সহজ উঠোন

রেজিস্টার / লগইন করুন।

সব কিছু পড়তে, দেখতে অথবা শুনতে লগইন করুন।

Sahaj Uthon
02-March,2025 - Sunday ✍️ By- সৌরভ দত্ত 314

অনিন্দ্য সুন্দর, অ-পার্থিব/সৌরভ দত্ত

অনিন্দ্য সুন্দর, অ-পার্থিব
সৌরভ দত্ত

পার্থ। অনিন্দ্য সেনগুপ্ত। বীরপাড়া উচ্চ বিদ্যালয়ের কৃতী ছাত্র। আমি বলি, বীরপাড়া উচ্চ বিদ্যালয়ের সর্বকালের সেরা ছাত্র। আমার কাছে সেরা ছাত্র সে-ই, যে অনায়াস দক্ষতায় চমৎকার সমতা রক্ষা করতে পারে পড়াশোনা ও খেলাধুলা, এই দুইয়ের মধ্যে এবং সঙ্গে তার ব্যক্তিত্ব, সামাজিকতা, সহমর্মিতা, এসবের চমৎকার একধরণের মেলবন্ধনের উপস্থিতি চলে তালে তালে, স্বমহিমায়। সদ্য না-ফেরার দেশে পাড়ি দেওয়া অনিন্দ্য সেনগুপ্ত নয়, সেই স্কুলজীবনের অনিন্দ্য সেনগুপ্তর মধ্যেই গড়ে উঠেছিল এরকম এক বৈচিত্রময় গুণাবলীর অনন্য সমাহার। বাবা শ্রী অচিন্ত্য কুমার সেনগুপ্ত। আমাদের মাস্টারমশায়। পার্থর শরীরী গঠন আর স্যারের শরীরী গঠন বাহ্যিকভাবে এক। স্কুলের রুটিনে স্যারকে পরিভাষায় সংক্ষিপ্তাকারে লেখা থাকত AKSG রূপে। স্কুলে সাধারণত দুধসাদা জামা পরতেন স্যার। বহিরঙ্গে বেশ রাগী ছিলেন। বেত্রাঘাত করতেন, বুকে জড়িয়েও ধরতেন পরম স্নেহে। বোঝাই যেত, কড়া মানুষটির ভেতরে ছিল এক নিখাদ মমতাময় মন। ৪ঠা ফেব্রুয়ারি স্কুলের প্রতিষ্ঠা দিবসে বার্ষিক ক্রীড়া অনুষ্ঠানে স্যার ভীষণ সক্রিয়তার সঙ্গে স্প্রিন্ট ইভেন্টগুলি সামলাতেন অন্যতম বিচারক হয়ে, সাধারণত দৌড়ের সূচনাপর্বে। আমি বরাবরই দৌড়ে অংশগ্রহণ করে ব্যর্থ হয়ে তার মধ্যেই অনাবিল আনন্দের উপাদান খুঁজে পেতাম। এই সেদিন, ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে, পার্থর যেদিন শ্রাদ্ধানুষ্ঠান চলছিল, ভিডিও কলে পুত্রবিয়োগে বিপর্যস্ত স্যারের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে, তাঁর জড়ানো গলায় আবেগপ্রবণ কথাগুলো শুনতে কী যে ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল, তা প্রকাশ করার মতো ভাষা নেই আমার।

পার্থকে আমি না-বলতাম "দাদা", না-ডাকতাম নাম ধরে। প্রথমটির পেছনে যুক্তি ছিল, একেবারে পিঠাপিঠি তো, আমার ঠিক আগের ব্যাচের, ঐটুকু বড় কাউকে "দাদা" ডাকবার কীইবা আছে! দ্বিতীয়টির পেছনে কারণ ছিল, একধরণের সম্মানবোধ। মেধা, পড়াশোনায় ধারাবাহিকভাবে ভালো ফলাফল, ভাবগম্ভীর নয় অথচ খুব স্বচ্ছ ও ভনিতাশূণ্য এক ভাবমূর্তি, এসব দিয়ে পার্থ নিজেকে এমন এক স্তরে ধরে রেখেছিল যে সুপ্ত এক সমীহ কাজ করত তার প্রতি, যা থেকেই একধরণের সসম্মান দূরত্ব বজায় রাখার প্রবণতা কাজ করত বয়সে বছরখানেকের ছোট পড়াশোনাপ্রিয় আমার মধ্যে। ১৯৮৮ সালে পার্থর মাধ্যমিক। প্রাপ্ত নম্বর ৬৫০। ৭২.২ শতাংশ। আগাগোড়া প্রথম স্থানাধিকারী। ব্যতিক্রম ঘটেনি মাধ্যমিকেও। স্কুলে সেরা ফলাফল সেবার। উচ্চমাধ্যমিক বিজ্ঞান বিভাগ নিয়ে। গণিত, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, জীববিদ্যা। ১৯৯০ সালে উচ্চমাধ্যমিক। প্রাপ্ত নম্বর অবিকল মনে পড়ছে না, তবে ৬৮০ ছুঁইছুঁই। প্রায় ৬৮ শতাংশ। স্মৃতিভ্রম ঘটেনি, পরিসংখ্যানগুলো তাই সঠিক। এই শুকনো পরিসংখ্যান দিয়েই আমাদের স্কুলের সাপেক্ষে আগেপিছে ব্যাচগুলোর মেধাবীদের মধ্যে একেবারে প্রথম সারিতে অনায়াসে রাখা যায় পার্থকে। কিন্তু সমান্তরালে তাঁর ফুটবলের দক্ষতা? কী করে সেই মুন্সিয়ানার পরিচয় উহ্য রেখে এগিয়ে চলি লিখতে বসে? ফুটবল বিশেষজ্ঞ নই, কিন্তু রক্ষণভাগের জমাটবাঁধা খেলোয়াড় হিসেবে যেভাবে ধারাবাহিকভাবে সামলে যেত বিপক্ষের আক্রমণ এবং মুহুর্মুহু সূচনা করত বিপক্ষ রক্ষণে প্রতিআক্রমণ, তা তো ছিল রীতিমতো সাড়া জাগানো। নিজে খেলত, গোটা দলকে পরিচালনা করে যেত নিউক্লিয়াস হয়ে। দৃঢ়চেতা মনোভাব, বরফশীতল মাথা, আপাদমস্তক অনাড়ম্বর, ভীষণ লড়াকু, পোড়খাওয়া নেতৃত্ব, সবমিলিয়ে মাঠে আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু বললে অত্যুক্তি হয় না। এভাবেই, সবুজ ঘাসের মাঠ হোক কি স্কুলের শ্রেণীকক্ষ, তার গোটা স্কুলজীবন এভাবেই ছিল লেখাপড়া ও খেলাধুলার অনন্য যুগলবন্দী। কতজনের পক্ষে সম্ভব এই সমতা রক্ষা করে চলা! নিজগুণে সহপাঠীদের কাছ থেকে বরাবরই একধরণের সম্ভ্রম, শ্রদ্ধামিশ্রিত ভালোবাসা পেয়ে এসেছে সারা স্কুলজীবন জুড়ে। খুব কাছ থেকে প্রত্যক্ষ সাক্ষী থেকেছি এসবের, কারণ পরপর দুই ব্যাচের ছাত্র ছিলাম বলে পর্যায়ক্রমে বেড়ে ওঠা ধাপে ধাপে। মনে পড়ে, সে যখন একাদশ শ্রেণীতে, আমার মাধ্যমিকের ফল প্রকাশের পরদিন সন্ধ্যায় আমাকে আর আমার চেয়ে বছর পাঁচেকের বড় আমার দাদাকে (স্বরূপ দত্ত) ঘরে নেমন্তন্ন করে মিষ্টিমুখ করিয়ে আশীর্বাদে ভরিয়ে দিয়েছিলেন স্যার আর দিদিমণি (হয়তো "কাকিমা" বলতাম)। আমাকে আষ্টেপৃষ্টে বুকে জড়িয়ে ধরে স্যারের সে কী আনন্দের সরল প্রকাশ। সন্তান বাৎসল্যে ভালোবাসা তো একেই বলে। ভাবতে গর্ব বোধ হয় যে, পরবর্তীতে বীরপাড়া চা বাগানের ঠিকানা ছেড়ে পার্থর স্থায়ী প্রতিবেশী হয়ে পার্থর তথা ঐ পরিবারের যে ভালোবাসা আমার পরিবার, বিশেষত আমার দাদা, ক্রমবর্ধমান হারে পেয়ে এসেছে, তা ভীষণ দামী এবং রীতিমতো মনের মণিকোঠায় যত্নে লালন করার মতো। নিজের জীবদ্দশায় পার্থর ভালবাসার ঐ ঋণ শোধ করা আমার দাদার পক্ষে কার্যত অসম্ভব। তবু আমৃত্যু পার্থর পরিবারের পাশে থাকার প্রত্যয় নিয়ে আমার দাদা এভাবেই যে এগিয়ে চলবে একনিষ্ঠ তৎপরতায়, এই বিশ্বাসে বলীয়ান আমি।

বরাবরের কৃতী ছাত্র ছিল পার্থ। তাই লেখালেখিতে যে দক্ষ এর মধ্যে হয়তো কোনো অস্বাভাবিকতা নেই, কিন্তু "সহজ উঠোন"-এর সান্নিধ্যে যখন থেকে এসেছে সে, তখন থেকেই তার লেখার গভীরতা, লেখার মধ্য দিয়ে ভাবাবেগের নিখুঁত প্রকাশ, ভাবনায় ও বিশ্লেষণে অভিনবত্বের ছাপ, এসবের প্রত্যক্ষ সাক্ষী হতে শুরু করেছি আমি। কারণ, বলতে দ্বিধা নেই যে, আগে কখনো পার্থর লেখা পড়বার অবকাশ বা সৌভাগ্য আমার হয়নি। তার পরোপকারীতা, সবার অগোচরে থেকে বা যথাসম্ভব আড়ালে থেকে জনহিতকর কাজে নিজেকে সঁপে দেওয়া, গত কয়েক বছর ধরে লাগাতার বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান সংগঠনের ক্ষেত্রে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলা, এগুলো সর্বজনবিদিত, না-বললেও চলে। তবু না-বললে নয়, তাই বলা। কর্মসূত্রে আমি বহুদিন ধরে বীরপাড়ার বাইরে বলে দেখাসাক্ষাৎ হতো কম। কোজাগরী লক্ষ্মী পুজোর সন্ধ্যায় সবান্ধব আমাদের বাড়িতে খিচুড়ি খেতে এলে দুচারটে কথা হতো। আমি নিজের কম বয়সে বাঁহাতি পেসার হিসেবে রীতিমতো সমীহ আদায় করতাম, আমার কলেজপড়ুয়া খেলাপাগল পুত্রসন্তানের কাছে একবার এরকম উল্লেখ করেছিল পার্থ, আমার সামনেই, যা শুনে মনে মনে আমার বড্ড আনন্দ হয়েছিল এবং তার প্রতি কৃতজ্ঞতা বোধ জন্মেছিল এই ভেবে যে, এই চূড়ান্ত অনিয়মিত খেলোয়াড়ের কিছু একটি ভালো গুণ কী পরম মমতায় তার উত্তরসূরীর সামনে উচ্চারণ করেছিল অকৃপণভাবে! পার্থর ঐ কথায় নতুন করে স্মৃতি বিজড়িত হয়েছিলাম যে, পড়াশোনায় কৃতী আর ফুটবলে দলের মেরুদন্ড পার্থ তো অবলীলায় ক্রিকেটটাও খেলত। স্কুলের প্রতিনিধিত্বকারী কৃতী খেলোয়াড় ছিল ক্রিকেটে। তাই পার্থর বিচরণের ব্যাপ্তি তো প্রথম পছন্দের ফুটবলের বাইরে আরেক পছন্দের ক্রিকেটেও‌ ছিল। মিশ্র সংস্কৃতির আধাশহর বীরপাড়ায় ইদানিং বাংলা ভাষা চর্চা, সাংস্কৃতিক চর্চা, উঠতি প্রজন্মের মধ্যে সুস্থ সাংস্কৃতিক চেতনার বিকাশ, এসব নিয়ে একেবারে সম্মুখ শিয়রে গিয়ে কাজ করতে শুরু করেছিল পার্থ। তবে এগুলো সামাজিক মাধ্যমে অন্য উৎসের মাধ্যমে দেখতাম। নিজে ফলাও করে প্রচার করা তো দূরের কথা, একটি বাক্যও পারতপক্ষে ব্যবহারে বিরত থাকত নিজেদের এসব কর্মকাণ্ড নিয়ে। এই নেপথ্যচারিতা, প্রচারবিমুখতা পার্থকে মহান করেছিল ওর জীবদ্দশাতেই। পার্থর চলে যাওয়ার পর আমার ঘনিষ্ঠমহলে আমি বলেছি, চেষ্টা করলেও পার্থর মতো হওয়া যাবে না।

সেদিন পার্থর শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের ভিডিও কলে কাকিমা কথায় কথায় একটি কথা বললেন (অনেকটা এরকম), "মানুষকে সাহায্য করিস, মানুষের পাশে দাঁড়াস, কিন্তু মানুষ চিনতে ভুল করিস না বাবা।" ভাবুক হয়ে পড়েছিলাম কথাটি শুনে। কিছু আশঙ্কা কাজ করছিল, এখনো করে। সদা পরোপকারী পার্থর জন্মদাত্রী মায়ের মুখনিঃসৃত যন্ত্রণাবিদ্ধ কথা আমার স্বজনহারা মনের কোণে কেমন এক অন্যমনস্কতার জন্ম দিয়েছিল। আবার মৃত্যুর কারণ খুঁজতে গিয়ে ভাবুক হয়ে আছি এই ভেবেও যে, সত্যিই কি সিটবেল্ট ছাড়াই গাড়ীখানি চালাচ্ছিল পার্থ! পদার্থবিদ্যায় কৃতী পার্থর কি এতই অনায়াসে এড়িয়ে যাওয়া মানায় গতিজাড্যের নির্মম সত্যকে! সহজ এই লেখার উঠোনে অমিতবাবু আমাকে আগের মতো লিখতে বলেন যোগাযোগ হলেই। কারণে অকারণে হয়ে ওঠে না লেখা। সেই আমি শেষপর্যন্ত কিন্তু লিখলাম। পার্থকে নিয়ে। অ-পার্থিব পার্থকে নিয়ে। "খুব ভালো লাগল সৌরভ......লেখার সাবলীল চলন পাঠ-সুখ এনে দিল, লেখাটা চালিয়ে যা..", অনিন্দ্য সুন্দর মন্তব্যের দেখা মিলবে না। পাল্টা আমিও লিখব না পার্থকে, "কিছু মানুষের প্রতিক্রিয়া খুব উদ্দীপকের কাজ করে। ধন্যবাদ।"

"RIP", "Rest in Peace", "ভালো থেকো পরপারে", "ওপারে ভালো থেকো", ..., কিচ্ছু না এসব। বললে শান্তি আসে, তাই শুধু বলা। লিখলে একটু শান্ত হয় মন, তাই শুধু লেখা।

আপনাদের মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴
software development company in siliguri,best
                          software development company in siliguri,no 1 software
                          development company in siliguri,website designing company
                          in Siliguri, website designing in Siliguri, website design
                          in Siliguri website design company in Siliguri, web
                          development company in Siliguri