অনুভূতির জঙ্গলে/সুদর্শন ব্রহ্মচারী
অনুভূতির জঙ্গলে
সুদর্শন ব্রহ্মচারী
Aristotle-এর মধ্যে হাঁটতে গিয়ে বমকে গেছি, বিন্দু না গড়ালে রেখায় মন লাগছে না। কিন্তু বিন্দু এল কোত্থেকে খোঁজার কী যে ঘোর উপচে পড়া হৃদয়ে মুখ গুঁজে আকাশ দেখেই চলেছি...দেখেই চলেছি। গ্রহতারা রাত্রিটাকে ঠেলেই চলেছে কিন্তু ভোর না হওয়া পর্যন্ত দিনের চাকা গড়াচ্ছেই না। দেখাদেখি যেন মায়ার ইচ্ছায়। ভোরের জঙ্গলে নিশিফুলের মধু যায় যায় আর দিনের যত ফুল চোখ খুলি খুলি, সবে গন্ধ জমছে, মধু গাঢ় হচ্ছে। কিচিরমিচিরে মাটির প্রেম উচ্চকিত। বনভূমি জুড়ে নাটকের প্রস্তুতি। ব্যাঙেরছাতায় পা পিছলে পড়লেই আলুর দম। ভাগ্য পরিহাসের সুরে বলবে- ভাগো, জঙ্গল তোমাকে চাইছে না। মন বলবে- যা দেখতে পাই না তাই অন্ধকার, যা ধরতে পারি না তাই অধরা আর যা অন্ধকারে উজ্জ্বল তাই কল্পনা। দেখতে দেখতে অন্ধকারের ফাটলে আগুন আলো। জঙ্গল বর্ণময়। নদী, গাছ, পাখি, ধ্যানে বসে বসে আকাশ বাতাস জল জলচর চিনে নিচ্ছে। ক্যামেরা তাক করলেই পাখি হুসস, প্রজাপতি বিবর্ণ। তবুও আনন্দ। মর্মরধ্বনি কিংবা পাতার গন্ধ শুঁকে পথচলা মানেই ওপর ওপর চারপাশের জ্যামিতি বুঝে নেওয়া, মনক্যামেরায় ছবি তুলে রাখা, রঙের স্রোতে ভাসা। দেখার হাত ধরেই প্রশ্নের মুখে পড়েছি দেখার তরিকা ঠিক কেমন?
ওপর ওপর ছুঁয়ে যাওয়া কি দেখা? সে তো ঐ বইয়ের পাতায় আলো ফেলেই আলো নিভিয়ে দেওয়া কিংবা ধর্মকথা আওড়ে জগৎ বোঝার চেষ্টা। দেখতে দেখতে স্তব্ধ না হলেও কি দৃশ্য বুদ্ধির দরজায় টোকা দিতে পারে? দেখা মানেই কি মন-ক্যানভাসে রঙ তুলির কারসাজি নয়? কল্পনাই কি রঙের জোগান দেয় বলে মুগ্ধ হই? বইয়ের শব্দ মনের মধ্যে ছবি না আঁকলেও কি তার অর্থ মাথায় ঢোকে? বোধে আঁচড় না কাটলে কি সুন্দর অসুন্দরের ভাব ফোটে? শিশুমন কি তামাম বিশ্বকে রঙিন দেখে? কল্পনা কি বুদ্ধির জোরে জীবন পায়? কল্পনার হাত ধরে যতটুকু দেখা তার রেশই কি দৃশ্য?
উত্তর খুঁজছি জঙ্গলের গভীরতায়। বোধের পরিধিতে কথার পাহাড়। ঠিকঠাক দেখা কিন্তু প্রেমে পড়ার সামিল। অজান্তেই গুনগুন। বারবার ছেড়ে যেতে গিয়েও পিছন ফিরে দেখার টান কাটানো যায় না। দূরে গেলেও উপলব্ধিতে কিছু একটা থেকে যায়। তাই দেখার পর চোখ বুঝে স্তব্ধ হতে হয় নিজের দেখাটাকে দেখার জন্য।
চোখেরও দরজা জানালা আছে। ঠিক সময়ে না খুললে সব রঙ চোখ টানে না, সব জ্যামিতি ধরা দেয় না। বেআব্রু না হলে অন্তরে আলো ফোটে না যেমন কিনা কূপমণ্ডূক হাজার চেষ্টায়ও আকাশ ছুঁতে পারে না। যা কিছু দেখাশোনা বা বোঝা সবটাই কিন্তু ছাঁচে ফেলে মিলিয়ে নেওয়া। চেনা জিনিসের সঙ্গে তুলনায় স্বস্তি তো পথচলাও স্বস্তির। তাতেই ঘাড় থেকে না-বোঝার বোঝা নামিয়ে ফেলার আরাম। মন ফুরফুর। এমনি করে সকলেই পথ চেনে, খাদ্য চেনে, পৃথিবী চেনে আর চেনে সুখ-দু:খ-যন্ত্রণার সীমাহীন তালিকা। তবে নির্বোধের বোধ থাকলেও নিষ্প্রাণের বোধ নেই। গাছ দেখিয়ে কেউ বলছেন, বুদ্ধ নিজেকে বুঝতে বুঝতে বৃক্ষ হয়ে উঠেছেন। কেউ বলছেন, শংকরাচার্য মায়া শব্দের আড়ালে সব সত্য লুকিয়ে ফেলার ব্যবস্থা করেছেন। কেউ বলছেন, সব তত্ত্বই সুন্দর মরীচিকা! জঙ্গলের বাইরে এলেই মনে হয় অনন্ত ঢেউয়ে ভেসে যেতে যেতে ঘুম ভাঙল। উথালপাতাল মন শ্রীমুখের ছোটা ছুটিতেই ডুবে। এই আলো তো এই আঁধার। হাজার শব্দের ঢ্যারাপেটানোয় মনে হয় শব্দ ছাড়া কিছুই নেই। আনমনে প্রশ্নোত্তরে ভাসতে ভাসতে জঙ্গলের অস্তিত্বই ভুলে যাচ্ছি। ক্যানভাস থেকে চোখ সরিয়ে আমার অবস্থা দেখেই ব্লেক চোখ বুঝেই ক’টা শব্দ ছুঁড়ে দিলেন- দেখতে জানলে জগৎটাই কল্পনার জঙ্গল। ক্যামেরাটা প্রতিজ্ঞা করছে দেখা কী জিনিস কবিকে বুঝিয়েই ছাড়বে। শিকারি পাখির মতো তার দৌড়। মাঝপথে ওয়ার্ডসওয়ার্থ নিথর। চেপে ধরলাম- ব্লেকের কবিতাগুলো বুঝিয়ে দিন। হেসে বললেন- নদী আর জঙ্গল বুঝতে বুঝতে আমার পরমায়ু শেষ, জঙ্গল ব্যাপারটাই অনুভবের…তুমি বরং রবিঠাকুরকে ধর। ঠাকুরের দ্বারস্থ হলাম। প্রশ্ন করার সুযোগ না দিয়েই উপনিষদের ভেতর থেকে ইশারায় বললেন- চরৈবেতি চরৈবেতি। অগত্যা আবারও দৌড়। হৃদয় ছুটছে। মন ছুটছে। দিন ছুটছে। আঁধার নামতেই শ্রী শ্রী মন। স্বপ্নের মধ্যে বাঁশি বাজছে, অষ্টাবক্র মুনি হেঁটে যাচ্ছেন। যেই না ক্যামেরা তাক করেছি, দু হাত নেড়ে বললেন- মন-ফন ছাড়, গুলি মার, ও শুধু ভুলভাল কথা বলে। ভাবছি লোকটা মুনি নাকি পাগল! বিদ্রূপ ছুঁড়ে দিলাম- তো তুমি কি বৃত্ত? ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে আমার চোখের ভেতরে ঢুকে হেসে উঠলেন- হাঃ হাঃ হাঃ! লজ্জায় মরছি। মাথায় স্নেহ বুলিয়ে বললেন- বলতো বৃত্ত কে দেখছে তোমার ক্যামেরা না তোমার মন? আমি মন তোলপাড় করে শূন্য হাতে নিয়ে শূন্য। তিনি বলছেন- কি অত ভাবছ? কেন ভাবছ? বৃত্তের মধ্যে ত্রিকোণ গড়িয়ে দাও… চতুষ্কোণ থেকে শুরু করে বহুভুজ হাতের মুঠোয় এসে পড়বে। শূন্য বৃত্তটাকে গড়িয়ে দাও। আমার মতনই চার জোড়া বাঁকা চাঁদ পেয়ে যাবে। তাকিয়ে থাকো এক পাক ঘুরলেই ষোড়শ গোপিনী নেচে উঠবে। তবে সবটাই মায়া- মনের ভুল। তোমরা শংকরের কথাটা ঠিক বুঝতে পারোনি। জগতের সব কিছুই জোড়ায় জোড়ায়। তার অন্যথা কেউ দেখেনি। ক্যামেরা তাক করতেই ধর্মের যত ষাঁড় এককাট্টা। প্রতিবাদ মিছিল- খোদার ওপর খোদকারি চলছে না চলবে না। নতুন ভাবনা - খোদা এক না দুই? আনমনে হাঁটতে হাঁটতে শ্মশানঘাটের নির্জনতায় হাজির। অঘোরিদের আড্ডা। গাঁজার ধোঁয়ায় মহাকবি কালিদাস ভকভক- পৃথিবীটা উজ্জ্বয়িনীর কণিষ্ঠতমা গণিকা…কাদার তাল লেপে দাও… ক্ষীণকটি প্রগলভা নেচে উঠুক, আধুনিক বিদুষীর জন্ম হোক…। কাব্যসুধা মর্মে গেঁথে গেল, উপলব্ধিতে ধরা দিল দুটি শব্দ …সৃষ্টি প্রেমেই। চলার পথে সুর খেলছে। দারাসুকো গড়গড়া হাতে ডাকছেন। ঘাসবন মাড়িয়ে ছুটছি। উপনিষদের ভেতর থেকে তাল তাল সোনা উঠছে। বহুদূর থেকে পিথাগোরাস চেঁচাচ্ছেন- ওরা সবাই ত্রিকোণ, ওদের কৃষ্ণগহ্বরে পাঠিয়ে দাও। ক্যামেরা থতমত। স্বর্ণালী ত্রিকোণগুলোকে বস্তাবন্দী করে ঠেলে সরিয়ে অন্ধকার গর্তে ঠেলে ফেললাম। শতাব্দী পেরিয়ে গেল। আর্কিমিডিস মহুয়ার কলসিতে ডুব দিয়ে সাঁতার কাটতে কাটতে জিজ্ঞেস করছেন- অতিভুজটা সামলে রেখেছ তো? নতুন শব্দ, ভিরমি খাচ্ছি। চুপিচুপি Aristotle এর কানে তুললাম- গুরু অতিভুজ কী জিনিস? বুড়ো হেসে বললেন- কল্পনা তার প্রেমে পড়ে তারই মতো একটা বাচ্চা চেয়েছিল। যার নাম দেওয়া হবে ক্লোন। পিথাগোরাস কল্পনাকে দেখেই মুগ্ধ, কথা দিল- সুন্দরী, যেদিন তুমি অপরাজিতার মতো আমাকে গলিয়ে দেবে সেদিনই আমি বাষ্পীভূত ত্রিকোণের মতো তোমার ভেতরে ঢুকব। ফোঁটা ফোঁটা বীর্যই অতিভুজের জন্ম দেবে…চিরকাল আমি আমারই ক্লোন হয়ে বেঁচে থাকব। ঋষিবাক্য অক্ষয়। তাই প্রকৃতির বুকে লক্ষ ত্রিভুজ কিন্তু পিথাগোরাস এক ও অদ্বিতীয়। গাছে গাছে লতাপাতায় পিথাগোরাসকে খুঁজতে গিয়ে বিভুতিভূষণের মুখোমুখি। মুঠো মুঠো সোনার ধুলো ছুঁড়ে বললেন- ভ্রমণ তো শূন্য থেকে শূন্যে, চোখ বুজে কান পেতে দেখো। দেখতে দেখতে বনতুলসীর জঙ্গলে। চোখ বুজলেই কানের মধ্যে নৃত্য আর কান বুজলেই তরলিত সোনা…নদী নদী। সুবর্ণরেণুর স্রোতে ক্লিক ক্লিক ক্লিক। চোখকান খুলে দৌড়চ্ছি। বন্য সুরের প্রান্তে নন্দলাল চোখ ধাঁধানো রঙিন দেওয়াল, শালবনে রামকিংকর ঠকঠক ঠকঠক… মাটির গন্ধে অন্য সুর…বিনোদবিহারী চোখ বুজে কান পেতেছেন…কল্পনা ছবির পর ছবি ভাসিয়েই চলেছে। দেওয়ালের মাথায় অবনঠাকুর শেকড় ঝুলিয়ে সাতমিশালি গন্ধের গপ্পো করছেন আর আমার অন্তরে শ্রী বিদ্রোহিনীর মতো দৌড়ে দৌড়ে জঙ্গল আঁকছে।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴