অনিন্দ্য কথা/রণজিৎ কুমার মিত্র
অনিন্দ্য কথা
রণজিৎ কুমার মিত্র
'ঠিকানা' মাল বাজার পোস্টাল রিক্রিয়েশন ক্লাবের সাহিত্য -সংস্কৃতির বাৎসরিক মুখপত্র। অনিন্দ্য মালবাজার পোস্ট অফিসে বেশ কয়েক বছর ছিলেন। শুধু লেখক হিসেবে নয়, মাল বাজারে থাকাকালীন সময়ে 'ঠিকানা' পত্রিকার প্রকাশনায় অনিন্দ্য নানাভাবে নিজেকে যুক্ত করেছিলেন। এই পোস্ট অফিসে ছিলেন কবি সমীরণ ঘোষ, হাংরি কবি হিসেবে সারা পশ্চিমবঙ্গেই সমীরণ বিখ্যাত বা কুখ্যাত ছিলেন। সমীরণ আমাদের বন্ধু ছিলেন। কবি মনোজ রাউত -এর মাধ্যমে সমীরণ সাথে আমার ও আমাদের অকাল প্রয়াত আর এক বন্ধু অন্যমন দাশগুপ্তর পরিচয়। মনোজের 'ধৃতরাষ্ট্র' পত্রিকা তখন শিলিগুড়ি থেকে প্রকাশিত হতো। সমীরণ তখন শিলিগুড়িতে থাকতেন। অনিন্দ্যদের 'ঘোষদা,' সমীরণ ছিলেন 'ঠিকানা'র নেপথ্য কারিগর। অনিন্দ্যর লেখা থেকেই শুনি সেসব কথা - "অফিসের একঘেয়েমির হাত থেকে বাঁচতে চেয়ে সবাই মিলে অন্য কিছু করতে চাই, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান তো হবেই, সঙ্গে একটা পত্রিকা প্রকাশ করারও ভাবনা আসতেই সমীরণদার শরণে আমরা, "ঘোষদা, রিক্রিয়েশন ক্লাব থেকে একটা পত্রিকা বের করা যায় না? টেবিল থেকে মাথা তুলে স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে মানুষটি মুচকি হেসে মৃদুস্বরে এই কথাগুলো বলে উঠলেন "লেখা পাওয়া যাবে, তোমরা খরচের দিকটা চিন্তা কর।........ সমীরণদার তখন দারুণ ব্যস্ততা, এরই মধ্যে একদিন, পত্রিকার নাম কী রাখবে, ভেবেছো কিছু? আমরা যে যার মতো কয়েকটি পছন্দের নাম শোনালাম। সমীরণদা শুনলেন, তারপর সেই একই রকম মৃদুস্বরে বললেন আচ্ছা, "ঠিকানা নামটা একবার ভেবে দেখবে নাকি, ছোট্ট শব্দ, আমাদের পেশার সঙ্গে যাবেও ভালো।" আমরা সবাই সায় দিতেই সমীরণদার লাজুক চাপা হাসি। "২০১০, ১১, ১২, ১৩, -এই চার বছরের চারটি সংখ্যার জন্য অনিন্দ্য আমার কাছ থেকে লেখা নিয়ে প্রকাশ করেছিল। এই চারটি সংখ্যা সযত্নে আমার কাছে রেখে দিয়েছিলাম। এই চারটি সংখ্যাতেই অনিন্দ্যর লেখা রয়েছে। ২০১০ -এ 'ঠিকানা'-র দ্বিতীয় সংখ্যায় অনিন্দ্যর গল্প ছিল 'সব চরিত্রই কাল্পনিক নয়'। ২০১১- সংখ্যায়ও অনিন্দ্যর গল্প 'জবানবন্দী'। ২০১২ -র 'ঠিকানা'তে অনিন্দ্যর গল্প ছিল 'সত্য ঘটনা অবলম্বনে'। ২০১৩- সংখ্যাটি ছিল 'কবি সমীরন ঘোষ স্মরণে'। সমীরণ খুব সম্ভবত ১৯৭৪ সালের শিলিগুড়িতে ডাক বিভাগে চাকরিতে যোগ দিয়েছিলেন। সমীরন ঐ ডাক বিভাগের চাকরি নিয়ে ১৯৮৬ সালে মালবাজার শহরের বদলি হয়ে চলে আসেন শিলিগুড়ি থেকে। সমীরণের পরবর্তী কর্ম ও সাহিত্য জীবন ছিল মাল বাজারেই। ২০১২-র ২৬ শে নভেম্বর কবি- লেখক এবং প্রাবন্ধিক সমীরণ ঘোষ, মাত্র ৫৯ বছর বয়সে প্রয়াত হন। এই ২০১৩- সংখ্যাটিতে সমীরণকে নিয়ে অনিন্দ্য লিখেছিলেন 'ঝাপসা একটা স্বপ্ন আলতো কিছু স্মৃতি।' সেই স্মৃতিকথন থেকে সমীরণের সাথে অনিন্দ্যর কথোপকথনের একটি অংশ উদ্ধৃত করছি। আমার মনে হয়, এই কথোপকথন থেকে দুজনের মন ও মেজাজ খানিকটা অনুভব করা যাবে। -"সমীরন দা, শুনেছি আপনি ও হাংরি জেনারেশনের কবি? নিয়ম ভাঙ্গার, প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার, সাহস দেখিয়েছিল আপনাদের প্রজন্ম? আপনারাও কী বলতে চাইতেন তিন জোড়া লাথির ঘায়ে রবীন্দ্র- রচনাবলী লুটোয় পাপোষে? সেটাই বলেছিলাম, ওপর চালাকি বোঝো? কোন কিছুর গভীরে না ঢুকে উপরটুকু নিয়েই শুধু আড়ম্বর আর হইচই। মানে? মুচকি হেসে চুপ করে আছেন দেখে বুঝলাম, বেশি ভাঙতে চাইছেন না। হঠাৎ বলে উঠলেন, আর হ্যাঁ শোনো সুনীল ওই লাইনটিতে কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক অচলায়তনের প্রতি বিদ্রুপই প্রকাশ পেয়েছিল। সেটা না বুঝে রবীন্দ্রনাথ- রচনাবলী শব্দটিকে আক্ষরিকভাবে নিয়ে হৈচৈ বেশি হল। "সমীরণ এর মৃত্যুতে অনিন্দ্য লিখেছিল "আমরা কেউ কথা রাখতে পারিনি সমীরণদা। আপনিও না আমিও না, অসুস্থ অবস্থায় একবার দেখা করে আসবো কথা দিয়েছিলাম, রাখতে পারিনি সে কথা। আপনারও কথা ছিল না এভাবে সাড়া না দিয়ে আড়ালের দেশে চলে যাওয়ার, যেখানেই থাকবেন ভালো থাকবেন। 'ঠিকানা' র পাতা এবারও যে খুঁজবে আপনাকে সাদা কালো আঁচড়ে- আঁচড়ে। "করোনার পরে সমীরণের উত্তরাধিকার ওর পুত্র কবি সব্যসাচী সমীরণের স্মরণসভা করেছিল। সেই স্মরণ সভাতে প্রকাশিত হয়েছিল সঞ্জয় সাহার 'তিতির' পত্রিকার সমীরণ ঘোষ সংখ্যা। সেই অনুষ্ঠানে গিয়ে শুনেছিলাম অনিন্দ্য মালবাজারে নেই, ফালাকাটায় বদলি হয়েছে। 'ঠিকানা'র চারটি সংখ্যাতেই অনিন্দ্যর গল্প প্রকাশিত হয়েছিল। অনিন্দ্যর বহু কবিতা অগ্রন্থিত অবস্থায়, বিভিন্ন লিটিল ম্যাগাজিনে ছড়িয়ে আছে। অনিন্দ্য যখন সাহিত্যচর্চায় গভীর মগ্ন থেকে নানা পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে নিজেকে প্রস্তুত করছিল তখনই আকস্মিকভাবে চলে গেল। একটা সম্ভাবনা স্তব্ধ হয়ে গেল। জানি না 'ঠিকানা' পত্রিকাটি আজও প্রকাশিত হয় কিনা। সম্প্রতি অনিন্দ্যের বসত করবার ঠিকানা বদল হয়েছে। কিন্তু আমাদের মনে, সাহিত্য আকাশে অনিন্দ্য যে স্থায়ী ঠিকানা রেখে গেছেন, তার কোনো বদল হয়নি বলেই -আমার বিশ্বাস।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴