অরণ্য ভাবনা ও ভালোবাসার ফারাক/সুদীপা দেব
অরণ্য ভাবনা ও ভালোবাসার ফারাক
সুদীপা দেব
----------------------------------------------
পৃথিবীর বয়স যত বাড়ছে ততই কংক্রিটের তলায় চাপা পড়ছে সবুজ। আমরাও দৈনন্দিন কর্মব্যস্ততায় হাঁপিয়ে ওঠা বুকের আরাম দিতে নিতান্ত নির্বাক সবুজের স্পন্দন খুঁজি।
রামবাবু রহিমবাবুর মত আমিও নিজেকে অরণ্যপ্রেমী হিসেবে ভাবতে ভালোবাসি। সুযোগ পেলেই বেরিয়ে পড়ি। ছুটির দিনে জঙ্গলে যেতে না পারলে খুব মন খারাপ হয়। আমার পরিচিত অপরিচিত জনেরা কত দূর দূর থেকে এসে ডুয়ার্সের সুধা মেখে যায়। আর আমি তো এখানেই থাকি, ডুয়ার্সের কাছাকাছি। আমিও ডুয়ার্স ভালোবাসি, ডুয়ার্সের নতুন নতুন স্পট খুঁজে বেড়াই। কখনো বাইকে কখনো গাড়িতে ঘুরে বেড়াই। ডুয়ার্সের জঙ্গলে ঢুকে সাফারি সুযোগ থাকলে তা নিতে ছাড়ি না। হাতি বাঘ গন্ডার বাইসন। নিদেনপক্ষে একটি হরিণ বা ময়ালও যদি জুটে যায় স্বচক্ষে দেখতে পাই তবুও ভালোবাসার বুকে একটুখানি খুশি-জলের ছিটা পড়ে।
এরকমই ভাবনা চিন্তাধারীদের সাথে আমাদের অহরহ মোলাকাত হয়। তারা নিরালায় নিরিবিলিতে এক্কেবারে নতুন নতুন স্পটে ডেরা বাঁধতে চান কয়েক দিনের জন্য।
ভাবুন তো এই নতুন নতুন স্পট মানে নতুন নতুন হোমস্টে বা রিসোর্ট এর খোঁজ। নতুন বাসস্থান মানে নদী প্রবাহ চাপা দিয়ে, পাহাড় জঙ্গল কেটে সাফ করে জঙ্গলের পশুপাখি খেদিয়ে প্রথমে রাস্তা তারপর রাত কাটানোর মতো বন্দোবস্ত। কয়েক মাস ধরে গন্ডা গন্ডা মেশিন আর কয়েক ডজন লোকের আনাগোনা আমাদের আরাম প্রিয় মানুষজনদের সেবার কাজে লাগানো হয়। পরিবেশ এবং প্রকৃতি কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হয় তা নিয়ে আমাদের অবশ্যই ভাবতে হবে। যত রাস্তা যত কনস্ট্রাকশন তত সবুজ নিধন। যত সবুজ নিধন ততই প্রাণের নিধন। এই জঙ্গল হয়তো হাতি বা বাঘ নেই। কিন্তু শুধু তারাই প্রাণী! এখানকার সাপ ব্যাঙ কাঠবিড়ালি প্রজাপতি গাছের পাখি তারা কোথায় যাবে? ওরা মরে মরুক, তাই কি? তা যদি না করতে চাই তাহলে নির্ঘাত আমার আপনার বাড়ির পাশের জায়গায় জঙ্গল বানিয়ে তাদের থাকার ব্যবস্থা করে দেবেন ?
জঙ্গলে গিয়ে সাফারি করার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েন তাদের জন্য
রুশ প্রাণিবিজ্ঞানী ইউরি_দিমিত্রিয়েভ একটি বিখ্যাত কথা বলেছিলেন।
"আমি যখন প্রথম একটি অভয়ারণ্যে গিয়েছিলাম তখন প্রচন্ড হতাশ হয়ে পড়ি। আমি যে Completely ঝোপের আডালে একটি করে বন্যপ্রাণী দেখবো এমন আশা করিনি ঠিকই, কিন্তু কিছু কিছু শেয়াল বা খরগোশ অন্ততঃ দেখতে পাবো এমন আশাই ছিল। সারাদিন ঘুরে ঘুরে আমি কোনও জন্তুর কিছুই দেখতে পাইনি। আমি আমার জঙ্গলের গাইড কাম গাড়ির চালককে আমার হতাশার কথা বললাম। সে মুচকি হেসে বল্লে-- স্যার, আপনি কিছুই দেখতে পেলেন না বটে, তবে গাছের ডালের ফাঁকে থেকে, ঝোপের আড়াল থেকে, গর্তের ফাঁক দিয়ে অনেক অনেকগুলি চোখ আপনাকে দেখেছে। অনেক বন্যপ্রাণী উদবেগের সঙ্গে অপেক্ষা করছে যে, কখন আপনি এই অরণ্য ছেড়ে চলে যাবেন এবং তারা একটু নিশ্চিন্তে চলাফেরা করবে, এডালে-ওডালে উড়ে বেড়াবে"।
ধরুন আপনি আপনার বাচ্চাকাচ্চা সহ পরিবারের আরো কয়েকজনকে নিয়ে বেড়াতে বেড়িয়েছেন দেখলেন কয়েকটি চারপেয়ে আপনার বাড়ির রাস্তায় এসেছে, আপনি কি করবেন, ভয় পেয়ে ওদের তাড়াবার ব্যবস্থা করবেন। আর বাড়ি ফিরেও কিছুদিন আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে থাকবেন নিশ্চয়ই। আপনি জঙ্গলে গেলে জঙ্গুলেরও তাই হয়। নিজেদের এবং পরিবার বাঁচাতে আপনার গাড়ি উল্টে ফেলে দিতে তেড়ে আসে। তবুও বনদপ্তরের দুর্বলতায় ভর করে আপনি সশব্দে বাইক বা গাড়ি হাঁকিয়ে যাবেন, মাইক বাজিয়ে পিকনিক করবেন, যেখানে সেখানে প্লাস্টিকের বোতল কাঁচের বোতলে পরিবেশ প্রকৃতির শৃঙ্খলা ভাঙবেন।
অরণ্য একটি পরিবার। পরিবারে এক সদস্য হারিয়ে গেলে অন্যরা ভালো থাকবে কি করে বলুন? তার ক্ষতি আমার আপনার সার্বিক ক্ষতি। অরণ্য পরিবারকে সত্যিই ভালোবাসলে, ছোট ছোট আকারে হলেও তার রক্ষার দায়িত্ব নিতে হবে আমাদের প্রত্যেক অরণ্যপ্রেমীকে।
আসুন আমরা অরণ্য প্রকৃতিকে বুকের আরো গভীরে রাখি।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴