অমিতাভ গোস্বামী-র আলোচনায় অমিত কুমার দে-র 'রাজেশ্বরী তুমি'
অমিতাভ গোস্বামী-র আলোচনায় অমিত কুমার দে-র 'রাজেশ্বরী তুমি'
ভালোবাসার পূণ্যভূমি
বাংলা ভাষার সমকালীন কবিদের মধ্যে উত্তরবঙ্গের অমিত কুমার দে এক অতি বিশিষ্ট নাম। ডুয়ার্সের কোলে উত্তরবঙ্গের এক ছোট্ট জনপদ ধুপগুড়িতে বসে তিনি নিমগ্ন চিত্তে মৌলিক সাহিত্য নির্মাণে রত আছেন। সম্প্রতি চিকরাশি সাহিত্য উৎসবে গিয়ে হাতে পেয়েছি অমিত বাবুর লেখা 'রাজেশ্বরী তুমি' কাব্যগ্রন্থটি। আধুনিক বাংলা প্রেমের কবিতায় পূর্ণেন্দু পত্রীর সৃষ্ট চরিত্র নন্দিনী শুভঙ্করের 'কথোপকথন' এবং সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের 'নীরা' র পথ ধরেই যেন আগমন ঘটেছে রাজেশ্বরী চরিত্রটির। ইতিমধ্যেই এই সিরিজের কবিতাগুলি তাদের স্বকীয়তা এবং স্বাতন্ত্র্যের ছাপ রেখেছে বাংলা কাব্য সাহিত্যে। রাজেশ্বরী সিরিজের তিন শতাধিক কবিতা থেকে বাছাই করা একশোটি কবিতা আলোচিত বইয়ে সংকলিত হয়েছে।
এই কাব্যগ্রন্থের নিবিড় পাঠ আপনাকে নিশ্চিত ভাবে নিয়ে যাবে এক অন্য ভুবনে যেখানে আপনি খুঁজে পাবেন স্বপ্ন মায়ায় জড়ানো রোমান্টিক কবি অমিত কুমার দে কে। ইট, কাঠ, পাথরের নাগরিক জীবনের ঘেরাটোপের বাইরে রাজেশ্বরীর প্রতি তাঁর প্রেম মুর্ত হয়ে ওঠে ডুয়ার্সের নিসর্গ প্রকৃতির মায়াময় প্রেক্ষাপটে।
তাঁর মানস প্রতিমা রাজেশ্বরী যেন শুধু আর রক্ত মাংসের নারী নন তিনি ডুয়ার্সের জল জঙ্গল কুয়াশা প্রকৃতির সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছেন।
'গরুমারা অরণ্যের আজকের সকালটা /তোমার শুদ্ধ হাতে তুলে দিলাম রাজেশ্বরী নিও- / লাজুক লাজুক ভোর শাল সেগুনের হাতে তুলে দিল/ কি অনিন্দ্য শুভকামনা, ভিক্ষা চেয়ে তোমায় দিলাম নিও- / জানি আজ তোমার শরীরে মলিনতা নেই - নদী রয়েছে/ গভীরে বয়ে যাওয়া লাল নদীর জল দিলাম নিও- '
অথবা
'তোমার অবয়ব ঢেকে দিল / সব বন সমস্ত পাহাড় সবগুলো সমুদ্র সফেন/ তোমার বুকের থেকে উঠে এলো পঞ্চবটি বন/ পূব দিকে অশ্বত্থ উত্তরে বেল পশ্চিমে বটগাছ দক্ষিণে আমলকি / অগ্নিকোণে রক্ত আগুন হয়ে অব্যর্থ অশোক'।
ডুয়ার্সের পরিবেশ ও প্রকৃতির উপর গভীর মমত্ববোধ কবির বিভিন্ন কবিতার ছত্রে ছত্রে ফুটে উঠেছে।
'... উত্তরবঙ্গ এক্সপ্রেস আমাকে নিয়ে ঢুকছে / স্টেশনের সমস্ত ভিড় সরিয়ে দিয়ে / তুমি দাঁড়িয়ে আছো, রাজেশ্বরী / প্রতিটি প্ল্যাটফর্ম জুড়ে কুয়াশা ছাওয়া চা গাছ / রেললাইনগুলো কেউ রেতি কেউ ডায়না / কেউ কেউ জলঢাকা নদী / সমস্ত নিত্যযাত্রীকে অরণ্য বানিয়ে দিয়ে / আমার জন্য অপেক্ষা করছো তুমি / আমার রাজেশ্বরী / স্টেশনের সব মাইক্রোফোনে ডেকে উঠলো ডুয়ার্সের পাখিরা...'
সুনীলের প্রেমিকা 'নীরা'র অক্ষরগুলোকে উল্টে দিলে পাই রানী যিনি সুনীলের হৃদয় সিংহাসনে বিরাজমান তেমনি যেন রাজেশ্বরী অমিতবাবুর ঈশ্বর পৃথিবী ভালোবাসা। তাঁকে ঘিরেই কবির চাওয়া পাওয়া মান অভিমান ক্রোধ একান্ত অধিকারবোধ।
'জহিন মানুষদের সমঝে চলো, রাজেশ্বরী / জহর রাখো তোমার জৌলুসে / জলসেচ দাও নিজস্ব মৃত্তিকায় / অন্যমন হয়ো না কখনো / জলসত্র রেখে দাও পিপাসার্ত আনন্দের জন্য / স্বার্থপরের মত তালা দাও বাহিরের গেটে ....... জলপিঁড়ি পাতা থাক শুধুমাত্র আমার নামেই'।
প্রেমানলে দগ্ধ কবি তার যাবতীয় ভালোবাসা নিয়ে হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন রাজেশ্বরীর দিকে। কখনো সে হয়ে উঠেছে মানসসুন্দরী কখনো বা নিসর্গপ্রকৃতি। প্রেমের সঙ্গেই মিশে থাকে যন্ত্রণা, হারানোর ভয়। এ সবই তাঁর কবিতায় নিয়ে এসেছে কল্লোলিনী নদীর মত নানা বাঁক ও ছন্দের অনুপম সৌন্দর্য।
'মুঠোয় তোমার বিষ রেখেছো রাজেশ্বরী / আমি ছাড়া কে নেবে আর তোমার ঘৃণা / হাঁ করেছি দাও ঢেলে সব অসংকোচে / আমিই তোমার হত্যা করার মানুষ কিনা / আমায় তুমি খুঁচিয়ে মেরো বর্শা দিয়ে / তীক্ষ্ণ ফলায় মাখিয়ে নিও গুল্ম বিষের / আর্তনাদে কি এসে যায় তোমার বলো / মৃতদেহের জন্য আবার কষ্ট কিসের?'
রাজেশ্বরীর প্রতি কবির প্রেম শারীরিক চাওয়া পাওয়ার গন্ডিকে অতিক্রম করে আত্ম নিবেদনের এমন এক ঐশ্বরিক পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যেখানে কবি যেন এক ধ্যানমগ্ন তপস্বী।
'তুমি মন্ত্রোচ্চারণ করলে আমার দিনটি সুন্দর হয়, রাজেশ্বরী / আমার লেখার টেবিলে তখন ধূপধুনোর গন্ধ / সলতে পোড়ার ঘ্রাণ আমার কলম কে ছুঁয়ে যায় / আমি ক্রমাগত পরিশুদ্ধ হই / তখন শব্দরা সব স্নান করে আসে / তাদের সবার গায়ে লেগে থাকে অনাবিল রোদ / প্রতিটি বাক্যের ঠোঁটে যেন এক পূজারীর হাসি....'।
কাব্যগ্রন্থের পরতে পরতে ফুটে ওঠে অনবদ্য সব চিত্রকল্প এবং উপমা রচনার মুন্সিয়ানা। কবিতার বর্ণ গন্ধ রূপ রসের এক অনির্বচনীয় সৌন্দর্যের সার্থক প্রকাশ ঘটে এই সব চিত্রকল্পের মধ্য দিয়ে।
'আমার ঘুমের ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে গান / ঠিক যেভাবে গ্রামীণ বাড়ির পাশ দিয়ে জল উপচায় / চা বাগান থই থই করে বলে ওঠে- সারিন্দা কোথায় / আমি মধ্যরাতের আষাঢ়কে ছুঁয়ে বললাম - / তোমার রথের মেলায় আমি বাঁশি কিনব / চিরবিচ্ছেদ বাজাতে বাজাতে সটান হাঁটতে থাকবো মৃত্যুর দিকে...'।
অথবা
'ট্রেনের জানালায়
ফসল ফিরিয়ে দেওয়া ক্ষেত
সব ধান চলে গেছে কৃষকের ঘরে
আমি ক্ষেত দেখছি রাজেশ্বরী
অঘ্রাণ ফিরিয়ে দিল ধান
যেভাবে তোমায় ফেরায় এক তীব্র অভিমান
কোন কোন ঋতুদিনে
ফিরে যাও, দূরে সরে যাও
ট্রেনের জানালা দিয়ে
আমি দেখি পড়ে থাকা খড়
ওখানে আমিই যেন পড়ে আছি
পড়ে আছে রক্ত-অবসর...'।
এখন ডুয়ার্সের পরিবেশনায় বিস্তার মিডিয়া প্রাইভেট লিমিটেড কর্তৃক প্রকাশিত ঝকঝকে বাঁধাই পরিচ্ছন্ন ছাপা ও প্রশান্ত রায়ের যথাযথ প্রচ্ছদের এই বইটির বিনিময় মূল্য মাত্র একশো ষাট টাকা যা এই অসামান্য বইটি হাতে পাওয়ার জন্য নিতান্তই নগণ্য। পাঠক সমাজ যদি এই বইটি হাতে তুলে নেন এবং নিবিষ্ট চিত্তে পাঠ করেন তাহলে হলফ করে বলতে পারি ক্রমেই তিনি মোহাচ্ছন্ন হয়ে পড়বেন এবং কখন অলক্ষ্যে রাজেশ্বরী হয়ে উঠবে তাঁর নিজেরই প্রেমিকা। কবিতার লাইনগুলো হয়ে উঠবে তাঁর একান্ত নিজস্ব। প্রকৃতই মনে হবে,' কিছু কিছু কথা আটকে থাকে কন্ঠনালীতে / সত্য, অবধারিত, অথচ প্রকাশিত নয়...'। ভালোবাসার পূণ্যভূমি, এক অমৃত কুম্ভের সন্ধান পাবে পাঠক ।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴