'অপরূপ রূপ এ যে দশভূজা'/রণজিৎ কুমার মিত্র
'অপরূপ রূপ এ যে দশভূজা'
রণজিৎ কুমার মিত্র
-----------------------------------
"গিরি, কারে আনিলে,
এনে কার তনয়া ,প্রবোধিলে?
অপরূপ রূপ এ যে দশভূজা,"
(ঠাকুরদাস দত্ত)
সেকালের এক প্রাচীন পাঁচালিকার মা দুর্গার মূর্তি দেখে লিখেছিলেন এই দেবী মূর্তির সঙ্গে গিরিরাজ ও মেনকার কন্যা উমার কোন সাদৃশ্য নেই।
তিনি বিশ্বাস করতে পারছেন না শান্ত সুশীলা কন্যা উমাশশীর একি রণরঙ্গিনী বেশ! দুর্গাপূজা মানেই তো মন্ডপে মণ্ডপে দেবী প্রতিমা দর্শণ।
এই প্রতিমা হচ্ছে দেবী দুর্গার প্রতিরূপ। কিন্তু এই রূপের মধ্যে রয়েছে অনেক অদল- বদল। নানা ধরনের বিশ্বাস ,ভাবনার বিবর্তন আর চিন্তার সমন্বয়। প্রতিমা তো শুধু ভক্তের কাছে ভগবানের প্রতিবিম্ব নয়। প্রতিমা তে মিশে যায় সময়ের রং সমসাময়িক সমাজ ও সংস্কৃতির বিশেষ অবস্থা। পৃথিবীর উর্বরতার, শস্য ইত্যাদি উৎপন্নের জন্য মাতৃ দেবীর আরাধনা, কৃষিভিত্তিক সমাজে বহুল প্রচলিত। বাংলার মাটিতে বাংলার সামাজিক অবস্থায় দুর্গার মহিষমর্দিনি রূপ নষ্ট না হলেও এর সঙ্গে ফুটে উঠেছে বাঙালির সংসারের কন্যা ও জননীর রূপ। বার্ষিক দুর্গাপূজা মেয়ের বাপের বাড়ি আসবার উৎসব । বাঙালির চিন্তা ও স্বভাবগুনে মহিষমর্দিনী দেবী দুর্গা হয়ে উঠেছেন বাঙালি পরিবারের কন্যা উমা, যাকে দেখতে না পেলে সব বাবা মা র' পাগল -পাগল' অবস্থা হয়।
বাঙালির ঘরোয়া, চিরন্তন চিন্তার ছাপ পড়েছে সপরিবারে দুর্গার কল্পনায়। শাক্ত পদাবলীকার রা দেবী দুর্গাকে বাঙালি ঘরের মেয়ে করে তুলেছেন। পুজো এলেই তাই মনে হয় মা আসছেন না, মেয়ে আসছেন! মারকন্ডেয় পুরাণে 'দেবী মাহাত্ম্য 'অংশে দেবী দুর্গার বর্ণনা রয়েছে। সেই রূপের বর্ণনা অনুযায়ী সুরথ রাজা দেবীর মাটির মূর্তি করে পূজা করেন। দেবী দশভুজা, ত্রিনয়নী। কালিকাপুরাণের বর্ণনা অনুযায়ী নানা অলংকারে সজ্জিত সুন্দরী দেবী সিংহের পিঠে ডান পা ও মহিষের কাটা মাথা থেকে বেরিয়ে আসা অসুরের দেহে উপরে বাপায়ের বুড়ো আঙ্গুল রেখে এবং বাহাত দিয়ে অসুরের চুলের ঝুঁটি ধরে তার বুকে ত্রিশূল হানছেন, আক্রমণ করছেন। এই মূর্তি কল্পনা চলে এসেছে দীর্ঘকাল। দেবী দুর্গার সঙ্গে যেসব দেব-দেবীদের দেখা যায় তারা প্রত্যেকেই এক এক স্বাধীন ধর্ম-বিশ্বাসের দেব-দেবী। নানা বিশ্বাসের উদ্ভব ও বিবর্তনের এরা শিব- দুর্গার পরিবারভুক্ত হয়েছিলেন প্রাচীনকাল থেকেই। দেবী দুর্গার বাঁদিকে জ্ঞানের দেবী সরস্বতী ও দেব সেনাপতি কার্তিক আর ডানদিকে ধনের দেবী লক্ষ্মী ও সিদ্ধিদাতা গণেশ। গণেশ মূর্তির পাশে নতুন পাতা সমেত সবুজ কলাগাছের একাংশ রাখা হয়। নতুন লাল পেড়ে শাড়িতে ঢাকা এই নবপত্রিকা বা চলতি ভাষায় যাকে বলে কলা বউ তার সঙ্গে রাখা হয় কচু, হলুদ, জয়ন্তী ,বেল, ডালিম ,অশোক, মান ধান ,ফলমূল বা শাখা। এই নবপত্রিকা শাকসবজি ও শষ্যদাত্রী মহাদেবীর শাকম্ভরী রূপ। চারুচন্দ্র সান্যাল লিখেছিলেন 'হিন্দুর দুর্গাপূজায় উপজাতির অবদানে'র কথা। নবপত্রিকার এক একটি গাছকে দেবীরূপে কল্পনার মধ্যে অনার্য সংস্কৃতির পরিচয় রয়েছে । রক্ত তিলক, সিঁদুর তিলক, আরতির ঘন্টা ও তান্ডব, বলিদান সবই মোঙ্গল তান্ত্রিক মতের। আর্য মতের হোম ও অগ্নি পূজা। চারুচন্দ্র সান্যাল লিখেছিলেন," এই দুর্গাপূজা ও প্রতিমার ভেতর দিয়ে ফুটে উঠেছে গত দশ হাজার বছরের কৃষ্টি সমন্বয়। গত দশ হাজার বছর ধরে যাদের বনে পাহাড়ে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, তাদের ডেকে আনো ,তাদের সঙ্গে মিশে যাও, একসঙ্গে কাজ কর, একই মানব প্রতিমা গড়ে তোল ,তবেই তো সত্যিকারের ভারতীয় জাতির নবজন্ম হবে, তবেই সবল হতে পারবে। দারিদ্র অশিক্ষা প্রভৃতি প্রবল অসুর কে ও ধ্বংস করতে পারবে। দুর্গাপূজা কেবল ধর্মীয় প্রথা নয় এটি দিকদর্শন সমগ্র মানব সমাজের জন্যঌ তাই এই পূজা জাতীয় উৎসব। সব মানুষই এক। বুদ্ধিমানেরা স্বার্থসিদ্ধির জন্য তাদের ভাগ করে রেখেছে। এখন তাদের অশুভবুদ্ধি ত্যাগ করে আবার ভেবে দেখার সময় এসেছে।"( চারুচন্দ্র সান্যাল স্মারকগ্রন্থ, পৃ: ১০১)
ষোড়শ শতাব্দীতে মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর 'কবিকঙ্কন চন্ডী' তে পরিবারের অন্যান্যদের সঙ্গে দশভূজা চন্ডীর মহিষাসুরমর্দিনী রূপ বর্ণিত হয়েছে, তবেএ বিষয়ে পন্ডিত জনেরা বলেন এই ধরনের মহিষমর্দিনী মূর্তি সাধারণত মধ্যযুগের শেষ ভাগের আগে পাওয়া যায় না। দেবী দুর্গা পূজায় শরৎকালকে কৃত্তিবাস 'অকাল' ও 'বসন্তকে' শুদ্ধিসময় বলেছেন।
মার্কেনডেয় পুরাণে দেবীর বার্ষিক পূজা শরতকালের সম্পন্ন হবে উল্লেখ আছে। তবে সময়ের সাথে সাথে ইদানিংকার দেবী প্রতিমারও পরিবর্তন ঘটেছে। আর্ট এর প্রতিমায় কখনো বিখ্যাত নেত্রী বা নায়িকার মুখের আদল, গতবার তো একটি পুজো কমিটি অসুরের জায়গায় গান্ধী মূর্তি স্থাপন করেছিলেন। তবে পুত্র কন্যাসহ দেবী দুর্গার এই বার্ষিক পূজায় অনেকের ধারণা উমার বাৎসরিক পিত্রালয়ে আগমনের উৎসব। মহিষমর্দিনী সিংহবাহিনী রূপে দেবী আরাধনার মূলে রয়েছে এক গভীর প্রাচীন বিশ্বাস। দেবী হলেন শুভ শক্তির প্রতীক আরো অসুর অশুভ শক্তির। এই পূজা বাঙালির আশা- আকাঙ্ক্ষা ও আকুতির প্রতীক। এ বার দেবীর কাছে আমার প্রার্থনা সমস্ত অশুভ শক্তি নিপাত যাক। উত্তরবঙ্গ থেকে সমস্ত পরিযায়ী শ্রমিকরা ঘরে ফিরে আসুক , সুস্থ জীবন ও জীবিকার সন্ধান পাক। ছেলে মেয়েদের কোলাহলে স্কুল ঘর গুলো ভরে যাক। রোদ ঝড় জল বৃষ্টি মাথায় করে আমাদের যে সমস্ত ছেলে মেয়েরা রাস্তায় বসে আছে চাকরির জন্য, তারাও চাকরি পাক। মহিষের গলা থেকে বেরিয়ে আসার মত দুর্দান্ত দুর্নীতিগ্রস্ত অসুরদের নিধন হোক। পৃথিবীর মানুষে মানুষে হানাহানি, সমস্ত যুদ্ধ থেমে যাক। স্বচ্ছ তোয়া নদীগুলি আবর্জনা মুক্ত হোক, মুক্ত গতি হোক। ঘরের মেয়ে বছর শেষে ঘরে আসুক। স্বামী পুত্র কন্যাদের নিয়ে সুখে থাকুক। হিন্দু -অহিন্দু ধনী-দরিদ্র সকলের যোগদানে দুর্গাপূজা যথার্থই হয়ে উঠুক এক জাতীয় উৎসব।
---------------------------------------------------------------
সূত্র: শক্তির রূপ ভারতে ও মধ্য এশিয়ায়। ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়। আনন্দ পাবলিশার্স , কলকাতা, ১৯৯০।
রণজিৎ কুমার মিত্র।
mitra.ranjitkumar12@gmail.com
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴