হৃদয়ে গ্রাম্য টান
হৃদয়ে গ্রাম্য টান
শুক্লা রায়
^^^^^^^^^^^^^^
টোটো ধরার জন্য দাঁড়িয়ে আছি। দাঁড়িয়ে আছি মানে হঠাৎ ধূপগুড়ির রাস্তায় টোটো কম পড়েছে তেমন নয় বিষয়টা। তিনটে টোটোকে জিজ্ঞেস করা হয়ে গেল, কুড়িটাকার ভাড়া চল্লিশ টাকা চাইছে। তক্কে তক্কে আছি, কেউ একজন তিরিশ টাকা বললেই উঠে পড়ব। এদিকে হাতে খাবারের প্যাকেট জুড়িয়ে যাচ্ছে প্রায়।
আসলে মেয়েকে নিয়ে বেরিয়েছিলাম ঠাকুর দেখতে। তো দুটো প্যান্ডেলে ঢোকার পর মেয়ের আর কোনো উৎসাহ নেই। বিখ্যাত এস টি এস ক্লাবের প্যান্ডেলে যেতেও অনীহা। অথচ আমরা ঘন্টার পর ঘন্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে তাও ঠাকুর দেখতে ঢুকেছি। আমার মনে পড়ে বিয়ের পরে মেয়ে যখন ছোট ছিল ওকে কোলে নিয়েও লাইনে দাঁড়িয়ে ঠাকুর দেখেছি। আর এখন? দিন কীভাবে পাল্টে যায়। এখন আমি নিজে ধূপগুড়িতে থাকি, ভিড় হওয়ার আগেই ঠাকুর দেখতে পারি। কিন্তু দেখব কাকে নিয়ে! আমার মেয়ের সে উৎসাহই নেই। কানে হেডফোন গুঁজে কেমন নিরাসক্ত ভঙ্গীতে ঠাকুর দেখল। ওর আসল উদ্দেশ্য ভালো-মন্দ কিছু খেয়ে বাড়ি চলে আসা। একদম নিজস্ব জগতে নিশ্চিন্তে বসে ফোনে ডুব দেওয়া। এই যে আমরা দুটো মানুষ একসঙ্গে বেরিয়েছি দুজনের মধ্যে কোনো কথা নেই সেরকম। আমি চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিয়ে একা একা লোকজনের মুখ দেখছি আর নিজের কথা ভাবছি।
"এদিকে তাকা একটু।" কিছুটা গ্রাম্য টানে কচি গলার আওয়াজ শুনে চোখ চলে গেল। তিনটি কিশোরী আমার মেয়ের বয়সীই হবে, বাবার সস্তার চাইনিজ সেটটায় সেল্ফি তুলতে ব্যস্ত। ফোনটার গায়ে অলংকারের মতো একটা লাল গার্ডার জড়ানো।
মেয়েগুলোর উচ্ছ্বলতা, উচ্ছ্বাসে আকৃষ্ট না হয়ে পারলাম না। বিভিন্ন ভঙ্গীতে ছবি তুলে যাচ্ছে। কতক্ষণ তাকিয়ে ছিলাম জানিনা, কথা শুনে সম্বিত ফিরল।
"আর বলবেন না দিদি, সেই বিকাল বেলাতেই আসসি, মেয়েগুলো আমার কথাই শোনে না।"
মুখে শহুরে ভাষা, হৃদয়ে গ্রাম্য টান রেখে লোকটি আমার সঙ্গে কথা শুরু করে। আড়চোখে মেয়ের দিকে তাকাই। কোনো গানের ভেতর মগ্ন হয়ে আছে। মনে মনে হয়ত সেটাই গুনগুন করছে। বাইরের পৃথিবীটা ওর কাছে উদ্বৃত্ত, সেদিকে তাকানোর সময় নেই।
"টাউনের ব্যাপার জানেনই তো! সন্ধ্যা হতে না হতেই টোটো বন্ধ, আর ঢুকতে দেয় না। হেঁটে হেঁটেই গোটা ধূপগুড়ি ঘুরে ফেললাম। তাও ওদের ঠাকুর দেখা ফুরায় না। আর যে পয়সা খরচ দিদি, কি আর বলব। যা দেখে তাই খাইতে চায়। ওর মা আসসে। ওর পিসি। ওরাও খাইতে চায়।"
আমি হাসি হাসি মুখে মাথা নাড়ি। একটু প্রশ্রয় দিয়ে বলি,
"কী আর করবেন দাদা। পূজা তো আর সবসময় হয় না, বছরে এই কটা দিন।"
লোকটা উৎসাহিত হয়ে মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলে,
"হ্যাঁ, এই কথাই দিদি। তা আমি বলি, কি আর করা যাবে। পয়সা যাবে, আসবে। করুক একদিন আনন্দ।"
সঙ্গের মহিলা দুজনের দিকে চোখ পড়ল, আমার দিকেই তাকিয়ে। এম্ব্রয়ডারি করা চকচকে সুতোর কাজের জমকালো শাড়ি, হাতে ক্ষয়াটে, কালো দাগ পড়া বিবর্ণ শাঁখা-পলার পাশে সোনালী রঙ করা চুড়ি, কানে সেরকমই দুল। নারকেল তেলমাখা রুক্ষ লালচে চুল যত্নে আঁচড়ানো হলেও এখন ঘুরে বেড়ানোর ধকলে অনেকটাই এলোমেলো। সিঁথির সিঁদুর গলে নামছে কপাল ছুঁয়ে। আমি একটা সৌজন্যমূলক হাসি দিলাম। তারাও কিছুটা সসংকোচে হাসিটা ফিরিয়ে দিল। আসলে ওদের চোখে আমি খুব সুখী মানুষ। ঝাঁ চকচকে দামি ফোন এক হাতে। অন্য হাতে খাবারের প্যাকেট। স্টাইল করে কাটা চুল, আধুনিক সাজ-পোশাক। যত্নে আঁকা ঠোঁট, ভুরু। শাঁখা পলা নয়, এক হাতে নোয়া, অন্য হাতে স্মার্ট ওয়াচ। বড় বড় চোখ করে একজন আমার অদ্ভুত ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে। নিজেকে লুকোনোর একটা বড় মুখোশ হল সাজ-পোশাক। এটা আমরা শহরবাসি ঠিকঠাক আয়ত্ব করে ফেলেছি।
আমাদের কথার মাঝেই মেয়েগুলো স্বভাবসুলভ উচ্ছ্বলতায় আব্দার জুড়ল,
"বাবা, অল্প একটু মেলায় ঢুকি না। ঢুকেই বেরিয়ে আসব। কিছু কিনব না।"
ওদের আব্দারের কাছে একটু একটু করে আর্দ্র হতে দেখছি লোকটাকে। জানি একটু পরেই মেলায় নিয়ে যাবে। এরমধ্যে টৌটৌ পেয়ে যাওয়াতে আমি উঠে বসি। নির্বাক। মেয়ে হেডফোনে গান শুনতে শুনতে মাথা নাড়াচ্ছে। আপনমনে নিজের জগতে, নিজের ছন্দে মগ্ন। বাইরের এত আলো, এত ভিড়, এত হৈ চৈ কোনো কিছুই ওকে স্পর্শ করছে না। অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল। আধুনিক প্রযুক্তি আমাদের কেমন একা করে দিয়েছে। পাশের লোকটির উপস্থিতিও মূল্যহীন হয়ে পড়ছে ক্রমশ।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴