অভিভাবক/অতনু চন্দ
অভিভাবক
অতনু চন্দ
আমার একান্ত ব্যক্তিগত কথা, যা কিনা সারা চাকরি জীবনে আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়িয়েছে, আজ তা আমার “সহজ উঠোনের” বন্ধুদের বলে একটু হাল্কা হতে চাই।
হ্যাঁ আমি 'Confess' করতে চাই। আজ এই মাধ্যমে সেই নাম না জানা দেবদূতের উদ্দেশ্যে আমার হৃদয়ের কৃতজ্ঞতা ও প্রণাম জানাতে চাই। এভাবে হেঁয়ালি করলে হয়ত বিষয়টা পরিস্কার হবে না! তাই একটু খোলাখুলি ভাবে বলতে চেষ্টা করছি।
আশির দশকের কথা বলছি। তখন চাকরির বাজারটা এত খোলামেলা ছিল না। যারা পড়াশোনায় বেশ ভাল তাদের কথা আলাদা। আমাদের মতন মধ্য-মেধার ছেলে-মেয়েদের সরকারি চাকরি ছিল মহার্ঘ। তার মধ্যে যাদের চিন্তা ভাবনা ‘অমল কান্তির’ মতন তাদের পক্ষে চাকরি পাওয়াটা ছিল আরো মুশকিলের। আমার ধরন-ধারণটা কিছুটা এ রকমই ছিল ব’লে শুনেছি! কারণ হিসেবে বলব যৌথ পরিবারের “pampered child” ছিলাম আমি। তারমধ্যে আমি এই প্রজন্মের প্রথম সন্তান। বাবা-কাকারা পাঁচ ভাই উচ্চ শিক্ষিত। স্কুল জীবনের পাট চুকিয়ে তারা মহানগরীতে তাদের পড়াশোনা সমাপ্ত করেছেন। স্বাভাবিক ভাবেই আধুনিক ধ্যান-ধারণার অভাব তাদের মধ্যে ছিল না কিন্ত বড় দাদার বড় ছেলে হওয়ার সুবাদে বেশ আদরে-আহ্লাদে মানুষ হয়েছি আমি। কোন ব্যপারেই আমার তেমন কিছুর অভাব ছিল না, সঙ্গে আরোপিত কোন রকম চাপ ও প্রত্যাশা ছিল না। খেলতে খেলতে সরল সুন্দর মন নিয়ে বড় হয়েছি। এ জন্য বোকা ছেলেও অনেকে বলেছে তখন! এখন সে সব কথা ভাবলে খুব মজা পাই। আমাদের পরিবারের সাথে চা-বাগানের নিবিড় যোগ থাকাতে আমি প্রকৃতি প্রেমিক ছিলাম। গাছে-গাছে ঘুরে বেড়িয়ে, পাখি-মেঘ, সুনীল আকাশ দেখে বড় হয়েছি বলে মনে জটিলতা একদম প্রশ্রয় পায়নি। অবশ্য তখনকার জীবনে এতটা জটিলতাও নেমে আসেনি!
এভাবেই স্কুল জীবন, কলেজ জীবন কাটিয়েছি অলস স্বপনে। তারপরই হঠাৎ দুম্ করে নেমে আসে কঠিন বাস্তব…। বন্ধু-বান্ধবরা সকলেই চাকরির চেষ্টা করতে লাগল। বিশেষ করে যারা বাইরে পড়াশুনা করে এসেছে তারা “Competitive Exam” এর প্রস্তুতি নিতে আরম্ভ করল।…ওরা কী করে, কী ভাবে পড়ে এবং ঘড়ি ধরে কী ভাবে “practice” করে তা-ই তখন ভালো করে জানতাম না! প্রতিযোগিতার মাঠে কেউ যে কেন কারো হাত ধরে না তাও বোধগম্য হত না! আমি নিজের ক্ষেত্রে বেশ নির্লিপ্ত বরং বন্ধুদের ব্যপারে বেশ “active” ছিলাম। সে কারণেই কখন কার “Khanna”র বই আনতে হবে, “Note” লিখে দিতে হবে, “interview” এর জন্য বাইরে গেলে ট্রেনের টিকিট কাটতে হবে- রেল ষ্টেশনে কখন পৌঁছাতে হবে ইত্যাদি প্রভৃতি নিয়েই সদা ব্যস্ত থাকতাম।
এ ভাবে ব্যস্ততার মাঝে ভালোই কাটছিল জীবন। কারণ, আমার তো চাওয়া পাওয়ার তেমন কিছু ছিল না! কিন্ত একে একে যখন সব বন্ধুরই চাকরি হয়ে গেল তখন আমাদের আড্ডার বন্ধুদের আলোচনা ও কথাবার্তা হয়ে উঠল তাদের চাকরি কেন্দ্রিক। বন্ধুরা কেন যেন বুঝে উঠতে পারত না- এতে আমার মানসিক অবস্থার কি পরিণতি হতে পারে! যদিও সেটাই তো স্বাভাবিক ব্যপার। আস্তে আস্তে আমি শঙ্কুচিত হয়ে আড্ডার থেকে নিজেকে সরিয়ে নিলাম একদিন।
আর তখনই আমার জীবনে একটা পজেটিভ মোড় এল অর্থাৎ “Employment Exchange ” থেকে আমি একটি “Call Letter” পেলাম! এই প্রসঙ্গে আসতে গিয়েই এত শিবের গাজন গাইলাম এতক্ষণ! যাই হোক….
নির্দিষ্ট দিনে নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে, সেন্ট-টেন্ট মেখে, ওখানে গিয়ে উপস্থিত হলাম। ভীষন ভিড় অফিস চত্তরে। প্রত্যকের দেহের মাপ-জোক এবং শিক্ষাগত যোগ্যতা যাচাই হচ্ছে। শুনলাম দমকল বিভাগের চাকরি। এখান থেকে নির্বাচিত হলে নাকি আবার দমকল বিভাগ থেকে ডাকবে এবং ওখানেও “নির্দিষ্ট মানের” পরীক্ষা দিতে হবে! গ্রাম থেকেও অনেক ছেলে এসেছে, তাদের এক-এক জনের চেহেরা এমন যে আমাকে তুলে ছুঁড়ে ফেলে দিতে পারে অনায়াসে। তা দেখে কিছুটা ভয়ও পেয়ে গেলাম! তাই হয়ত, আমার মাপ-জোক সঠিক হওয়া সত্ত্বেও আমি “Not willing” কথাটা লিখে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম…।
…অনেকটা হেঁটে যাওয়ার পর মনে হল পেছন থেকে কে যেন “খোকা খোকা” বলে ডাকছেন। পেছন ফিরে দেখি এক ভদ্রলোক হাত উঁচু করে ডাকার ভঙ্গিতে দৌড়ে আমার দিকেই আসছেন। কাছাকাছি এসে এক নিশ্বাসে বললেন,”কখন থেকে ডাকছি, শুনতে পাওনা নাকি! -”স্যার’ তোমাকে একবার ডাকছেন”। হায় ভগবান- কী করে বুঝব যে আমিই সেই… ‘বুড়ো খোকা’!
একসাথে আবার “Employment Office” এ ফিরলাম। এবারে ঐ ভদ্রলোক পর্দা টানানো একটি চেম্বারের দিকে ইশারায় দেখিয়ে বললেন-যাও ভেতরে স্যার আছেন। আবার ভয় পেয়ে গেলাম, ভাবলাম কান ধরে উঠ-বস করাবে নাকি! তারপর ভাবলাম যে এত বাজে ছাত্রও তো আমি ছিলাম না, তাই সাহস করে একটু আদব-কায়দাসহ পর্দা সরিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ”May I come in Sir?” চশমার ফাঁক দিয়ে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে- উত্তর না দিয়ে চোখের ইশারায় আমাকে ঘরের ভেতরে ঢুকতে বলে, ওনার সামনে বসে থাকা কয়েকজনের সাথে কী একটা গভীর আলোচনা করতে থাকলেন। এবারে ভয় কাটল আমার। এত “confidential” আলোচনার মাঝেও আমাকে যখন ঘরে ঢুকতে দিয়েছেন তখন খারাপ কিছু বলবেন না নিশ্চয়ই, এই ভেবে। তাছাড়া এ কথাও কেন যেন মনে হল, উনি পর্দার আড়াল থেকে সব কিছু লক্ষ্য রাখছেন!.... প্রায় পাঁচ মিনিট দাঁড়িয়ে থাকার পর সবাই বেড়িয়ে গেলে, “Officer” বেশ রাগত ভাবে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে, গম্ভীর মুখে জিজ্ঞেস করলেন …..
-বাপু, তুমি কি জমিদারের ছেলে?
বললাম, না স্যার।
-MLA / MP র ছেলে?
না তো স্যার!
-পারিবারিক বড় ব্যবসা আছে কী?
আমি তো অবাক হয়ে ভাবছি- কি বলব!
-এবারে উনি আবার সবাক হয়ে ধমকের সুরে বললেন, তাহলে “Not willing” লিখেছ কেন? দমকল দপ্তরে গেলেই যে তোমার চাকরি হয়ে যাবে এ কথা কে বলল! বলেই আমাকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে “Office orderly”কে ডেকে বললেন, বড়বাবুকে বলে ওর লেখা কাগজটি চেয়ে নিয়ে এস।
আমি সেই ফাঁকে আমতা আমতা করে বললাম, স্যার এই কলটা না নিলে হয়ত আমি পরের অন্য কল তাড়াতাড়ি করে পাব, তাই লিখেছি।
- বললেন, আমি লিখে দেব যে তুমি “call refuse” করেছ। তাতেও তোমার “call” আসতে দেরিই হবে।
ইতিমধ্যে “office orderly” আমার লেখা কাগজটা এনে সাহেবকে দিয়েছেন। কাগজটা হাতে নিয়েই আমাকে কিছু বলার অবকাশ না দিয়ে উনি কঠোর ভাবে আদেশ করলেন….
-”Not willing” কেটে দিয়ে “willing” লিখে “signature”
করে দাও।
আমি “Employment Officer”এর নির্দেশ মতো কাজ করে কাগজটা আবার উনাকে ফিরিয়ে দিলাম। এবার দেখলাম ভদ্রলোক কিছুটা ধাতস্থ হয়ে একটু স্নেহ মিশ্রিতভাবে আমাকে ইশারায় বসতে বলে বললেন…
-জীবনের প্রথম “call” কী ফিরিয়ে দিতে হয়! এ সব ‘বাবুগিরির’ জন্যই তো তোমাদের চাকরি-বাকরি হয় না বাবা! জীবনটাই একটা “challenge”, তাই সেটার মুখোমুখি হতে চেষ্টা কর। তোমাকে দেখে তো শিক্ষিত-ভদ্র পরিবারের ছেলে বলেই মনে হচ্ছে, তাই বলছি এসব কথা। “Fire Department এ promotion”এর অনেক সুযোগ আছে। তোমার শারীরিক গঠনও এই কাজের উপযুক্ত বলে মনে হচ্ছে। নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করে সে সুযোগকে সঠিক ভাবে ব্যবহার করতে পারবে ওখানে। (আরো বললেন) তবুও ধর তোমার ওখানে যদি চাকরি হয় এবং তোমার তা করতে ভালো না লাগে আমাকে এসে বলবে। আমি রেক থেকে তোমার কার্ড এখনই সরিয়ে দিচ্ছি না। তবে আমার অভিজ্ঞতা বলছে, “তুমি নিশ্চয়ই ওখানে সফল হবে”। তারপর আর কথা না বাড়িয়ে হঠাৎ করেই বললেন- এখন এস…ভাল থেক।
আর সেদিন থেকেই যেন আমার 'নুতন বছর' শুরু হয়ে গেল। আমি “West Bengal Fire & Emergency Service” এ, এই April/ বৈশাখ মাসেই চাকরিতে জয়েন করেছিলাম। তারপর যোগ্যতার নানান পরীক্ষা দিয়ে, ভালোবেসে ৩৬-বছর চাকরি করে, আজ যতটুকু যা হয়েছি এবং যে সম্মান পেয়েছি তা অনেকটাই এই 'অজানা অভিভাবকের' সৌজন্য ও আন্তরিকতার ফসল।
এখানেই শেষ করব ভেবেছিলাম কিন্ত শেষের পরেও যেমন অশেষ বলে একটা কথা আছে তাই আবার বলছি, চাকরি পাওয়ার পর আমি একদিন সময় করে আমার মহান “Mentor+God father”কে আমার কৃতজ্ঞতা ও প্রণাম জানাতে গিয়ে জানলাম উনি অন্যত্র বদলি হয়ে গেছেন। তারপরও চেষ্টা করেছি কিন্তু উনি ততদিনে অবসর নিয়েছেন বলে শুনেছি।
পরিশেষে বলছি যে আমার “God father” এর দর্শন না পেয়ে আমি হতাশ হয়েছি, সে আপসোস ও অনুশোচনা আমার এখনও মন থেকে মুছে যায়নি! তাই- এই ধরণের অভিভাবকসম মহান ব্যক্তিকে আমি আজ এভাবেই আমার কৃতজ্ঞতা ও প্রণাম জানাতে চাই। যার কাছে টাকা-পয়সা, বিষয়-সম্পত্তির থেকেও আত্মমর্যাদা এবং জীবনের মূল্যবোধ অনেক বেশি দামি বলে মনে হয়েছে আমার।
ভালো থাকবেন স্যার, আপনারা ভালো থাকলেই আমরা সবাই খুব ভালো থাকব…।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴