'অন্ধকারে দুচোখ আলোয় ভরো'/মধুমিতা দে রায়
'অন্ধকারে দুচোখ আলোয় ভরো'
মধুমিতা দে রায়
জোনাথন দৌড়তে থাকে প্রাণপনে, কে ভেবেছিল এমন দুর্ভোগ ঘটবে কপালে, আসলে আজ যে দিনটাই খারাপ। জ্বালানি সংগ্রহ করতে জঙ্গলে জুনিপর কাঠ নিতে এসেছিল, মনের সাথে শরীরেরও যোগ আছে, ভারাক্রান্ত মনে শরীরও সঙ্গত দিচ্ছিল না। কাঠ কাটতে কাটতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে। হঠাৎ কোথা থেকে এক ভাল্লুকের উদয় হল। জঙ্গলের এই দিকটা বসতির বেশ কাছে, সচরাচর এখানে জংলী পশুরা আসেনা। কিন্তু ঐযে, জনের দুর্ভাগ্য, যেখানে যায় পিছু ছাড়েনা। ভাল্লুকটা ওকে দেখেই তেড়ে এলো। পেছন ফিরে আর তাকায়নি জন নদীর ঐ ব্রিজটা পেরোতে পারলেই লোকালয়। আরও জোরে দৌড়তে থাকে জোনাথন।
আজ দিন শুরু হতে না হতেই প্রথমে পাওনাদারের দল বাড়িতে হামলা করে, তাদের কোনোরকমে বিদায় দিলে শুরু হয় বউয়ের গালমন্দ। মারিয়া রাগ করে বলেই দিয়েছে, পাওনাদার এরপর বাড়িতে এলে, বাচ্চাদুটোকে নিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে, প্রতিবেশীদের আর জবাবদিহি করতে পারবেনা। কিন্তু পাওনাদারেদের প্রাপ্য শোধ না করলে ওরা কিছুতেই পিছু ছাড়বে না, জন তা জানে।
জুটমিলে কাজ করে একরকমে সংসারটা চলে যাচ্ছিল, জুটমিলটা বন্ধ হবার পরেই এই ধার-দেনা শুরু হয়। সঞ্চয় বলতে তেমন কিছুই ছিলনা, চারটে পেট চালাতে আর বাচ্চাদের পড়াতেই মিলে যা পারিশ্রমিক পেত ব্যয় হয়ে যেত। মালিকপক্ষ লোকসান সামলাতে না পেরে জুটমিলটা বন্ধ করে দিল। কাজের জন্য হন্নে হয়ে খুঁজেও আর কাজ জোটাতে পারেনি জন। প্রায় বছর গড়াতে চলল বেকার বসে আছে ঘরে। সঞ্চয় যা ছিল ছ-মাসের মধ্যেই শেষ হয়ে গেছে। রোজ রোজ পাওনাদারদের বাড়িতে এসে চিৎকার চেঁচামেচি মারিয়া আর সহ্য করতে পারে না। সত্যিইতো, কী দিতে পেরেছে জন মারিয়াকে, ভালোবেসে ওর সাথে সংসার বেঁধেছিল মারিয়া, জনের অল্প আয়েই গুছিয়ে সংসার করেছে, মোটামুটি স্বছন্দেই দিনগুজরান হচ্ছিল, কিন্তু চাকরিটা চলে যাওয়ায় সমস্ত সুখ যেন নিমেষে কোথায়ও হারিয়ে গেল। ধীরে ধীরে ধারে দেনায় জর্জরিত হয়ে জীবনটা দুর্বিসহ হয়ে উঠল। এবছর ক্রিসমাসে বাচ্চাদুটোকে নতুন জামাকাপড় পর্যন্ত কিনে দিতে পারেনি। পড়শিদের বাড়িগুলো যখন আলো ঝালমল করছিল, ওদের বাচ্চাগুলো যখন নতুন জামা পড়ে রাস্তায় আনন্দ করছিল, জনের বাচ্চারা মুখ শুকনো করে বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখছিল। মারিয়া প্রভু যীশুর সামনে মোম জ্বেলে নিজে হাতে কেক তৈরী করে সাজিয়ে দিয়েছিল। কেক কাটবার সময় মোমের আলোয় উজ্জ্বল বাচ্চাদের আর মারিয়ার মুখটা যেন জনের চোখের সামনে ভেসে উঠল, ভেতর থেকে কান্না দলা পাকিয়ে এল, আরও জোরে দৌড়চ্ছে জন, আর কুড়ি পঁচিশ পা গেলেই সামনের ব্রিজটায় পৌঁছে যাবে। একবার পেছনে তাকিয়ে দেখল জন, না: ভাল্লুকটা আর নেই। ব্রিজের ওপর উঠে হাঁফাতে লাগল, এবার রাস্তায় নেমে আস্তে আস্তে হাঁটতে লাগল জন। বিদ্ধস্ত লাগছে।
বাড়ির কাছাকাছি চলেই এসেছে, কিন্তু বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করছে না, গেলে মারিয়া সকালের কথা তুলে আবারও... উঃ আর ভালো লাগে না এই জীবনটা টেনে নিয়ে যেতে। সন্ধ্যে নেমে এসেছে, রাস্তায় কুয়াশা ঢাকা মৃদু আলো, চার মাথার মোড়টা পার করে সামনেই চার্চ, এই চার্চ-এ বিয়ে হয়েছিল জোনাথন আর মারিয়ার। আজ মারিয়া ওকে ছেড়ে... না না মারিয়াকে ছাড়া জীবনটা কল্পনাই করতে পারে না জন। ইচ্ছে করে চার্চ-এর ভেতরে একটু যেতে। দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে দেখে কেউ নেই, শুধু আছেন প্রভু যীশু আর মাদার মেরি, মাঝামাঝি সারির একটা চেয়ারে বসল ও, বুক থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল। প্রভু যীশু আর মাদার মেরির সামনে মোম জ্বলছে, উজ্জ্বল আলোয় উদ্ভাসিত প্রভুর ক্রুশবিদ্ধ মূর্তি। অনেক্ষন তাকিয়ে থাকে সেই মূর্তির দিকে জন, প্রশ্ন করে মনে মনে কেন এতো ডাকবার পরেও প্রভু তার কষ্ট লাঘব করেন না, তার সুখে শান্তিতে ভরা সংসার আজ ভেঙে যেতে বসেছে, এতো অভাব অনটন দুর্দশা দেখেও প্রভুর কেন কৃপা হয়না? তবে সত্যিই কী ঈশ্বর আছেন? যদি থাকেন তবে এতো ডাকবার পরও কেন দুঃখ দূর করবার পথ দেখান না, এখন জোনাথনের টাকার দরকার, অনেক, অনেক টাকা, যা দিয়ে সমস্ত ধার শোধ করা যায়। মারিয়া আর বাচ্চারা চলে গেলে যে এই জীবনের আর কোনো অর্থ থাকবে না। ঈশ্বরের অস্তিত্ব সত্যি হলে তিনি কী তাঁর সন্তানদের দুঃখ কষ্ট দেখেও এভাবে নিরুত্তর থাকতেন? এভাবেই হয়তো ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাসের ভিত নড়বড়ে হয়। প্রভু যীশুর বেদীর সামনেই রাখা ডোনেশন বাক্সের দিকে চোখ পড়ে জোনাথনের, বাক্সের ওপর লেখা "Your contribution can bring smile to someone's face", ডোনেশন বাস্ক ভর্তি টাকা.. অনেক টাকা.. হ্যাঁ ঐ টাকাই পারে জনের মুখেও হাসি ফোটাতে..টাকাই জনের সমস্ত সমস্যার একমাত্র সমাধান.. চারিদিকে কেউ নেই.. না ঈশ্বরও নেই.. কেউতো দেখছে না.. কেউ জানবে না..না! না!..এসব কী ভাবছে জন, শেষ পর্যন্ত চুরির কথা ভাবছে? তবে অভাব কী সত্যিই ওর স্বভাব নষ্ট করে দিচ্ছে? নিজের প্রতি লজ্জা হল জনের। হঠাৎ কারো পায়ের শব্দে যেন ঘোর কেটে গেল, একজন মহিলা রুগ্ন চেহারা, পরনে মলিন বস্ত্র উস্কোখুস্ক চুল, সাথে বছর চার পাঁচের একটা ছোট বাচ্চা তারও পরনে মলিন একটা ফ্রক, এতো ঠান্ডায়ও বাচ্চাটার তেমন কোনো গরম পোশাক নেই, কিন্তু তাও কি প্রানবন্ত বাচ্চাটা! মুখ ভর্তি হাসি, মায়ের হাত ধরে আছে, মায়ের মুখেও মমতা জড়ানো এক হাসি লেগে আছে। ওরা দুজনে একদম সামনে চলে গেলো কিছুক্ষন প্রার্থনা করল দুজনে, এবার বাচ্চাটা মায়ের কাছে হাত পাতল, মা ওর হাতে পয়সা দিতে বাচ্চাটা সেটা ঐ ডোনেশন বাক্সে ফেলে দিল। খানিক্ষণপর আবার আগের মতোই দুজনে হাসিমুখে চার্চ থেকে বেরিয়ে গেল। জোনাথন এবার তাকালো প্রভু যীশুর মুখের দিকে, ক্রুশবিদ্ধ প্রভু, এতো যন্ত্রনা সহ্য করেও মুখে স্মিত হাসি, অমলিন। জোনাথনের চোখের কোণ ভিজে উঠল, বাড়ি ফিরতে মন চাইল, মারিয়া ওর জন্য হয়তো অপেক্ষা করে আছে। পকেটে যে সামান্য কয়েকটা পয়সা ছিল ডোনেশন বাক্সে ফেলে দিল জন। ফেরবার সময় চার্চের দেওয়ালে একটা লেখায় চোখ আটকে গেল, ' God help those, who help themselves.'
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴