'অন্ধকারে একলা পাগল'/রণজিৎ কুমার মিত্র
'অন্ধকারে একলা পাগল'
রণজিৎ কুমার মিত্র
জীবনের অনেকটা সময় পার করে এলাম বহু আঁধার সরিয়ে। আপনি আমার 'অন্ধকারের রাজা রবীন্দ্রনাথ'। কত যে ভাঙ-চুর চলে ভেতরে ভেতরে। কত অসুখ, কত গ্লানি যে জমা হয়ে যায়,কত ছলনা যে সহ্য করতে হয়। এইসব অন্ধকারের সাথে সহবাস করতে করতেই কি রোগ শয্যায় শুয়ে জীবনের শেষ লগ্নে আপনি মুখে মুখে রচনা করেছিলেন---" অনায়াসে যে পেরেছে ছলনা সহিতে/ সে পায় তোমার হাতে/ শান্তির অক্ষয় অধিকার।" ডিপ্রেশনের বাংলা প্রতিশব্দ কি' অন্ধকারের বিমর্ষতা'! আচ্ছা অন্ধকার শব্দটা আপনার সমগ্র সৃজনে এত বেশি বার করে ব্যবহার হয়েছে কেন? অথচ এ অন্ধকার নিকষ কালো নয়। কালোর রং নিয়ে আপনার পক্ষপাতিত্ব কবিতায়-গানে-নাটকে-চিত্রকলায় সবখানে। গাঁয়ের সেই কালো অখ্যাত মেয়েকে কৃষ্ণকলি বলে ডেকে তাঁকে বিখ্যাত করে দিলেন। কত যে আঁধার নিয়ে 'গীতবিতান' থেকে উঠে আসে শুশ্রুষার জল। বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাকে এক প্রাজ্ঞ অধ্যাপক মহাশয় শিখিয়েছিলেন- "রবীন্দ্রনাথের গান শুনতে হয় নিভৃতে। নির্জনে ঘরের সব বাতি নিভিয়ে অন্ধকারে একাকী। সেই নির্জন আঁধারে রবীন্দ্রনাথের বাণী তার সুর বেয়ে অন্তর্লোকে যেন স্পষ্ট ধরা দেয়।" আমার নিজের উপলব্ধি রবীন্দ্রনাথের বহু গানে ,কবিতায়, নাটকে, অন্ধকারকে এমনভাবেই উপলব্ধি করতে হয়। যখন চোখের আলোয় কিছু দেখি তখন তার সম্পূর্ণ রূপটি যেন ধরা পড়ে না, অন্ধকারের মধ্যেই যেন তাকে ভালো দেখা যায়। অন্ধকার ঘরে বসেই আমার তিরিশ বছরের জীবনসঙ্গিনীকে হারিয়ে 'শোক - পরিতাপ' থেকে একদিন বেরিয়ে এসেছিলাম আপনার 'স্মরণ 'কাব্যটিকে সঙ্গে করে।অন্ধকার কে এত নিবিড় করে ভালোবাসার শিক্ষা আপনার সৃজনের থেকেই তো গ্রহণ করেছি। উপলব্ধি করেছি কাউকে দেখার জন্য যে অন্তর্দৃষ্টির প্রয়োজন হয় তা যেন শুধু অন্ধকারে মেলে ।
আপনার চিত্রকলায়, পান্ডুলিপিতে দেখেছি কালো কালির কলমের কাটাকুটির কালো রঙে কেমন ফুটে উঠছে ফুল-পাতা-মানুষের মুখ। কালো রঙের জোব্বায় আপনি হয়ে ওঠেন দেবদূত-এর মতো সুন্দর। রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞরা বলেন, রবীন্দ্রভুবনে রবীন্দ্র সৃষ্টির কেন্দ্রীয় প্রতিমাতে গড়ে উঠেছে অন্ধকারের বিপরীতে আলোর জয়গান। অন্ধকারকে অশুভ আর আলো কে শুভ প্রতিকল্পনা।এ শুধু রবীন্দ্রনাথ কেন হয়তো 'প্রাচ্যের সব শিল্পী সাহিত্যিকদেরই অভিন্ন মুদ্রা'। 'ডাকঘর'এর অমল তাঁর পিসেমশাই কে বলেছিল, সে পড়বে শুধু আনন্দে, কিন্তু বই পড়ে পন্ডিত হবে না, পন্ডিত হতে সে চায় না। পন্ডিত হবার বিন্দুমাত্র এমবিশন আমার নেই আমি শুধু আঁধারের পাঠ নিয়ে আলোয় যেতে চাই। "আমার পথে পথে পাথর ছড়ানো/ তাইতো তোমার বাণী বাজে ঝরনা ঝরানো।" দেবব্রত বিশ্বাস, সুচিত্রা মিত্র ,রাজেশ্বরী দত্ত, নীলিমা সেন, গীতা ঘটক, সুবিনয় রায়, স্বপন গুপ্ত ,মোহন সিং, বিক্রম সিং, রমা মন্ডল, 'যত তারা তব আকাশে' সবাই আমায় অন্ধকারের গান শুনিয়ে আলোর দিকে নিয়ে যায়। 'তোমার সুরের ধারায়' শুদ্ধ হই। ডার্ক চেম্বারে দাসী সুরঙ্গমা আসেন গভীর রাতে, আমার ভেতরকার ছিন্নভিন্ন সত্তা যেন সমস্ত সামাজিক মুখোশ ছেড়ে বেরিয়ে আসে, আলোর বন্দনা ছেড়ে অন্ধকারের অপেক্ষায় জীবনের অন্যতর উন্মোচনের দিকে সুরঙ্গমা আমাকে নিয়ে যায়। তাই দুঃখের অন্ধকার ঘন রাতে সুরঙ্গমার মত আমিও বলতে পারি "আলোর ঘরে সকলেরই আনাগোনা । এই অন্ধকারে কেবল একলা তোমার সঙ্গে মিলন।" এই মিলনের মধ্যেই অন্ধকারে থেকে আলোর মর্মার্থ বুঝতে ভেতরটা আর্তনাদ করে, এসব গান না কান্না ! বুঝতে পারি না- "আঁধার রাতে একলা পাগল যায় কেঁদে/ বলে শুধু বুঝিয়ে দে, বুঝিয়ে দে।"
-
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴