সড়ক-ই-দিল
সড়ক-ই-দিল
সৌগত ভট্টাচার্য
-------------------
দেরি করে ঘুম ভাঙে মিনা বাজার গলির...
অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে ঠান্ডা না পড়লেও হিম সাদা হয়ে যায় জামা মসজিদের আসমান ছোঁয়া মিনার। চাঁদনী চক বাজার থেকে ছানি পড়া চোখের মত ঝাপসা দেখায় জামা মসজিদকে। ভোরের দিল্লি গভীর রাতের চেয়েও একলা।
সিপাহীদের বিদ্রোহের পর থেকে বৃদ্ধ বাহাদুর শাহ লাল কিল্লা থেকে বেরোনোর পথ ভুলে গেছেন। তাই কিল্লার বাইরে বিশেষ বের হওয়া হয় না। তিনি হিন্দুস্তানের শাহেনসা! কিল্লা থেকে জোছনা দেখলে বাহাদুর শাহর দিল খুশ হয়ে যায়। তামাম হিন্দুস্তানের আসমানে পূর্ণিমার চাঁদ বলেই নিজেকে মনে করেন বৃদ্ধ। লাল কিল্লার থেকে চাঁদ দেখা গেলেও ইট ভেদ করে ভাঙনের শব্দ পৌঁছায় না বৃদ্ধের কানে! মিনা বাজারের গলিও ইদানীং বাহাদুর শাহের পায়ের শব্দ প্রায় ভুলতে বসেছে। সে রাস্তা জানে শাহেনসা মসজিদে নামাজ পড়তে আসলে ভিখিরির গন্ধ থাকে না রাস্তার ধারে। রাস্তার ওপর বৃদ্ধের পায়ের স্পর্শ বড়ই অশক্ত, ঠিক যেন সিপাহী বিদ্রোহের পর মুঘল শাসনের মত। বাদশার প্রতিটি পদক্ষেপে ভাঙনের শব্দ পায় মিনা বাজার গলি। একসময় এই রাস্তা আকবর শাহজাহান আওরঙ্গজেবের পায়ের শব্দ চিনত--- দূরের হিন্দুস্তানকে ক্রমশ ঝাপসা দেখায় আজকাল। রক্তহীন বৃদ্ধ বাদশার আজকাল বেশি শীত লাগে, কেমন যেন ফ্যাকাশে কুঁকড়ে যান তিনি। নবাব কিল্লায় ফিরে গেলে ভিখারির দল রাস্তার ধারে আগুন ধরায়। এই শীতের আগুনে কি পুড়বে গোটা হিন্দুস্তান!
কয়েক মাস হল সিপাহী বিদ্রোহ হয়ে গেছে। চামড়ার বুটের এক অচেনা শব্দে মাঝে মাঝেই চমকে ওঠে মিনা বাজার গলি। বিদ্রোহের খবর নবাবী ডাক ব্যবস্থা আগাম জানায়নি। মিরাট থেকে ব্যারাকপুরের দূরত্ব যোজন কাল বেড়ে গেছে কিছুদিন হল। তবু দিল্লির নীল আকাশে সাদা কবুতরের ডানা ঝাপটানোর শব্দ শুধু। গোটা হিন্দুস্তানের সব রাস্তারা কোম্পানির সৈন্যের বুটের শব্দ আস্তে আস্তে চিনে ফেলছে। মিনা বাজারের রাস্তার বড় ব্যথা লাগে এই বিলাইতি বুটের আঘাতে। নাগড়াই এর থেকে সাহেবি বুটের গোড়ালি শক্ত। এই পথ এখনো বিদেশি ভাষা শিখে উঠতে পারেনি। মিনা বাজার গলি থেকে ভোরের কুয়াশা মাখা সোজা চলে যাওয়া রাস্তাটা দিয়ে এত অনায়াসেই ইন্ডিয়ায় পৌঁছানো যায় কি!
আতরের গন্ধ আর টলমল পায়ের স্পর্শের জন্য অপেক্ষা করে সারারাত অপেক্ষা করে মিনা বাজার গলি। নিস্তব্ধ করে দেয় চারপাশ নিজের সাধ্য মত। সব পথ বাতির গ্যাস পুড়ে গেলে হিম ঝড়ে রাস্তার বুকে। নিজেকে পিচ কালো কাজলে সাজায় কবির জন্য। সেই কবি, যে ভোরের রাস্তার মতোই নির্জন, একলা। মিনা বাজার গলি দিয়ে হাভেলির দিকে ধীরে ধীরে ভোর বেলার হেঁটে যায় কবি। চার দেয়ালের হাভেলি তো তার দুনিয়া না! দুই বার উচ্চারণ করা শায়েরীর পংক্তির মতোই আদুরে কবির হেঁটে যাওয়া। একলা রাস্তা জোছনা রাতে অবাক উর্দু শায়েরী শোনে। রাতের রাস্তার শেষে কোনো হাভেলি থাকে না, দেওয়াল থাকে না, রাস্তার শরীর জুড়ে শুধু জোছনা মাখা থাকে। যেমন কবির হৃদয়ে কোনো মানুষের ঘরবাড়ি থাকে না, থাকে শুধু রাস্তার মতোই গন্তব্যহীন এক দিল। কবির মসলিনের জোব্বা ঠেকে যায় কাজল কালো রাস্তার বুকে।
শাসক পাল্টালে রাজধানীর নিরাসক্ত রাস্তারা সবার আগে টের পায়। মিনা বাজারের অভিমানী গলি বহুবার হিন্দুস্তানের শাসক পাল্টাতে দেখেছে রাজধানীর বুকে। কিছু যায় আসেনি তার! শুধু অভিমানগুলো ধুলো মাটি কাদার স্তূপ হয়ে জমে আছে,রাস্তার পাশে, বাকিটা বুকের ভেতর! এক বাদশার থেকে অন্য বুটের শব্দ স্পর্শ চেনে এই গলি। সব শব্দই যেন ক্ষণিকের! তারপরও এই সড়ক হিন্দুস্তানের কবুতর ওড়ানো বাদশার জন্য নয়, বিদেশি কোম্পানির শাসকের জন্য নয়, শুধুই উর্দু শায়েরীর জন্য রাতভোর জেগে থাকে, নিজেকে নির্জন করে, ভোর বেলা এক ক্লান্ত কবির বাড়ি ফেরার অপেক্ষায়!
মির্জা গালিব হেঁটে যান মিনা বাজারের গলি দিয়ে…
সারারাত কবির জন্য জেগে দেরি করে ঘুম ভাঙে মিনা বাজার গলির...
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴