অরণ্য জীবনের গান গায়/বিমল দেবনাথ
অরণ্য জীবনের গান গায়
বিমল দেবনাথ
------------------------------
অরণ্য-কথা মনে হলেই প্রাণের ভিতরে হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ে ডেভোনিয়ান সবুজ আর হু হু বিশুদ্ধ বাতাস। অরণ্য যে আমার প্রাণের ভিতরে। অরণ্য আমার থেকে দূরে সরে গেলেও আমার ভিতর থেকে কেউ কোন কিছুর বিনিময়ে অরণ্য কেড়ে নিতে পারেনি। সে আমার যতই আপন হোক।
অরণ্য প্রাণসাগর। অরণ্যঅবাসে প্রাণ মাটিয়ালি প্রাণী হয়। জীবন হাঁটে হাসে কাঁদে গান গায়। জীবন তো নদীর মতো। সাগরে এসে উৎস ভুলে গেলে জীবন শুকিয়ে যায়, মরে যায়। জীবন বাঁচতে চায় জীবনের পরেও। প্রাণ স্ফুরণের দীর্ঘ অনুরণন পিয়াসি মানুষ প্রাণ সঞ্চারে অরণ্যের কাছে ছুটে যেতে চায় বার বার। অরণ্য শুধু ডাকে আয় আয়…
সেবার ডাক দিয়েছিলো দাচিগ্রাম। দাচিগ্রাম জাতীয় উদ্যান। কল্পনায় কস্তূরী গন্ধ জোয়ার এনেছিলো জীবনে। চলে যাই পশ্চিম হিমালয়ের ‘জাবারওয়ান রেঞ্জে’। পাহাড়-উপত্যকার দেশের সুউচ্চ পাহাড়ের ‘বৃক্ষ-রেখা’-র নিচে বসন্ত খেলছিলো নীল পপি আর বুনো চেরি ইত্যাদি বুনোফুল বুকে নিয়ে। গম্ভীর হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো চিনার, বুদুল, দেওদর , উইলো, পপলার, পাইন ইত্যাদি গাছ। আমাদের এখানকার শিমুল মাদার ওদালের ফুলের মতো আগুন না ঝরালেও নীলপপি, বুনোচেরি, আপেল, পিয়ার্সের ফুলে একটা মায়া আছে। ‘দাগওয়ান’ নদীর পাড়ে পাড়ে হাঁটছি স্বপ্নাবিষ্ট হয়ে। ‘দাগওয়ান’ নদী কিশোরী প্রেমিকার মতো কথা বলছিলো কলকল করে। বনের রাস্তায় হাঁটলে আমার এমনই হয়- সে সুকনার রংটং-এর রাস্তা হোক, আপালচাঁদের কাঠামবাড়ির রাস্তা হোক, গরুমারার লাটাগুড়ির রাস্তা হোক, চিলাপাতার কোদালবস্তির রাস্তা হোক বা বক্সার জয়ন্তীর রাস্তা। বনের রাস্তা যেন মনের ঠিকানা জানায়। রক্ত রং- এর ঝরে পড়ে থাকা চিনার গাছের পাতা আবার কত দিন পর চেনাতে চায় জীবনের প্রথম প্রেম। আচ্ছা কেউ কি জীবনের প্রথম প্রেম ভুলতে পারে?
চিনারদের ঘন বসতির মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে মনে পড়ে যায় কবেকার কথা। বারো ক্লাসে। একদিন স্কুলের ঢোকার সময় একটা খবর কেমন মন খারাপ করেছিলো। বনে নাকি হাতি মরে পড়ে আছে। স্কুল বাড়ি থেকে দেখা যেত বন-প্রান্ত রেখা। ভেসে আসতো বন-ফুলের গন্ধ। টিফিনের সময় কয়েক জন সহপাঠিনী সহ ‘হস্তি দর্শনে’ নারীর সঙ্গে প্রথম বন যাপন। তখন তো কয়েক ঘণ্টা কয়েক যুগ! সবুজ ছায়ায় হারিয়ে যাওয়া যুগলের আতঙ্ক উৎকন্ঠ উত্তাপ বিনিময়।
হঠাৎ করে একটা সোনা বউ পাখি (Golden Oriel) উড়ে গেল। বউ সোনার মতো হলে কার খারাপ লাগে! একটা ঝরা চিনার পাতা তুলে দিলাম সঙ্গিনীর হাতে। বাঁ হাতে ঘুরে চিনার দেওদরদের গ্রাম ছেড়ে উঠে যাই পাহাড়ের মাথার দিকে। মাথা দেখা গেলে কী হবে ছোঁয়া মুশকিল। সে যে মাথা হোকনা কেন।
আমরা তখনও পাহাড়ের হাঁটুর কাছে। কিছু ক্ষণ হাঁটতেই এসে পড়ি বিস্তীর্ন তৃণ ভূমিতে। দূর থেকে কার্পেটের মতো লাগলেও আমাদের হাঁটু ডুবে যাচ্ছে ঘাসে। কোথাও কোথাও বুকও। গাইড বললো যেকোন সময় এসে পড়তে পারে হিমালয়ান ব্ল্যাক বা ব্রাউন বীয়ার। কিন্তু কে কার কথা শোনে। সবাই উপরের দিকে হাঁটছে। ভয়ডর নেই। সবার মনে যেন জীবনের জোয়ার এসেছিলো। দাচিগ্রামে এসে কস্তুরী মৃগ না কেউ দেখে ফিরবেনা। সেকি এতো সহজে দেখা যায়। সে তো আলপাইন ঝাড়ি জঙ্গলে একা একা চলাফেরা করে। লাজুক, লুকিয়ে থাকে।
তবে কস্তুরী মৃগ কিন্তু হরিণ নয়। হরিণের মতো শিং (অ্যান্টলার) থাকে না। হরিণের মতো চারটি দুধের বাট নাই। বাট দুটি। এরা নিজেদের পায়খানা তৈরি করে। অনেকটা গন্ডারের মতো। পুরুষ কস্তুরী মৃগের হাতির মতো দাঁত থাকে, তবে দাঁত ধেড়ে ইঁদুরের মত নিচের দিকে বাঁকানো।
সেই দাঁত সঙ্গিনী দখলে কাজে লাগায়। এদের চোখের কোণে জল ঝরেনা-কারণ ল্যাক্রিমাল গ্রন্থি নাই। এদের পুচ্ছ গ্রন্থি থাকে। সেখান থেকে সুগন্ধি রস বের হয়। সেই রস জননাঙ্গ ও নাভির মধ্যে একটা থলিতে জমা হয়। যাকে কস্তুরী বলে। এই কস্তুরীর জন্য প্রাণীটি শিকার হয়…
তখন গাইডের কথা কে শোনে। কেউ দুরবিন দিয়ে, কেউ ঝোপঝাড় ঠেলে ব্যস্ত কস্তুরী মৃগ দেখতে। গাইড বলে – সাবধান ব্ল্যাক বীয়ার বাচ্ছা সহ পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নেমে আসছে। ওরা এই বনে খাদ্য খুঁজতে আসবে। আমাদের বেরিয়ে যেতে হবে। গাইডের চোখে যত ভয় আমাদের দলের সদস্যদের চোখে মুখে তত রোমাঞ্চ। চোখে সকালের সূর্য। মনে প্রণে যেন গাইছে জীবনের গান। সেই গান নিঃসৃত করছে জীবন রস। সেই রস ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে জীবনের ক্লেশ কাদা। মনের সব দাগ মুছে যেন মানুষ গুলো শিশু হয়ে ওঠে। এই জন্যই কি মানুষ বার বার বনে যেতে চায়? গাইড আবার তাড়া দেয়। বলে -জানেন এই বনের নাম দাচিগ্রাম কেন হয়েছে?
মন্ত্র মুগ্ধ হয়ে হাঁটা শুরু হলো গাইডের পিছনে। জানা গেল নানা অজানা কথা- সেই বনে দশটি গ্রাম ছিলো। বহুকাল আগে সেগুলো সরিয়ে নিয়ে গেছে। তবে পশুদের জন্য নয়, শ্রীনগরের মানুষের জলের জন্য। জল তো নয় জীবন। অরণ্য অরণ্যের মতো থাকলেই জীবনের গান গায়। অরণ্যকে অরণ্যের মতো রাখতে হয়। অরণ্য একমাত্র জীবনের উত্তরাধিকার। ১৯৮১ সালে দাচিগ্রাম কে জাতীয় উদ্যান হিসাবে ঘোষণা করা হয়। জাতীয় উদ্যান এখন শুধু জল দেয়না, গায় জীবনের গান। সেখানে যাপন করে কস্তুরী মৃগ হ্যাঙ্গুল ইত্যাদি নানা বুনো, উড়ে বেড়ায় হিমালয়ান মোনাল সহ নানা রঙবেরঙের পাখি, ‘দাগওয়ান’ নদীতে খেলা করে ট্রাউট মাছ…
নিচে ডাল লেকে দেখা যায় রঙবেরঙের শিকারা। শিকারা নাকি মন পাখি!
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴