অন্তরতম/অর্পিতা মুখার্জী চক্রবর্তী
অন্তরতম
অর্পিতা মুখার্জী চক্রবর্তী
সহজ পাঠের অ আ ক খ-র সঙ্গে সাদা কালো ছবিগুলি ও সেগুলির নীচে তাঁর লেখা অনবদ্য সহজ সরল দুটি করে পংক্তি সে অর্থে তাঁকে চেনার প্রথম সোপান হয়েও শিশু বয়সে নয়ও হয়তো ঠিক সেভাবে। অভ্যেসের হাতেখড়ি হিসেবে অনুশীলন বজায় থাকলেও সেই ছোট্ট বয়সে এর কারিগর যে রবি ঠাকুর সে নামটি কানে গেলেও মনে থাকতো খুব কম কারোরই। তবুও কেমন আশ্চর্য ভাবে তিনি মিলেমিশে রয়ে যেতেন শিশুদের রাজ্য জুড়ে। 'কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা' বা 'ফুলে ফুলে ঢোলে ঢোলে',' মম চিত্তে নিতি নৃত্যে', 'হারে রেরে রেরে' এসব গানগুলির সঙ্গে নাচ করেনি, 'তালগাছ',' 'প্রশ্ন', ' দামোদর শেঠ' কবিতাগুলি নিজের নিজের মতো ঠিক বা কিছুটা ভুলচুক করে মঞ্চে উঠে বলেনি বা 'মেঘের কোলে রোদ হেসেছে', ' ও জোনাকি' এই গানগুলি ছোটবেলায় একবারও গায়নি এমন শিশু খুঁজলেও মেলা ভার।'অ- কার' থেকে ' চন্দ্রবিন্দু' ব্যবহারের সহজতাকে ছোট ছোট শিশুদের নিখাদ সারল্যের মতোই সহজ সরল ভাবে এবং বর্ণমালা, যুক্তাক্ষর চেনানোর কত অভিনব এক প্রয়াস তিনি সহজ পাঠের মাধ্যমে নিজের মতো করে সেসময় করে গেছেন ভাবলেও আশ্চর্য হতে হয়।' সহজ পাঠ ' তাই রচয়িতাকে পুরোপুরি না জেনে, না চিনেও সহজাত সহজিয়া হয়ে পৌঁছে গেছে শিশুদের মনের দোরগোড়ায়। শিশু মনের কত না জিজ্ঞাসা,কৌতূহল, দুষ্টুমি , আবেগ, ভালোবাসা, খেলার প্রহর উঠে এসেছে তাঁর 'শিশু' কাব্য গ্রন্থের ছত্রে ছত্রে। এ হেন ভালোলাগার কাজটি যিনি এত সহজ সরল ভাবে করলেন, তাঁকে ভালো না বেসে উপায় থাকে!সেখান থেকেই তাঁর সঙ্গে প্রাণের আলাপ।তিনি তাঁর সেই লেখাগুলির মাধ্যমে নিজেও একজন শিশু হয়ে মিশে গেছেন অগুন্তি কচিকাঁচার ভিড়ে।
আমার মূলত ছোটদের ভালোবাসতে শেখা এবং মনের কোণে আরো নানান পটপরিবর্তনের ইঙ্গিত তাঁরই হাত ধরে।সহজ পাঠের শুরুতে ছোট খোকার সেই ছবিটিকে বইয়ের পাতার বাইরে এনে কোলে তুলে নেবার ইচ্ছে হয়েছিল সেই প্রথম দেখার দিনটি থেকে। শিশু কাব্যগ্রন্থের বাবলারানীও সেই একইভাবে মন টেনেছিল। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কিছুটা পরিণত বয়সে সহজ পাঠের সেই ছোট খোকা, শিশুর বাবলারাণী, শিশু ভোলানাথের দুষ্টু এরা সবাই 'জন্মকথা'- র সেই 'ইচ্ছে' হয়ে ঠাঁই নিয়েছিল মনের মাঝে। প্রথম দিকে পড়া যে 'লুকোচুরি' মায়ের সঙ্গে লুকোচুরি খেলার এবং সমস্ত খেলার শেষে আবারও মায়ের কাছে ফিরে আসার মিষ্টি ছবিটি এঁকেছিল, সেই কবিতাই একটি সময়ে 'মা', 'মা' এক অনুরণন হয়ে একবুক চাঁপার গন্ধে মেশা এক দুষ্টু খোকার ছবি এঁকেছিল মনে। বীরপুরুষ কবিতাটিও ছোট্ট এক বীরপুরুষের স্বপ্ন বেঁধেছিল মনের দোরগোড়ায়।অনুভবের গভীরে গিয়ে মেয়েবেলা থেকে মা-এ উত্তরণ ঘটেছিল কত সহজেই সময়েরও অনেক আগে তাঁর সৃষ্ট শিশু চরিত্রগুলির হাত ধরে।কাবুলিওয়ালার মিনির গল্প শুনে সেসময় ছোট্ট নিজেকেও মিনি বলেই মনে হত হয়তো আমার মতো অনেকেরই।অতিথির তারাপদর জন্য বুকের মধ্যে যে অদ্ভুত এক কষ্ট আবার এমন একটি চরিত্রের প্রতি অকৃত্রিম টান ভালোবাসার সুপ্ত বোধকে জাগিয়ে তুলেছিল নিভৃতে। 'শাস্তি' গল্পের চন্দরা পরিপূর্ণ এক অভিমানী নারীর বুনোটে হৃদয়ে 'নারী' কথাটির সংজ্ঞা লিখেছিল প্রথম। মনে মনে নিজস্ব প্রেমের অভিষেকে জড়িয়ে থাকে তাঁর পূজা পর্যায়ের অগণিত গান যা প্রেমে পর্যবসিত হয়ে আশ্চর্য সুন্দর এক ভাবধারায় উন্নীত।আর জড়িয়ে থাকে তাঁর সৃষ্ট সন্ন্যাসী উপগুপ্ত ও বাসবদত্তা,অমিত ও লাবণ্য, পোস্টমাস্টার ও রতন, অপূর্ব ও মৃন্ময়ী, অন্য রকম এক ভালোবাসার উঁকিঝুঁকি নিয়ে মনে দোলা জাগিয়ে অমল ও চারু, অর্জুন ও চিত্রাঙ্গদা।গান, গল্প, উপন্যাস,কবিতা, গীতি আলেখ্য, নৃত্যনাট্য- এর সোনার কাঠির ছোঁয়ায় নানান রঙের অনুভূতিরা পাখা মেলে, ঠিকানা খুঁজে পায় আবার সময় ও পরিস্থিতির সঙ্গে তার অর্থ বদলে যায় নিজস্বতার ছোঁয়া নিয়ে;এক জীবনে যত অল্পই সেগুলি আমাদের ধরাছোঁয়ার নাগালে আসুক না কেনো।'সঞ্চয়িতা' মনের ঘরের দেরাজের সেরা তাকটিতে সঞ্চয় করে রাখবার মতো আজীবনের এক অমূল্য সংগ্রহ। নিজে নিজে পড়বার আনন্দ তো ছিলই, তারও অধিক আনন্দ যোগ হয়েছে বেশ কিছু কবিতা নানান সময়ে মেয়ের বলায়। সেই চেনা কবিতাগুলি আরো অনেকগুলি বছর পার করে অন্য এক মাত্রায় ধরা দিয়েছে তখন যেন। আনন্দে তিনি, পার্বনে তিনি, প্রেম, বিরহ, মিলন, শোক সবেতেই তিনি তাঁর সৃষ্টির ভান্ডার নিয়ে বড় বেশি উজ্জ্বল। তাঁকে জড়িয়েই সুখ দুঃখের প্রতিটি অনুভুতির উদযাপন সরবে বা সংগোপনে।তিনিই ত্রাতা, তিনিই বন্ধু, তিনিই পথপ্রদর্শক,পরম পিতা ও শ্রেষ্ঠ দার্শনিক।তাই তাঁর হাত ধরেই জীবনের পথচলা ভাঙা গড়ায়, ওঠা পড়ায়।তিনিই শক্তি, তিনিই সাহস, তিনিই বিরহে মধুর মনকেমন ও প্রাপ্তিতে আনন্দাশ্রু।মন যেন তাই তাঁর থেকে বিমুখ না হয়, হাত যেন তাঁর হাত না ছাড়ে...
সবারও সঙ্গে যেন অবিরত তোমারও সঙ্গ রাজে।
নিমেষে নিমেষে নয়নে বচনে, সকল কর্মে, সকল মননে,
সকল হৃদয়তন্ত্রে যেন মঙ্গল বাজে।।
আজি প্রণমী তোমারে চলিব,নাথ,সংসার কাজে।
তুমি আমার নয়নে নয়ন রেখো অন্তর মাঝে।।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴