনে " চল বেড়াতে যাব",
বুঝতে পারি জঙ্গলপ্রিয় মানুষ ওর বেড়ানো মানেই জঙ্গল। এমনি উইক এন্ডে একদিন দোমহনী পার হলে বুঝলাম আবার জঙ্গল, লাটাগুড়ি ঢুকেই হা হা করে ওঠে ভিতরটা একি শ্মশানভূমির চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে লাটাগুড়ি দুপাশে শায়িত অজস্র বৃক্ষরাজির শব। যেখানে একটা ফুলগাছ মরে গেলে সেই শোক সামলান কঠিন হয়ে পড়ে, ভুলতে কতসময় লেগে যায় সেখানে যুগ যুগ সংরক্ষিত বন, কি করে পারল। একদিকে বেআইনিভাবে অসাধু ঘাতকেরা নৃশংস কাজ করে পকেট ভরছে তার উপর এই অকাজ। প্রশাসন কি ইচ্ছে করলে পারে না একটু বেশি সক্রিয় ভূমিকা নিয়ে জঙ্গলঘাতকদের বিরুদ্ধে বড়সড় ব্যবস্থা নিতে? গাছ বাঁচলে আমরাও বাঁচব এই উপলব্ধি বা ভাবনায় বাধ্য করা উচিত যদি সরষেয় ভূত না থাকে। যতদূর ঘন নিবিড়ে ঢুকছি কোথায় অরণ্যের মোটা পর্দার আড়াল, অনি:শেষ দূরত্ব পর্যন্ত শুধুই শূন্যতা।ফাঁকা ফাঁকা বনরাজিকে মনে হচ্ছে বড় অসহায় বড় একা। মহাকালে প্রণাম সেরে সেই ফ্রেম কিছুদূর হাঁটলাম একই দৃশ্য বছর চল্লিশ আগে গা ছমছমে ভয়াবহ পরিবেশ পাখিদের মিলিত কণ্ঠ ঝিঁঝিঁর ডাক সেসব কোথাও নেই, থেকে থেকে অটবীর খন্ডিত জীর্ণলাশ। আবছায়ে একটু কেকাধ্বনি আর ডাহুকের ডাক কানে আসছে। মূর্তির শীতল জলে পা ভিজিয়ে বসে আছি ওপারে জল খেতে নেমেছে এক মূর্তিমান গনেশ। চাপড়ামারিপৌঁছে ওয়াচ-টাওয়ারে গাড়ি একটু জিরোন দিলে নেমেছি ফুলপাগল আমি ফুলচারা দেখে,রেললাইনে দাঁড়িয়ে নাতি বলছে বাবা হাতি বাঁদিকের লাইনেই নিরাপদ দূরত্বে সে দাঁড়িয়ে আছে, একই সাথে ডানদিকের লাইনে দাঁড়িয়ে কয়েকটি বাইসন সেও অনেকটা দূরে তবে চোখের নাগালেই। কলকাতার একটি দল দেখে তো অভিভূত স্তম্ভিত এগিয়ে যাচ্ছিল, বাঁধা দিল বনকর্মী।"দাদা আর এগোবেন না বাইসন কিন্তু বাতাসের আগে ছোটে সেকথা শুনে আমারও আর এগোইনি। তড়িঘড়ি গাড়িতে উঠে রওনা হলাম।
রজস্থানের সওয়াই মাধোপুরে জাতীয় উদ্যান (দুর্গ দিয়ে ঘেরা, আয়তন ১৩৩৪ বর্গ কি মি) রনথম্ভোর আর সারিস্কা জাতীয় উদ্যান সর্বাধিক জনপ্রিয় উদ্যান বলে কথিত। ৩০/৩৫ রকমের বন্যপ্রাণী একসাথে চরে বেড়াচ্ছে,কেউ কারো ক্ষতি করছে না, যেন বন্ধু সবাই। ডালে ডালে বিচিত্র রকমারী সব অচেনা পাখি। রাস্তা দুর্গ মাঠ আর বনান্তি জুড়ে ময়ূর আপনমনে নাচছে, কেউ ডানা শুকাচ্ছে, কেউ মুখোমুখি বসে প্রেমবিনিময়ে নিবিষ্ট। কোনো ভাবে ওরা ভীত বা সন্ত্রস্ত নয়, আমাদের সাফারি গাড়ি দেখে উড়েও যাচ্ছে না বরং এমন গর্বিত ভাব যে আমাদের দেখতেই তো হ্যাংলার মতো এসেছো। মনোরম একটা একহাত লেজঝোলা পাখি মনে হচ্ছে সুর্য তার সাতরং দিয়ে সাজিয়ে রেখেছে ওকে, চোখ বাকিয়ে দেখছে আমাদের। হুটখোলা গাড়ি থেকে নাগাড়ে ক্লিক হয়ে চলেছে কি তার অহংকারি ভাব - তোলো দেখি যত খুশি এই আমি পোজ দিয়ে আছি! গাড়ির ভিতর এদিকে তর্কাতর্কি চলতে থাকে বিদেশী বিদেশিনীর সাথে, "রনথম্ভোর টাইগার রিজার্ভ পার্ক" দেখতে এসে একটাও টাইগার দেখাতে পারলে না বলে গাইডের সাথে বেদম ঝামেলা, ঠিক সেইসময় টাইগার টাইগার বলে চেঁচিয়ে ওঠে এক বিদেশিনী। সামনের সারিতে বিশাল বপু নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে ওরাই সেইসঙ্গে ক্যামেরার ঝলকানি, চম্বল নদীতে জল খেতে নেমেছে বিরাটাকায় এক রয়েল বেঙ্গল টাইগার। ওপারে সে জল খাচ্ছে আমরা এপারে পান করছি তার মোসাহেবি। সারিস্কা জাতীয় উদ্যানে গাইড আমাদের ভুল জোন দিয়ে নিয়ে যাবার জন্য বাঘ বা গন্ডার কিছুই দেখতে পাইনি প্রচুর চারসিং যুক্ত হরিণ আর নীলগাই তার পরিবার নিয়ে রোদ তাপাচ্ছে। গাইডের মুখ থেকে শুনি ওরা নাকি সপরিবারে থাকতেই বেশি পছন্দ করে। বনবিড়াল আর বনশূকর একইসাথে ঘুরে বেড়াচ্ছে এখানে-সেখানে ছড়িয়ে নানা বর্ণের পাখিরা খাবার খুটে খেতে ব্যস্ত। চিত্রিত জিরাফদল ঘাসপাতা খেতে খেতে লম্বা গলা উঁচিয়ে আমাদের দেখছে। রাজস্থানে রকমারি পশু পাখি দেখে কতটা পরিতৃপ্ত হয়ে এসেছি দশ বছর পেরিয়ে আজও ভুলতে পারিনি।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴