'সাধারণ মেয়ে'র চিঠি/অর্পিতা মুখার্জী চক্রবর্তী
'সাধারণ মেয়ে'র চিঠি
অর্পিতা মুখার্জী চক্রবর্তী
কী নামে ডাকি তোমায়? কোন মধুর সম্ভাষণে তোমাকে লিখি একান্ত চিঠিখানি?তোমার সৃষ্টিসাগরের কোন মুক্তোটি তুলে এনে ছুঁয়ে দেখি তার গহনে তোমার আমায় ছুঁয়ে থাকা?এই জিজ্ঞাসার দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়েও তোমারই হাত ধরি,তোমাতেই হাতড়ে বেড়াই সমস্ত প্রশ্নের উত্তর।সেই তুমি এসেই হাত ধরো,চিরসখার মতো। তোমার আলোয় পথ দেখাও সবসময়ের মতোই....
মিতা,
চিঠির প্রতি তোমার অনুরাগের নিদর্শন ছিন্নপত্রের সুখপাঠ্য সব চিঠিগুলি।এই ক্ষুদ্র আমি, তুচ্ছ,নগন্য আমি তোমার সেই সাধারণ মেয়ের মতোই নিতান্তই সাধারণ শব্দ কথায় তোমায় চিঠি লিখবার মতো দুঃসাহসের অথচ প্রবল ভালোলাগার কাজটি কাঁপা কাঁপা হাত ও দুরু দুরু বুক নিয়ে শুরু করি তাই।তোমার পুজোর অঞ্জলির ফুলেদের সেই চিঠিতে সাজিয়ে কেয়াপাতার নৌকোয় করে তালদিঘিতে ভাসিয়ে দেব বরং। এই দুঃসময়ে সোনার তরীর দেখা মেলা ভার। নাহলে তোমার পোস্টমাস্টার তো রইলেনই,তাকে বোলো ঠিকানায় থাকবে জীবনদেবতার নাম।
তোমার বৈচিত্র্যময় সৃষ্টির এককণাও ধরতে ছুঁতে পারিনি..একটা গোটা জীবনও যথেষ্ট নয় তোমার কাব্য, সাহিত্য,দর্শনকে জানবার জন্য। যেটুকু কুড়িয়ে পেয়েছি হৃদয় আকাশে পরশপাথর হয়ে রয়ে গেছে, রয়ে যাবে চিরকাল।
তোমার কবিতায়,গল্পে, উপন্যাসে, নাটকে যে নারীরা সাহিত্যকে আলোকিত করেছেন তারা কেউ কেউ আমার বড় প্রিয়। তাদের মধ্যে কেউ আধুনিকা, কেউবা গ্রাম্য বধূ। তারা কখনো আবেগী, কখনো বা প্রতিবাদী বা মায়াময়ী। তেমনই এক নারী তোমার গল্পগুচ্ছের শাস্তি গল্পের চন্দরা। আমার মনের কথা বুঝতে পেরে তাই তুমি আমার আবেদনে সাড়া দিয়ে তোমার অনেক যত্নে গড়া সাধারণ হয়েও অসাধারণ বিজয়িনী সেই নারীকে দেখিয়ে দিলে ইশারায়। 'শাস্তি' গল্পটির সঙ্গে প্রথম পরিচয় সেই দশম শ্রেণীর পাঠ্য পুস্তকে। গল্পগুচ্ছ প্রসঙ্গে বিষয় শিক্ষিকার থেকে জেনেছিলাম জমিদারির কাজে পূর্ববঙ্গে এসে নৌকো করে পদ্মার পাড় দিয়ে যেতে যেতে সেখানকার মানুষ, তাদের যাপনের চিত্র ও বৈচিত্র্যময় অভিজ্ঞতার ফসলই তোমার সোনাঝরা কলমের গল্পগুচ্ছ।সেই কিশোরীবেলায় প্রথম পরিচয়েই নিজের থেকে বয়সে সামান্য কিছুটা বড় চন্দরাকে ভালোবেসে ফেলেছিলাম নিবিড় ভাবে। তোমার কলমের জাদুতে এই গল্পের শেষ হয়েও শেষ হয়নি। আশ্চর্য এক রেশ থেকে গেছে আজীবন। চন্দরার সেই অভিমানী মন অজান্তেই নিভৃতে ঠাঁই বেঁধেছে ষোড়শী এক কিশোরীর হৃদয় যমুনাতেও। গল্পের বিষয়বস্তু তো সকলেরই জানা।গল্পটি পড়ে চন্দরার আত্মমর্যাদা বোধের প্রতি সম্ভ্রম জেগেছে বারংবার। স্বামীর প্রতি তীব্র অভিমান আর পারস্পরিক আকর্ষণ ও বিবাদের ছেলেমানুষী অথচ গভীর প্রেমের খেলার প্রতিশোধস্পৃহায় বেঁচে থাকবার বেহায়াপনা না দেখিয়ে বিনা অপরাধে ফাঁসিকাঠকে বরণ করে নেওয়ার একগুঁয়েমি থেকে তাকে কেউ বের করে আনতে পারেনি। তোমার কাছে যে সেসময় কত অভিযোগ অনুযোগ করেছি তোমারই বিরুদ্ধে, চোখে জলের বান ডেকেছে পৃথিবীর সমস্ত বিষয়ে কৌতূহলী ও কৌতুকপ্রিয় ছোটখাটো চেহারার উজ্জ্বল চঞ্চল ঘনকৃষ্ণ চোখের চন্দরাকে এমন শাস্তি দেওয়ার জন্য। তোমার অকৃপণ মমতায় গড়া তোমার চন্দরা আর তার আত্মাভিমান আমার চোখের জলে ভিজে ভিজে আরও সজীব হয়ে রয়ে গেছে মনের মণিকোঠায়। কম বয়সের পাঠে ভালোলাগা ও মনকেমন থাকলেও এ গল্পের গভীর মনস্তাত্ত্বিক দিকটি যা অধরা রয়ে গিয়েছিল সেসময়, বয়সের সঙ্গে সঙ্গে মনের গভীরে সেটি অনেক গল্প বলে গেছে, অনেক ছবি এঁকে গেছে। মিথ্যে কলঙ্কের বোঝা মাথায় নিয়ে সকলের চোখে ঘৃণার পাত্রী হয়ে পুলিশ চালিত চন্দরার গ্রামের পথ ধরে শেষ চলে যাওয়া আত্মার পরমাত্মীয়র কষ্টের মতোই মনে হয়েছে তোমার বর্ণনার গুণে।প্রিয় গল্পের প্রিয় নায়িকার মুখে 'মরণ' শব্দটির সঙ্গে আশ্চর্য এক ব্যঞ্জনায় শেষ হয়েও শেষ হয়নি তোমার শাস্তি গল্পটি।সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মেও কত সহজে মাটির খুব কাছের এক জীবনের চালচিত্র এঁকেছো তুমি। কত নিপুণ পারদর্শিতায় সেসময়ের খেটে খাওয়া মানুষগুলির সামাজিক অবস্থান ও তার ছায়ায় পারিবারিক অশান্তির ছবি তুলে ধরেছ। শাস্তির অনেক বছর পার করেও সাধারণ মানুষদের জীবন সেই একই প্রবাহে বহমান আজও অনেক ক্ষেত্রেই। শাস্তির বোঝা মাথায় তুলে নেওয়ার চরিত্র বা রূপরেখাগুলির অদলবদল হয়েছে হয়তো বা। কত চন্দরা যে জন্মেছে আর জীবনের বিভিন্ন কষ্টের ফাঁসিকাঠে আত্মবলিদান দিয়েছে জীবন্মৃত থেকে তার ইয়ত্তা নেই। গল্পটি আজকের দিনেও তাই সমান বাস্তব ও চূড়ান্ত সমকালীন। তোমার ফোটানো ফুলের সৌরভের রেশ রেখেই তোমায় চিঠি লিখলাম। আমার প্রণাম নিও নিভৃত প্রাণের দেবতা।
ইতি -
তোমার এক পূজারিণী
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴