সহজ উঠোন

রেজিস্টার / লগইন করুন।

সব কিছু পড়তে, দেখতে অথবা শুনতে লগইন করুন।

Sahaj Uthon
05-November,2023 - Sunday ✍️ By- দেবপ্রিয়া সরকার 362

অপেক্ষা/দেবপ্রিয়া সরকার

অপেক্ষা
দেবপ্রিয়া সরকার  
----------------------

“আরে ভাই দেখে গাড়ি চালা, রাস্তাটা তোর বাপের নাকি?” গলায় একরাশ বিরক্তি নিয়ে চেঁচিয়ে উঠল অংশু। গতকাল কয়েক পশলা বৃষ্টি হয়েছিল, তাই রাস্তার খানাখন্দে এখনও কিছুটা জল জমে আছে। ফুটপাত ঘেঁষে হাঁটার সময় কোত্থেকে এক এঁড়ে ড্রাইভার সেই জলভর্তি গর্তের ওপর দিয়ে গাড়ি হাঁকিয়ে ঝপ করে বেশকিছুটা কাদাজলের ফোয়ারা তুলে চলে গেল। তারই সামান্য ছিঁটে এসে লাগল অংশুর গায়ে। 
পাক্কা একবছর হল অংশু বেকার। সংসার চালানোর জন্য দিনরাত সে লড়াই করছে। অথচ অংশুর কপাল এমনটা ছিল না। মতিলাল কলেজ থেকে বি.কম পাশ করার পরই একটা ভদ্রস্হ চাকরি জুটিয়ে ফেলেছিল সে। বাদামতলার দেশলাই ফ্যাক্টরির তখন বেশ রমরমা অবস্থা। খবরের কাগজে সুপারভাইজার পোস্টের জন্য ওয়াক-ইন-ইন্টারভিউয়ের বিজ্ঞাপন দেখে সেখানে উপস্থিত হয়েছিল অংশু। জনা পঁচিশেক চাকরীপ্রার্থীর মধ্যে থেকে ঝাড়াই বাছাই করে তাকেই সিলেক্ট করা হয়েছিল। 
পাঁচটা বছর চুটিয়ে কাজ করেছে অংশু। দুই দিদির বিয়ে দিয়েছে। বয়স্ক মাকে নিয়ে কোনওরকমে সংসারে থিতু হবে ভাবছিল, এমন সময়ে করোনা এসে সব ঘেঁটে দিয়ে গেল। লকডাউনে বিরাট ক্ষতি হল ব্যবসার। তারওপর শ্রমিক ইউনিয়নের চাপে পড়ে মালিক ফ্যাক্টরিতে তালা ঝোলাতে বাধ্য হল। অংশুর মতো আরও অনেক কর্মচারী কর্মহীন হয়ে গেল একধাক্কায়। 
“এই যে বুড়োদা আমি চলে এসেছি। টাইম ঠিক আছে তো?” হাসিমুখে বুড়োদার পানের দোকানের সামনে এসে দাঁড়াল অংশু। বুড়োদা পানপাতায় চুন ঘষতে ঘষতে বলল, “এসে পড়েছ? তা বেশ। আমি সব ব্যবস্থা করে রেখেছি। আগে দেখে নাও, তারপর রেট ফাইনাল করা যাবে। ভাল জিনিসের জন্যে মালকড়ি একটু বেশি খসাতে হবে কিন্তু”। 
অংশু উৎসাহ নিয়ে বলল, “ও নিয়ে চিন্তা করো না বুড়োদা। মাসুদভাই বলেছে যত টাকা লাগে লাগুক শুধু দাদা খুশি হলেই হল”। 
“তবে তো মিটেই গেল”, পান বানানো ছেড়ে পকেট থেকে মোবাইল বের করে কারও সঙ্গে সাংকেতিক ভাষায় কথা বলল বুড়োদা। তারপর গা ঝাড়া দিয়ে উঠে বলল, “চলো”
সন্ধ্যা পেরিয়ে এখন রাত নেমেছে। বুড়োদার পেছন পেছন মিনিট পাঁচেক হেঁটে চাপা গলির ভেতর ঢুকল অংশু। টিনের চালা দেওয়া একটা বাড়ির কাছে এসে বুড়োদা দরজা ধাক্কাল। ভেতর থেকে শোনা গেল মেয়েলি গলা, “কে?”
“আমি বুড়োদা, কাজের খবর এনেছি। দরজা খোলো।” 
বুড়োদা কথা শেষ করতে না করতেই দরজাটা খুলে গেল। ভেতর থেকে রঙচটা নাইটি পরে যে মহিলা বেরিয়ে এল, তাকে দেখে খানিক থমকালো অংশু। মেয়েটিও অংশুকে দেখে যেন সামান্য হোঁচট খেলো। যদিও কেউই মুখে কিছু প্রকাশ করল না। বুড়োদা আগ বাড়িয়ে বলল, “এই হল সুমি। এর কথাই বলেছিলাম তোমাকে। খুব করিতকর্মা মেয়ে। ওর কাজ নিয়ে কেউ কোনও কমপ্লেন করে না।” 
জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সুমির দিকে একপলক তাকিয়ে আলতো করে অংশু মাথা নাড়ল। বুড়োদা স্বস্তির শ্বাস ফেলে বলল, “তোমরা নিজেদের মধ্যে কথা বলে সব বোঝাপড়া সেরে নাও। আমি চললাম। আর হ্যাঁ, আমার পাওনাটা ঠিক সময়ে পৌঁছে দিতে ভুলো না, হেঁ হেঁ হেঁ!”
হাসি মুখে বুড়োদা বিদায় নিতেই হিসহিসে গলায় সুমি বলল, “শালা, দালাল কোথাকার! তিনকাল গিয়ে এককালে ঠেকেছে এখনও দালালির কমিশন নিতে ভোলে না। শালার নরকেও স্হান হবে না”। 
অংশু গলাটা পরিস্কার করে বলল, “যদি আমি ভুল না করি তবে তুমি সুমৈত্রী দত্তরায়, মতিলালা কলেজে বি.কম পড়তে, রাইট? কিন্তু তুমি এখানে? এভাবে...”
সুমি একটা দুর্বোধ্য হাসি হেসে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, “হ্যাঁ ঠিকই ধরেছ। আমি সুমৈত্রী, থার্ড সেমের ড্রপ আউট, ভাগ্যের বিড়ম্বনার আজ শহরের কয়েকশো কলগার্লের মধ্যে একজন। টাকার বিনিময়ে তোমাদের মতো বড় লোকদের কাছে নিজের মাংস বিক্রি করি। আর কিছু?” 
মুহুর্তের মধ্যে অন্ধকারাচ্ছন্ন, স্যাঁতস্যাঁতে গলির জায়গায় অংশুর চোখের সামনে ভেসে উঠল এক রোদ ঝলমলে শরতের সকাল, সবুজ ঘাসে ঢাকা মাঠের মাঝে বানানো স্টেজ আর লাল-নীল-সবুজ রঙে ভরা কলেজ ফেস্টের ছবি। এই ফেস্টেই প্রথম অংশুমান নামের লাজুক ছেলেটি এক মেঘরঙের মেয়ের প্রেমে পড়েছিল। কিন্তু বলি বলি করেও মনের কথাটা বলে উঠতে পারছিল না। অবশেষে যেদিন সাহস জুটিয়ে লাল গোলাপ হাতে নিয়ে কলেজে এল হৃদয় উজার করে নিজের ভালবাসা জাহির করবে বলে, সেদিন মেয়েটি কলেজে এল না। তার পরদিনও এল না, তার পরদিনও না। অংশুমান তার পথ চেয়ে অপেক্ষাই করল শুধু। তার সহপাঠীরা জানাল, সুমৈত্রী বাড়ি থেকে পালিয়ে বিয়ে করেছে কোনও এক অবাঙালি ছেলেকে। তার বাবা-মা তাদের মেনে নেয়নি। তাই তারা এই শহর ছেড়ে চলে গিয়েছে অন্য কোথাও। তার খবর কেউ জানে না। 
সেই শুকনো গোলাপখানা অংশুমানের ব্যর্থ প্রেমের স্মৃতি হয়ে আজও রয়ে গিয়েছে বইয়ের ভাঁজে। 
“তুমি তো সেই অংশুমান, যে লাইব্রেরিতে বসে বইয়ের আড়াল থেকে আমাকে লুকিয়ে দেখত?” 
সুমির কথায় সম্বিৎ ফিরল অংশুর। সে লাজুক চোখে সুমির দিকে তাকাল। চরম পেশাদারি গলায় সুমি বলল, “বুড়োদা নিশ্চয়ই তোমাকে আমার রেট বলে দিয়েছে? কোথায় যেতে হবে বলো। আমি তৈরি হয়ে নিচ্ছি”। 
অংশু কিছুক্ষণ বিহ্বলভাবে তাকিয়ে থাকল সুমির দিকে। তারপর নরম গলায় বলল, “সে হবে’খণ। এ্যাদ্দিন বাদে দেখা হল, আগে একটু গল্পগুজব করি। বড্ড তেষ্টা পেয়েছে। একটু জল খাওয়াতে পারো?” সুমি বিস্মিত হয়ে বলল, “নিশ্চয়ই পারি। তুমি ভেতরে এসে বসো। আমি জল আনছি”। 
দরমার বেড়া দেওয়া একচালা ঘর। আসবাব বলতে একখানা ট্রাঙ্ক, কাঠের টেবিল, দুটো প্লাস্টিকের চেয়ার আর তক্তপোশ। দেওয়ালের একপাশে টাঙানো দড়িতে জামাকাপড় ঝুলছে। সাধারণ হলেও বেশ পরিস্কার পরিচ্ছন্ন ঘরদোর। সুমি স্টিলের গ্লাসে জল আর দুটো সস্তার বিস্কুট তার সামনে এগিয়ে দিল। ঢকঢক করে জলটুকু শেষ করে অংশু বলল, “এখানে তুমি একাই থাকো?”
“হ্যাঁ।”
“তোমার স্বামী, সন্তান...”
অংশু কথা শেষ করার আগেই সুমি বিষন্ন গলায় বলল, “সন্তান নেই। স্বামী ছিল, কিন্তু এখন কোথায় আছে জানি না”।
“মানে?”
“সে অনেককথা অংশুমান। সেসব শুনে কী করবে?”
“তুমি না চাইলে বলার দরকার নেই।” 
সুমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “না বলার মতো বিশেষ কিছু নেই। কিষণদের পারিবারিক শাড়ির ব্যবসা ছিল। বিহারের মধুবনী থেকে সে প্রায়ই আমাদের বাড়ি আসত শাড়ি বিক্রি করতে। ওর হাসিখুশি সুপুরুষ চেহারা, ভাল ব্যবহার সকলের মন জয় করে নিয়েছিল। আমার তখন কাঁচাবয়স। কীভাবে যেন আমার থেকে দশ বছরের বড় সুদর্শন, প্রাণোচ্ছল মানুষটার প্রেমে পড়ে গেলাম। সুযোগ বুঝে তাকে জানিয়ে ফেললাম মনের কথাটা। প্রথমে আপত্তি করলেও পরে সেও রাজি হয়ে গেল। তারপর দুঃসাহসে ভর করে একদিন ঘর ছাড়লাম কিষণের ভরসায়। সে প্রথমে আমাকে নিয়ে গেল তার দেশের বাড়ি বিহারে। শাড়ির কারবারের জন্য কিষণকে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে হতো। আমিও যেতাম ওর সঙ্গে। প্রথম প্রথম এই বোহেমিয়ান জীবন খুব উপভোগ করতাম। কিন্তু ধীরে ধীরে আমরা দু’জনেই বিরক্ত হয়ে উঠছিলাম। আমাদের মন, মানসিকতা, আচার, অনুষ্ঠানের ফারাকটা দিন প্রতিদিন প্রকট হয়ে উঠছিল। কেউই কাউকে খোলা মনে মেনে নিতে পারছিলাম না। বছর তিনেক এভাবে চলার পর আমার শহর, পরিবার, বাবা-মা, দিদি, যাদের বন্ধনকে অগ্রাহ্য করে চলে গিয়েছিলাম, তাদের একবার দেখার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠলাম। কিষণকে সঙ্গে নিয়ে ফিরে এলাম এই শহরে। দেখলাম আমাদের পুরনো এজমালি বাড়ি ভেঙে সেখানে ফ্ল্যাট উঠছে। খবর নিয়ে জানলাম বাবা-মা আমার পালিয়ে যাওয়ার লজ্জা থেকে বাঁচতে এখানকার বাস তুলে দিদির সঙ্গে কলকাতায় চলে গিয়েছে। যাবার আগে বলে গিয়েছে তাদের ছোটমেয়ে সুমৈত্রী তাদের কাছে মৃত। কিষণ আবার আমাদের পুরনো পাড়ায় ব্যবসা শুরু করবে বলে মনস্হির করল। আমরা এই শহরের এককোণে ডেরা বাঁধলাম। আর তারপরই এলো কোভিড অতিমারি। ব্যবসাপত্তর বন্ধ করে ঘরে বসে পড়ল কিষণ। দুটো ভাত জোগাড়ও অসম্ভব হয়ে উঠছিল। তখনই কিষণের সঙ্গে পরিচয় হয় পাড়ার পানওয়ালা বুড়োদার। পানের দোকানের আড়ালে যৌনকর্মীদের দালালি করে সে। তার কাছ থেকে প্রস্তাব পেয়ে কিষণ জোর করে আমাকে। প্রথম যেদিন কথাটা শুনেছিলাম সেদিনই গলায় দড়ি দেওয়ার ইচ্ছে হয়েছিল। কিন্তু পরে ভেবে দেখেছিলাম আমি তো আমার আপনজনদের কাছে মৃত। আমার নিজের কাছেও সুমৈত্রী দত্তরায়ের আর কোনও অস্তিত্ব নেই। তাই সুমি হয়ে নিজের এই জীবন্মৃত শরীরের সওদা করে যদি আরেকজন মানুষের খাওয়াপরার ব্যবস্থা করতে পারি, তাতে ক্ষতি কী? বুড়োদার কল্যাণে ওই দুঃসময়েও বেশ কিছু কাস্টমার জুটে যাচ্ছিল। করোনার প্রকোপ কমতেই কোনও কিছু না বলে একদিন আচমকা উধাও হয়ে গেল কিষণ। অনেক খোঁজ করলাম কিন্তু তার কোনও সন্ধান পেলাম না। আসলে কেউ যদি ইচ্ছে করে হারিয়ে যেতে চায়, তাকে খোঁজার চেষ্টা করাটাই বৃথা। সেই থেকে একলা আমি বেঁচে আছি শুধু বেঁচে থাকার তাগিদে”। 
কথা শেষ করে সুমি আড় চোখে একবার চেয়ে নিল অংশুর দিকে। তারপর ধরা গলায় বলল, “এই বেশ ভাল আছি, জানো? শরীর বেচে খাচ্ছি। নিজের মতো জীবন কাটাচ্ছি। তা তুমি হঠাৎ ঘর-সংসার ফেলে পচা মাংস খেতে এলে যে? কোথায় নিয়ে যাবে আমাকে?” 
অংশু বলল, “আজ নয়, সময় হলে নিয়ে যাব। তোমার কনটাক্ট নম্বর দিয়ে দাও আর এই টাকাটা রাখো অ্যাডভান্স হিসেবে।” 
তার পারিশ্রমিক হিসেবে মাসুদের দেওয়া একটা পাঁচশো টাকার নোট সুমির হাতে গুঁজে দিয়ে বেরিয়ে এল অংশু। গলি ছেড়ে রাজপথে এসে সে পকেট থেকে ছোট মোবাইল বের করে ফোন লাগাল মাসুদকে। তাদের এলাকার উঠতি বড়লোক মাসুদ হুসেন। অংশু আজকাল তার হয়ে টুকটাক কাজ করে দেয়। বদলে মাসুদ কিছু টাকাপয়সা দেয় অংশুকে। মাসুদের বিলাসবহুল রেস্তোরাঁ কাম রিসোর্ট উদ্বোধন করতে আগামীকাল কলকাতা থেকে মন্ত্রী আসবেন। তাঁর রাতটা রঙিন বানানোর জন্যেই বুড়োদার কাছে ছুটে এসেছিল অংশু। ফোনটা মুঠোয় ধরে অংশু বলল, “বুড়োদাকে দিয়ে হবে না মাসুদভাই। ওর মাল চলবে না। মন্ত্রীমশাই পছন্দ করবেন না এই মেয়েকে। তুমি অন্য কোনও সোর্স লাগাও”। 
ফাঁকা রাজপথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল অংশু। সে সুমিকে কথা দিয়ে গিয়েছিল একদিন এসে নিয়ে যাবে তাকে। সেই থেকে রোজ সন্ধ্যায় অংশুর জন্য অপেক্ষা করে সুমি। কত অজানা অচেনা মানুষ আসে তার শরীরের সওদা করতে কিন্তু অংশুমান আর ফিরে আসে না সুমৈত্রীর কাছে। 

আপনাদের মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴
software development company in siliguri,best
                          software development company in siliguri,no 1 software
                          development company in siliguri,website designing company
                          in Siliguri, website designing in Siliguri, website design
                          in Siliguri website design company in Siliguri, web
                          development company in Siliguri