অনির্বাণ আলোর দিশারী/মমতা পাল চন্দ
অনির্বাণ আলোর দিশারী
মমতা পাল চন্দ
হে অনির্বাণ আলোর দিশারী তুমিই তো জানো দরিদ্র, অন্ধ, অজ্ঞ কুসংস্কারাচ্ছন্ন ,
মানুষের হাড়ভাঙা পরিশ্রম আর মাটিভেজা ঘামে যুগ যুগান্তর ধরে বাহিত হয়ে চলেছে এ মানব সভ্যতা।
সভ্যতার ভিত্তিভূমি আসলে অনেকটাই গড়ে ওঠে সমাজের অশিক্ষিত অজ্ঞানী, অসচেতন মানুষের জীবন প্রবাহের দ্বারা। আর তাদের জীবনমরুতে আলো জ্বালাতে এবং সঠিক পথ দেখাতে হে ঈশ্বর পুত্র তুমি আবির্ভূত হয়েছিলে একদিন এ পৃথিবীতে। শ্রদ্ধাশীলেরা তোমার সম্পর্কে বলেন "He has Sacrificed his life for the benefit of Mankind". তোমার মত অনেক ক'জন যুগমানব দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালনের জন্য যুগে যুগে এ পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়েছেন। মানুষের চেতনা জাগরণের স্বার্থে নিজেকে হাসিমুখে নিঃশেষ করা এবং অত্যাচারী আততায়ীর দেওয়া অসহনীয় কষ্ট হাসিমুখে বরণ করে মানব কল্যানার্থে সে আততায়ীদেরই ক্ষমা প্রদর্শন এবং আশীর্বাদ বর্ষণ করে হে ঈশ্বরপুত্র তুমি দেখিয়েছিলে কিভাবে সাতের সত্তুরগুন বার অপরাধীকে ক্ষমা করতে হয়। আসলে এ সুন্দর পৃথিবীকে আলোর নিকেতন হিসাবে গড়ে তুলতে - ঈশ্বর সৃষ্ট জীবের জীবনবোধকে মানবতার আলোতে আলোকিত করতে - অপরাধীকে ক্ষমা প্রদর্শনের মাধ্যমে ধর্ম শিক্ষা দিতে প্রতিবাদের এই দুঃসাহসিক পদ্ধতি চিরকালই মানুষের চিত্তকে বিনম্র করে। রাজতন্ত্র বা সাম্রাজ্যবাদের অত্যাচারের প্রতিবাদে ক্রুশবিদ্ধ হওয়া , আগুনে আত্মাহুতি দেওয়া, হাসিমুখে চরম তাচ্ছিল্য করে ফাঁসিকাঠে মৃত্যুবরণ করা, অনশন এবং নিজ হাতে হেমলক বা বিষপানের মত আত্মাহুতি দেওয়া আত্মত্যাগী মানব পুত্রেরা মহামানব হিসাবেই যুগে যুগে পূজিত বা প্রাত প্রণমেয় হয়েছেন। কিন্তু আজও সাম্প্রদায়িকতা বা ধর্মান্ধতার কলুষমুক্ত হয়নি এ পৃথ্বী। বরঞ্চ পৃথিবীর বয়স যত বাড়ছে - প্রযুক্তির উন্নয়ন যত ঘটছে - ধর্মান্ধতার প্রগাঢ় অন্ধকারে আচ্ছন্ন হচ্ছে এ মানবসভ্যতা। ক্ষমতালোভী মানুষেরা ধর্মপ্রাণ মানুষের ধর্মপ্রীতিকে অশিক্ষা আর অজ্ঞতার সুযোগে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করছে। ফলে এক সম্প্রদায়ের হিংসার আগুনে ঝলসে যাচ্ছে - পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে অন্য সম্প্রদায়। আর এসব দেখে শুনে পৃথিবীকে হিংসার হাত থেকে বাঁচাতে না পেরে প্রতিনিয়ত ক্রুশবিদ্ধ হচ্ছে মানবতার বিবেক। ফলে একদিকে প্রকৃত শিক্ষিত মানুষের ধর্মের প্রতি উদারতা ও অনুরাগ বাড়ছে। অন্যদিকে স্বার্থান্বেষী মানুষের কাছে ধর্ম হয়ে উঠছে একটা বাহ্যিক আবরণ - একটা প্রদর্শনীর বস্তু। যার লাভ ঘরে তুলতে ব্যস্ত ক্ষমতাবান। ফলে ধর্ম সম্প্রদায় আর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার উন্মত্ত তাণ্ডবে বিদ্ধ এ পৃথিবী। মানুষের ধর্মীয় সম্প্রীতি - সহনশীলতার ইতিহাস হচ্ছে বিকৃত। জাতিদাঙ্গার বুলডোজারের তলায় গুড়িয়ে যাচ্ছে অসহায় মানুষের বাস,ঘর গৃহস্থালি, সাতপুরুষের ভিটে - ধোঁয়ার কুণ্ডলী হয়ে উবে যাচ্ছে আপনারজন- বেঁচে থাকার শেষ সম্বলটুকুও। আকাশে বাতাসে মা বোনের আর্তনাদ আর ধর্মান্তরকরণের দীর্ঘশ্বাস।
আজকের দিনে হে ঈশ্বরপুত্র - হে মানবপুত্র তোমরা কোথায় ? তোমরাই তো বলেছো সব ধর্মের মূল কথাই এক । যে ধর্ম মানবের কল্যাণ করে না - সে ধর্ম কোনো ধর্ম নয়। ধর্মের একমাত্র নির্যাস হলো মানবতা - যা মানুষকে ক্রমান্বয়ে শুদ্ধ হওয়ার এক নিরবচ্ছিন্ন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে চির প্রবহমান রাখে। যাতে মনের ভেতরের অবরুদ্ধ ভাবনাগুলিতে যেন কিছুতেই শ্যাওলা জমতে না পারে। যে মানুষের মধ্যে কৃত্রিম প্রাজ্ঞতার দম্ভ বা গাম্ভীর্য থাকে সে তো আসলে অহংকারী। কেননা সে তো নিজেকে সব সময় সব কিছুর থেকে খুব সন্তর্পনে সরিয়ে নিয়ে যাবার ব্যস্ততা বা চাতুর্য্যে আসলেই এক ধৈর্য্যহীন ফাঁপা মানুষ। এরকম শিক্ষিত মানুষের সংখ্যাই যদি সমাজে ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে যারা নির্ভয়ে নিজের মতামত টুকুও প্রকাশ্যে আনতে চায় না তাহলে সভ্যতার বোঝা টানা মানুষগুলোকে তুমি বা তোমরা ছাড়া কে বোঝাবে বল ? কে বোঝাবে যে - যে ধর্মই তুমি ধারণ কর না কেন, সব ধর্মের মূল কথাই এক - অপরের কল্যাণ করা। আর এ জন্যই মনুষ্য জীবন - যা তুমি একবারই পেয়েছো। একে ব্যর্থ হতে দিয়ো না। হতে পার তুমি পাপী! যদি ঈশ্বরের কাছে - নিজের বিবেকের কাছে কনফেশন না কর তাহলে পাপের বোঝা একদিন এত ভারী হয়ে যাবে যে তুমি টানতেই পারবে না। তাই নিজের ভিতরে যত হিংসে, যত ক্রোধ , যত উন্মত্ততা আছে তাকে দহন করে মনের ভার হালকা কর কনফেশন করে। নিজে ক্রুশবিদ্ধ হয়ে নিজের পূণ্য অন্যকে দান কর। জীবনে যদি ক্রুশবিদ্ধ না হও - যদি প্রতিনিয়ত মৃত্যুবরণের মত পরিস্থিতির সামিল না হও তাহলে তুমি জীবন চিনবে কি করে ? অন্যের যন্ত্রনা কষ্ট অনুভব করবে কি করে ? আর মানুষের আত্মত্যাগ বিনা সভ্যতার আনন্দস্নান কি করে সম্ভব ?
তাই হে মহাপ্রাণ তোমার মুখের দিকে তাকালে আমার তোমাকে যন্ত্রণাক্লিষ্ট অলক্ষ্যে ক্রন্দনরত বলে মনে হয় আজকাল ? মনে হয় মানুষের এত পাপের বোঝা যেন আর বইতে পারছো না তুমি। যেন মানুষকে তুমি এটাই বলতে চাইছো যে হে মানুষ নিজের ক্ষত বিক্ষত জীবন - হাত পায়ের তালু দেখিয়ে হাসি মুখে বলতে শেখো "These are the wounds of love". ক্ষমার ধর্ম স্মরণ করাতে চাইছো আবার যে "ক্ষমাই পরম ধর্ম"। জানো যীশু যেদিন গ্রাহাম স্টুয়ার্ট স্টেইন্সের স্ত্রী গ্লাডিয়াস স্টেইন্স তার অস্ট্রেলীয় খ্রীষ্ট ধর্ম প্রচারক স্বামী এবং নাবালক পুত্রদের উড়িষ্যার কেওনঝরে গাড়ির ভেতরে পুড়িয়ে মরার পরেও আততায়ীদের ক্ষমা প্রদর্শন করেছিলেন । আমি সেদিন বুঝেছিলাম ধর্মের মর্মবাণী আত্মস্থ করা কাকে বলে ! হাউ হাউ করে কেঁদেছিলাম সেদিন এক অচেনা মায়ের আত্মত্যাগ আর মাতৃত্ব দেখে যীশু। ধর্মাত্মা স্টেইনস্ তো তোমারই মত ক্ষমার ধর্মই শেখাতে গিয়েছিলেন। এই ঘটনার পর আততায়ীরা সন্যাস নেয় নি ঠিকই কিন্তু যে বার্তা গ্লাডিয়াস সারা বিশ্বকে দিলেন তাকে উপেক্ষা করার সাধ্য কার ?এই ঘটনাই তো প্রমাণ করে যে এত যুগ পরেও যীশু তোমার মানব কল্যাণের এবং আত্মাহুতির ধর্ম আজও সমাজে সমভাবে প্রবহমান। তাই এভাবেই মানবপুত্র তোমরা ঈশ্বরের দূত হয়ে বেঁচে থাকো সভ্যতার সূর্য অস্তমিত না হওয়া পর্যন্ত। এই ঘটনা মানুষকে কতটা নাড়া দিয়েছিল জানিনা কিন্তু যারা জীবনে শুধু পাহাড় নদী জঙ্গলে সৃষ্টিকর্তার দান আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য খুঁজে নিজের চোখকে পরিতৃপ্ত করতে যান তাদের কাছেও কাতর মিনতি করতে ইচ্ছে হয় যীশু । মনে হয় চিৎকার করে বলি হে মানুষ তোমরা শুধু মনকে নয় নিজের আত্মাকে - বিবেককেও পরিতৃপ্ত করতে শেখো। অন্তত যারা অনেক বড় পদ আয়েশ বিলাসের জীবন নির্দ্ধিধায় পরিত্যাগ করে নিজেকে মানুষের সেবায় নিয়োজিত করেছেন তাদের কথা শোনো। দেখবে তাদের উপলব্ধি সাধারণ মানুষের আয়েশি বিলাসী জীবনের চিন্তা চেতনায় বিহ্বলতা আনবেই আনবে। মানুষ তখন নিজের অস্তিত্ব খুঁজতে শুরু করবে অবলীলায়। কেননা এই সমাজে যেমন দুষ্কৃতি আছে - সাম্রাজ্যবাদীদের ক্ষমতার লোভ আছে - আছে হাজার হাজার পন্তিয়াস পীলাত। তার মধ্যেই কয়েকজন যীশু আছেন - আছেন এক একজন প্রমিথিউস - আছেন শ্রীচৈতন্য, রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দ এবং প্রকৃত ধর্মের পতাকাবাহী চিন্ময়ী মানুষ। যারা মানব সভ্যতাকে মানবতা থেকে দেবত্বে উত্তরণের পথ দেখিয়ে চলেছেন যুগ যুগান্তর ধরে। তাই অন্যেরা করবে আর আমি তাদের সমালোচক হবো এমনটা নয় প্রভু। তাই তো বহু মানুষ আজ প্রতিবাদী। আর প্রতিবাদ আছে বলেই তো এই পৃথিবীতে কোনো ফাঁকা জায়গা নেই। দমবন্ধ করা গুমোটে দাঁড়িয়েও নিজের বিবেককে যদি বেদখল হতে না দেয় মানুষ - যদি ধর্মান্ধ ধান্ধাবাজদের ধর্মের নামে অপপ্রচারের সামনে একটুও দিধাগ্রস্ত না হয় মানুষ - যদি নিজে বেঁচে অন্যকে বাঁচার রাস্তা তৈরি করে দেয় - যদি নিজের ভেতরে থাকা ভয়কে অন্যের ভিতরে সংক্রমিত না করে বা অপরাধী বেচারাদের ক্ষমা করেও যদি নিজের ভাবাদর্শকে পরমুখাপেক্ষীদের উজ্জীবিত করার মত পৃথিবীর কঠিনতম যুদ্ধে অবতীর্ণও হয় অন্তত দু'একটি ঘটনার প্রেক্ষিতেও পৃথিবীর রঙ নির্ঘাত বদলে যাবে। পৃথিবীর সব মাকে মাদার মেরী হবার দরকার নেই - মায়েরা শুধু নিজের নিজের সন্তানকে পাহারা দিক- তাদের কিছুতেই কক্ষচ্যুত হতে না দিক।
শুধু তোমার জন্মদিনে নয় যীশু - মায়েরা প্রতিদিন যেন মনুষ্যত্বের ছোট্ট একটি মোমবাতি জ্বালিয়ে রাখে নিজের কষ্টদীর্ণ সন্তানদের মনে - বুকের ওপর ক্রুশ আঁকতে যেন শেখায়। যেন মন্দির মসজিদ গির্জার সামনে অন্তত মালিন্যহীন মাথাটা স্বদর্পে নোয়াতে শেখে মানুষ। দেখবে বিপ্লব ঘটে যাবে মানুষের জাগ্রত বিবেকে। মানুষের মনস্তাত্ত্বিক গঠনে মানবিক দর্শন বড় জরুরী। যা এক উন্নত জীবনবোধ এবং জীবনযাত্রার পথে বাহিত করবে মানবসভ্যতাকে। যা এক দ্যোতনায় ধর্ম নিরপেক্ষ জাতীয় জীবন গড়ে তুলবে। অহিংসার বীজমন্ত্র বা বোধিমন্ত্র যদি প্রতিটি দেশের মৃত্তিকায় প্রোথিত করা যায় তাহলে মানুষের জীবনবোধ উর্বর হবে - মানবিকতার বিকাশ পুষ্টি বৃদ্ধি ঘটলে সব বর্বরতা অত্যাচার নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে একদিন। এটাও তো ভাবতে হবে যে ঈশ্বরপ্রদত্ত হয়ে বা ঈশ্বরের চিরকুট হাতে যে মহাপুরুষেরা যুগে যুগে এসেছেন এ ধরায় তাদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতেই তো মন্দির মসজিদ গির্জা। যেখানে বহু অনাহারী মানুষের অন্ন জোটে প্রতিদিন। তাই ধর্মান্ধতার নামে লুণ্ঠন আর বিধ্বংসী মনোভাব আখেরে মানুষের মুখের গ্রাস কেড়ে নেওয়াই তো বটে। ফলে বিপর্যস্ত জনসমষ্টির আর্তনাদ, দীর্ঘশ্বাস একদিন সীমাহীন ঘৃণা আর দুর্দমনীয় ক্রোধে পরিণত হয়ে পৃথিবীকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে দেবে যীশু।
তাই সভ্যতার নিদারুণ মৃত্যু ডেকে আনছে যে অন্ধকারময় সময় সেই সময়ে তোমার মত মহাপুরুষের ত্যাগ এবং জীবনীচরিত চর্চিত হোক আরও বেশি করে - মানবতার মোমবাতি জ্বলুক প্রতিটি গির্জা মন্দির মসজিদের প্রাঙ্গণে। যে প্রাঙ্গণের সিংহদুয়ারগুলো সব ধর্ম সম্প্রদায়ের মানুষের জন্য চিরকাল খোলা থাকবে - খোলা থাকবে এক একটি আলোর ঠিকানা হয়ে।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴