অবলুপ্ত পত্র/শিখা সরকার
অবলুপ্ত পত্র
শিখা সরকার
-------------------
মা - সহায়।
---------------
২৩ - শে চৈত্র
পরম স্নেহাস্পদেসু আমার প্রিয়জনবর্গ,
সর্ব প্রথম সকলের জন্য রহিল আশীর্বাদ আর ভালোবাসা। আশা করি সকলে কুশলেই আছ। কয়েক দিন যাবৎ হইতেই ভাবিতেছি, চিঠি লিখিয়া সকলের কুশল সংবাদ লই। কিন্তু অনভ্যাসের দরুন ভাবনাকে কার্যে পরিণত করিতে পারি নাই। আজ জোর করিয়াই কাগজ - কলম লইয়া বসিয়া পড়িলাম। বসিয়া তো পড়িলাম, কিন্তু চিঠি লিখিব কাহাকে? ঠিকানাই তো ভুলিয়া গিয়াছি। পথের ধারের ডাকবাক্সগুলি উধাও হইয়া গিয়াছে। ডাক হরকরাও নিখোঁজ । তবে ? তবে আর কি? এই যন্ত্র মাধ্যমই একমাত্র ভরসা এখন, তাই ইহারই শরণ লইলাম। আমাদিগের কাল তো কবেই কালের গর্ভে বিলীন হইয়া গিয়াছে।
নতুন বছর আগতপ্রায়। পত্রের দ্বারা কুশল বিনিময় এখন দুরাশা মাত্র। আমাদিগের কালে সমাচার বিনিময়ের মাধ্যম ছিল পত্র। দূর - দূরান্তে পত্র প্রেরণ করিবার জন্য পত্র লিখন ছিল সুখকর। পত্র রচনা করিয়া যেমন আনন্দ অনুভূত হইত, তেমনই প্রত্যুত্তরের আশায় মন উন্মুখ হইয়া রহিত। পত্র আদান - প্রদানের দ্বারা মনের ভাব, ভাষা, রুচি ব্যক্ত হইয়া উঠে। পত্র, সাহিত্য হইয়া উঠে যখন লিপি রচক তাহার হৃদয়ের সকল দুয়ার খুলিয়া শব্দধারায় অবগাহন করিয়া নিজেকে মেলিয়া ধরে। পত্র সাহিত্য সম্বন্ধে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বক্তব্য ছিল এইরূপ - " যাহারা ভালো পত্র লেখে তাহারা মনের জানালার ধারে বসিয়া লেখে, আলাপ করিয়া যায়, তাহার কোনো ভাবও নাই , বেগও নাই শুধু স্রোত আছে ।"
পত্রালাপের মাধ্যমে মানুষ তাহার হৃদয়ের উত্তাপ বিকিরণ করে। প্রতিটি পত্রই এক একখানি উষ্ণ হৃদয়ের বাহক। নিরুচ্চারিত কথা চিঠির মাধ্যমে উচ্চারিত হয়। যাহা চলভাষ বা দূরভাষের দ্বারা সম্ভব নহে । চলভাষে বাক্যালাপ যদিও তাৎক্ষণিক সমস্যা সমাধান করে , কিন্তু মনের আলাপ - প্রলাপ ব্যক্ত করিবার সুগম পথ হইল পত্র।
অধুনা, আমরা উন্নত যান্ত্রিক যুগে পদার্পণ করিয়াছি। তাই কিছুটা হইলেও নিজেকে এই যুগের উপযোগী করিয়া লইতে হইবে। নচেৎ পিছাইয়া যাইব যে? এই উন্নত যন্ত্র যুগের সুযোগ - সুবিধা আমিও তো ভোগ করিতেছি। আমরা যাচিয়া একাকীত্ব বরণ করিয়াছি, তাই যন্ত্রই এখন আমাদের নিত্য সঙ্গী ।
এই যান্ত্রিক সভ্যতার কবলে পড়িয়া শিশু মনের সুকুমার বৃত্তিগুলি প্রস্ফুটিত হইবার পথ হারাইয়াছে।
ইদানিং , অবকাশ বিনোদনের ধরণও সম্পূর্ণ যান্ত্রিক। তাহাতে না থাকে মনের সন্তোষ বিধান, না থাকে আত্মিক যোগ। শুধু মাত্র কাল কাটাইবার জন্য কাল যাপন।
সম্প্রতি, অবসর বিনোদনের জন্য অত্যাধুনিক এবং চিত্তাকর্ষক নানাবিধ সরঞ্জামের উদ্ভাবন হইয়াছে। বোতাম টিপিলেই গৃহাভ্যন্তরে থাকিয়াও বহির্বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন এবং বহির্জগতের সমগ্র চিত্র নয়ন সম্মুখে উদ্ভাসিত হয়। সুতরাং আমাদিগের ন্যায় প্রবীণ - প্রবীণাদের আর একাকীত্বের ভয় নাই! তবুও শুধুমাত্র কর্ণকুহরে শব্দসুধা আর নয়নাভিরাম দৃশ্য সব সময় হৃদয়গ্রাহী নাও হইতে পারে। সেই সকল সময় আপনজনের উষ্ণ সান্নিধ্যের জন্য মন ব্যাকুল হইতেই পারে।
পত্রালাপ এখন ইতিহাসে পরিণত হইয়াছে। বর্তমান প্রজন্ম পত্রালাপের রসাস্বাদন হইতে বঞ্চিত। তাহারা পত্র বলিতে বোঝে, বিদ্যালয়ের পাঠ্য পুস্তকের অন্তর্ভুক্ত ব্যকরণ পত্র লিখন। অবশ্য এই প্রজন্ম তীক্ষ্ণ মেধার অধিকারী। তাহারা সময়ের মূল্য সম্বন্ধে অত্যন্ত সজাগ। একটি সম্পূর্ণ বাক্য লিপিবদ্ধ করিবার এবং পাঠ করিবার মতো সময় তাহাদের নাই। অতি সংক্ষিপ্ত বর্ণ অথবা প্রতীক চিহ্ন দিয়াই চলভাষের মাধ্যমে তাহারা বাক্য বিনিময় করে।
আজ, চিঠিখানি লিখিতে বসিয়া বিগত দিনের স্মৃতি বারংবার মানসপটে উদ্ভাসিত হইতেছে। নয়নযুগল বাষ্পাকুল হইয়া উঠিতেছে। বাঁধ না মানা বারিস্রোতে বর্ণগুলি অস্পষ্ট হইতেছে। অতীতে যাহারা পত্রালাপের আস্বাদ পাইয়াছে, কেবলমাত্র তাহারাই এই চিঠির মর্ম বুঝিতে পারিবে।
যাহা হউক, মার্জনা চাহিয়া লইতেছি চিঠি দীর্ঘায়িত করিবার জন্য, আর পাঠকবর্গের মূল্যবান সময় অপচয় করিবার জন্য।
সকলের সর্বাঙ্গীন কুশল কামনা করিয়া অদ্য চিঠিখানি সমাপ্ত করিলাম।
ইতি --
শিখা সরকার।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴