সহজ উঠোন

রেজিস্টার / লগইন করুন।

সব কিছু পড়তে, দেখতে অথবা শুনতে লগইন করুন।

Sahaj Uthon
29-December,2024 - Sunday ✍️ By- সুকান্ত নাহা 86

|| INRI || সুকান্ত নাহা

|| INRI ||
সুকান্ত নাহা
             

-"... একটা কথা জিজ্ঞেস করব ? "
-  "বল " 
-"  INRI -শব্দের অর্থ কী বলতে পারিস ? "
-" কেন? "
-" ঐ একটা শব্দ লাগাতার আমাকে পাগল করে দিচ্ছে ?"

কথাটা শুনে একটু যেন ঝাঁকুনি খেলাম। ডেভিডের দু'চোখ লাল। দেখে বোঝাই যাচ্ছে কতদিন যেন ঘুমোয়নি ও। না হওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু হঠাৎ ও এই শব্দটির অর্থ জানতে চাইছে ...? জিজ্ঞেস করি, "কেন, এ শব্দটির অর্থ জানতে চাইছিস কেন? "

-" আগে বল, শব্দটার অর্থ কী? "ডেভিড নাছোড়বান্দা।

ওকে বুঝিয়ে বলি ওটি একটি ল্যাটিন শব্দ। ইংরেজিতে তর্জমা করলে দাঁড়ায় Jesus the Nazarene, King of the Jews.  অর্থাৎ নাজারিন বা নাজারেথের যিশু, যিনি ইহুদিদের রাজা। যিশুকে যখন ক্রুশবিদ্ধ করা হয় তখন ক্রুশের ওপর কথাগুলো লিখে দেয়া হয়েছিল। 

শুনে কয়েক মুহূর্ত স্থির চোখে আমার দিকে চেয়ে থাকে ডেভিড। তারপর খুব ধীরে ধীরে বলে ওঠে, 

-" ওই লোকটাকে আমি মারতে চাইনি, বিশ্বাস কর। কিন্তু বুড়োটার কথাগুলো মাথায় যেন আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল। এত জ্ঞান দিতে শুরু করল যে..."

কথাটা শেষ না করেই ও দৃষ্টি সরিয়ে নিল । ইউক্যালিপটাস গাছের মাথায় নেমে আসা ঝলমলে মুকুটের মতো দিনান্তের সোনালী রোদ্দুরের দিকে চেয়ে রইলো উদাস দৃষ্টি মেলে।  কিন্তু ঐ খুনের সঙ্গে INRI লেখাটির সম্পর্ক কী বুঝতে পারলাম না। 

বিকেলে এই সময়টায় কিছুক্ষণের জন্য  কনডেমড সেলের বাইরে আসার ছাড়পত্র মেলে। সেই সময়টুকু উঁচু পাঁচিল ঘেরা জেল প্রাঙ্গণের মাঝখানে, এই বাঁধানো বেদিটায় এসে ও বসে থাকে। সিরিয়াল কিলার ডেভিডের ফাঁসির অর্ডার হয়েছে। কোর্টের রায় শুনে এতটুকু বিচলিত হতে দেখা যায় নি ওকে। নিশ্চল পাথরের মতো দাঁড়িয়ে ছিল কাঠগড়ায়। কেস চলাকালীন আত্মপক্ষ সমর্থনে ওকে তেমন উচ্চকিত হতেও দেখা যায় নি কখনও । যতটুকু ডিফেন্ড করার ওর আইনজীবী করেছে । ওর পক্ষে ডিফেন্ড করার মতো তেমন কিছু ছিলও না অবশ্য। হাতেনাতে ধরা পড়েছিল ডেভিড। কিন্তু ক্রাইমের মোটিভ এবং কেসের ব্যাকগ্রাউন্ড স্টাডি করলে আপাত দৃষ্টিতে মনে হয়, এই ক্যাপিটাল পানিশমেন্ট ওর প্রাপ্য ছিল না। তাই হয়ত রাষ্ট্রপতির কাছে আর্জি জানিয়ে ওর আইনজীবীই একটা শেষ চেষ্টা করেছে। 

প্রথম দিন থেকেই কেসটা কভার করে চলেছি আমি। শেষ মুহূর্তে মিরাকল কিছু না হলে ডেভিডের ফাঁসি হচ্ছেই। জেলের ভেতর ওর  ইন্টারভিউ নেওয়ার সুযোগটা পেতে আমাকে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। ডেভিড আমার ছোটবেলার বন্ধু। ধরা পড়ার পর কাগজে যখন প্রথম ওর কথা পড়ি, চমকে উঠি। ছোটবেলায় যে জায়গায় আমাদের দু'জনের জন্ম সেই জায়গার নাম আর ডেভিডের নাম মিলে গেলেও একটা খটকা ছিল মনে। একই নামের কত তো মানুষ আছে ওখানে। পরে খোঁজ নিয়ে জেনেছি, পাঁচটা নৃশংস হত্যার পেছনে যে ডেভিড, সে আমারই বাল্যবন্ধু। 

সিনিয়র এডিটরকে বলে এই কেস কাভারের দায়িত্ব স্বেচ্ছায় হাতে তুলে নিই। কোর্টে হাজিরা দিতে আসা ডেভিডের সাথে দুটো কথা বলার জন্য প্রিন্ট অথবা ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিকরা হামলে পড়ত। সেই ফাঁকে একদিন সামান্য সুযোগ হয়েছিল ডেভিডের সাথে কথা বলার। ও আমাকে দেখেই চিনতে পেরে ম্লান হেসেছিল। তারপর থেকে যখন যেখানে কেসের ডেট পড়ছে..লোয়ার কোর্ট থেকে হাইকোর্ট, হাইকোর্ট থেকে সুপ্রিম কোর্ট সব জায়গায় কেস কাভার করতে গেছি। সেই সুবাদে যা জেনেছি তা হলো, কিছুদিন আগে বাগানের পরিস্থিতি খারাপ হওয়ায় ডেভিড রোজগারের আশায় চলে গেছিল কেরলে। বাড়িতে বৌ ছেলেমেয়ে আর বৃদ্ধ বাবা। বৌ বাগানে পাতা তুলতো। একদিন ছেলেটা অসুস্থ হয়ে পড়ায় ওকে মেডিকেল কলেজে ভর্তি করতে হয়। বাড়িতে শ্বশুরের কাছে মেয়েকে রেখে ও চলে যেত ছেলের কাছে। ছেলে একটু সুস্থ হওয়ায় ও সেদিন সন্ধের ট্রেনে শহর থেকে বাড়ি ফিরে আসছিল। হয়ত টাকাপয়সা জোগাড় করে নিয়ে যেতে। হয়ত শেষ মুহূর্তে স্টেশনে পৌঁছে, তাড়াহুড়োয় উঠে পড়েছিল ট্রেনের একেবারে পেছনের কামরায়। কোথাও ট্রেন থামলে, কয়েকটি উঠতি বয়সের ছেলে উঠে পড়ে সেই বগিতে। অন্তত প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণে সেটিই জানা যায়। নির্জন কামরায় ছেলেগুলো ওকে ধর্ষণ করে খুন করে। ট্রেন থেকে বডিটা ছুঁড়ে ফেলে দেয় ট্রেন লাইনের ধারে, জঙ্গলের ভেতর। পরদিন রেল পুলিশ বডিটা খুঁজে পেলেও আজ পর্যন্ত কারা ঐ দুষ্কর্মটি করেছে তার হদিশ মেলেনি। পুলিশের অনুমান দুস্কৃতিরা রাজ্যের সীমানা ছাড়িয়ে পালিয়ে গেছে নর্থ ইস্টের দিকে । 

খবর পেয়ে ডেভিড ফিরে আসে। স্ত্রীকে কবর দিয়ে আসার পর থেকে ও গুম মেরে যায়। কাজেও ফিরে যায় না। মাঝে মাঝে শুধু হাঁটতে হাঁটতে চলে যেত কাছাকাছি রেল স্টেশনে। গিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকত স্টেশনের বেঞ্চে। একসময় ফিরেও আসত ঘরে। এরকম কিছুদিন চলার পর একদিন ও বাড়ি ফিরল না। ফিরল দুদিন পর। কিছুদিন বাদে আরো বার দুয়েক এমনটা ঘটল। তারপর আবার। এ সময়ের ব্যবধানে ও চার চারটে খুন করে ফেলেছে। কেউ ঘুণাক্ষরেও টের পায় নি। 

খুন করার জন্য ও সাধারণত বেছে নিত রাতের চলন্ত প্যাসেঞ্জার ট্রেনের নির্জন কামরা। যেখানে গুটিকয় প্যাসেঞ্জার ছাড়া যাত্রীর ভিড় থাকত না তেমন। উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য ও প্রতিবার একই স্টেশন থেকে ওঠে নি কখনও। যেদিন যে স্টেশনে অপেক্ষায় বসে থাকত, সেখানে ট্রেন থামতেই ও দেখে নিত একেবারে পেছনের কামরায় তার মনমতো শিকারটি বসে আছে কিনা।  ট্রেন ছাড়তেই উঠে পড়তো সেই কামরায়। তারপর সুযোগ মতো শিকারকে একা পেয়ে তাকে খুন করে নেমে পড়ত পরের স্টেশনে। চারটে খুন করেছিল ও গলায় ফাঁস লাগিয়ে অথবা গলার নলি কেটে।  ভিক্টিম চারজনেরই বয়স আঠারো থেকে পঁচিশ বছরের মধ্যে। আদালতে ও কবুল করেছে সে কথা। কিন্তু কেন? এ প্রশ্নের ও কোনও সদুত্তর দিতে পারে নি। ও শুধু বলেছে, খুনগুলো করার পর ওর বিন্দুমাত্র অনুশোচনা হয়নি। বরং ভীষণ আনন্দ হয়েছে। এভাবে আরো কত হত্যা করত ও কে জানে। কিন্তু বাধ সাধল সেই বৃদ্ধ। 

-" লোকটা আমার উল্টোদিকের বেঞ্চে বসেছিল। মুখভর্তি দাড়ি। কাঁধে ব্যাগ। চোখে চশমা। গায়ে জোব্বা মতো পোষাক। আমার দিকে তাকিয়ে ছিল স্থির দৃষ্টিতে। ওর চাহনিটা আশ্চর্য রকমের তীক্ষ্ণ। যেন আমার ভেতরটা দেখতে পারছিল বুড়োটা। ওর চোখের দিকে তাকাতে আমার অস্বস্তি হচ্ছিল।"
বলতে বলতে চুপ করে যায় ডেভিড। 
-" তারপর... "

-" আমি ওর চোখে চোখ রাখতেই লোকটা অদ্ভুত একটা কথা বলে ওঠে,' গুনাহগার কো ছমা করনা চাহিয়ে, চাহে ও জিতনা ভি গুনাহ করে... হিংসা ত্যাগ করকে অহিংসা কে মার্গ পে চলনা শিখো বেটা। জীবন মে শান্তি মিলেগি। ' কথাগুলো শুনে আমার মনে হয়েছিল লোকটা বোধহয় কোনও ভাবে জেনে গেছে আমার দুষ্কর্মের কথা। আমার আশংকা হলো, লোকটা যদি ধরিয়ে দেয় আমায়। আমি ওকে জিজ্ঞেস করেই ফেলি, আপ পহেচানতে হো মুঝকো?"

লোকটা নাকি কোনো উত্তর করে নি ডেভিডের কথায়। শুধু একদৃষ্টে চেয়ে থাকে ওর দিকে। সে চাহনি বড় অদ্ভুত শীতল, শান্ত, সমাহিত। এভাবে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর সে নাকি বলেছিল, তোমার মন বড় চঞ্চল
হয়ে উঠেছে। তাকে শান্ত করো। হিংসা দিয়ে কেবল হিংসাই সৃষ্টি হয়। ক্ষমা করো, ক্ষমা করতে শেখো। মানুষকে ভালোবাসো... । 

-" কথাটা শেষ করতে পারেনি লোকটা। তার আগেই ওকে আমি... " বলে কিছু ক্ষণ চুপ থাকার পর ডেভিড  বলে, "তারপর থেকে লোকটা রোজ আমাকে দেখা দেয় ঘুমের ভেতর। হাতে বিরাট এক ক্রুশ। আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে। ওর মাথার ওপর ঐ চারটে অক্ষর ঝলমল করছে। INRI ।"

কিছুদিন বাদে খুব ভোরে ঘুমের ভেতর সেই লোকটাকেই কি আমিও দেখলাম? আর কি আশ্চর্য, ওর পাশে দাঁড়িয়ে আছে ডেভিড! লোকটার হাতে ক্রুশ। ক্রুশের ওপর সেই INRI লেখা। ডেভিড ঐ লেখাটার দিকে আঙুল দিয়ে আমায় দেখাচ্ছে আর হাসছে। কী যেন বলতে চাইছে ও। 

মোবাইলের রিংটোনে ঘুমটা ভেঙে গেল। ওদের দুজনকেও হারিয়ে ফেললাম স্বপ্নের ভেতর । ওপাশে অপরেশ স্যানাল। সিনিয়র এডিটর। 

-" ক্রিস্টোফার, শুনতে পাচ্ছ। এইমাত্র ডেভিডের ফাঁসি হয়ে গেল। জেলারের ফোন এসেছিল। তুমি ওর বন্ধু। সাতসকালে তোমাকে খবরটা দিতে মন চাইছিল না। বাট, ইউ হ্যাভ কাভারড দ্য স্টোরি অফ ডেভিড ফ্রম দ্য ভেরি বিগিনিং। নাও ইউ শুড রাইট দ্য লাস্ট কলাম ফর ইওর ফ্রেন্ড। "

বিছানা ছেড়ে উঠতে ইচ্ছে হচ্ছিল না কিছুতেই। মনে পড়ল হ্যাঁ, আজই তো ঊনত্রিশে ডিসেম্বর। ডেভিডের ফাঁসি হওয়ার কথা তো ছিল আজই। গতকাল সারারাত ঘুমোতে পারিনি। বারবার মনে হয়েছে কেসের মেরিট দেখে কোথাও কি একটুও অবকাশ ছিল না ডেভিডের ফাঁসির সাজা মকুব করার? মহামান্য রাষ্ট্রপতি কি পারতেন না ওকে ক্ষমা করতে? এমন একটি ক্ষেত্রে  "ক্ষমা" শব্দটি যদি ঐশ্বরিক হয়ে উঠতে না পারে তবে তার মহত্ত্ব কোথায়? 

উঠে বসি। ল্যাপটপটা টেনে নিই। শেষ খবরটা তো আমাকেই লিখতে হবে। অভ্যাসবশত চোখটা চলে যায় দেয়ালের দিকে। জেসাসের মুখে সেই অমৃতময় হাসি। মাথার পেছনে দিব্যজ্যোতি। এই মুহূর্তে সব কিছু যেন বড় অর্থহীন মনে হচ্ছে আমার।

আপনাদের মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴
software development company in siliguri,best
                          software development company in siliguri,no 1 software
                          development company in siliguri,website designing company
                          in Siliguri, website designing in Siliguri, website design
                          in Siliguri website design company in Siliguri, web
                          development company in Siliguri