স্বপ্ন পূরণ
স্বপ্ন পূরণ
চিত্রা পাল
^^^^^^
দূর থেকেই একটা কান্নার আওয়াজ শুনতে পেলো, কান খাড়া করে শোনার চেষ্টা করে শিবু,হ্যাঁ,যা ভেবেছিলো তাই। ওর ছেলেটাই কান্নাকাটি করছে। নিশ্চয়ই খেতে বসে বায়না করছে।এবার কান্নার আওয়াজটা বেশ জোরে হতে লাগল, তাহলে লক্ষ্মী কি ওকে আবার মারধোর করতে শুরু করেছে? এই চিন্তাটা মাথায় আসতেই ও জোর কদমে বাড়ির দিকে পা চালিয়ে দিলো। শিবু বুঝতে পারছে ওর ছেলে নিশ্চয়ই খেতে বসে মাছ খাবার বায়না করছে। কিন্তু ও রোজ রোজ মাছ কোথায় পাবে, কি করে জোটাবে? রোজ ভাত পাচ্ছে এই ঢের তায়
আবার মাছ।আসলে এই লকডাউনের বাজারটাই কাল হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো ওর কাছে। কোন কাম কাজ নেই। কেউ দালান কোঠা তোয়ের করে না, মাটি কাটায় না, বাড়িঘর রঙ করায় না, তাহলে ও খাবে কি। ও তো রোজ এসব কাজ করে খায়, এসব কাজ সব বন্ধ, তাই ওরও কাজ নেই। ছেলেটাকে ইস্কুলে দিয়েছিলো, সেখানে যা হোক দুপুরটা খাচ্ছিলো, তা এবার সেও বন্ধ, শুধু ঘরে বসে চারটে মুখে কি দেবে সকাল থেকেই শুধু সেই ভাবনা মাথায় ঘোরে। মেয়েটা ছোট, কিন্তু ওরা তিনজন কি খাবে। কখনও কিছু সাহায্য পেয়েছে, কখনও কোথাও লঙ্গরখানায় খেয়েছে দুপুরে,রাতে দুমুঠো মুড়ি, তাও একএকদিন জোটেনি। ওদিকে আয়লার ঝড়ে ঘরের চালখানা উড়ে যেতে যেতে কোন রকমে টিঁকে আছে। চালটা যে এবার সারাতেই হবে।না হলে এবারের বর্ষায় ঘরে থাকা আর বাইরে থাকা একই হয়ে যাবে। তার মধ্যে কদিন ধরে ছেলেটা খেতে বসলেই মাছ খাবো বলে যে কান্না ধরে,তারপরে আর ভাত খেতেই চায় না। আর কিছুইতো খেতে দিতে পারে না, এক গাল ভাত যদি পেটে না যায় তাহলে ওকে বাঁচাবে কি করে।
কুয়োতলায় হাত পা ধুয়ে এসে ছেলেকে কোলে নিয়ে বুঝিয়ে বলে, আজ তুইখেয়ে নে,তোকে পরে মাছ খাওয়াবো ঠিক দেখে নিস্। এই এত্তো বড় বড় মাছের দাগা দিয়ে। ছেলে অবাক হয়ে বাপের দিকে তাকায়। শিবু মনে ভাবছে, এখন লক ডাউন উঠে গেছে। রোজই চেষ্টা করে কিছু না কিছু কাজ করতে। তাও মাঝে সাঝে এক একদিন কাজ না জুটলে বসেও থাকতে হয়। ওর মতো সবায়েরইতো একই হাল যে।দেখা যাক্, কাল যদি কাজ হয়, তাহলে মালিককে বলে আর একদিনের কাজের টাকা বাড়তি নিয়ে ধার করেই নাহয় খানিকটা মাছ নিয়ে আসবে। যাই হোক ছেলেকে বুঝিয়ে শুনিয়ে খাইয়ে দাইয়ে নিজেরাও খেয়ে নিয়ে কুপি নিবিয়ে মাচার বিছানায় শুয়ে পড়ে। কেননা কুপিটা জ্বেলে রাখলেও তো তেল খরচ, এখন যে তেলের দাম। শুয়েও ঘুম এলো না, ঘরের চালা ঠিক করবে না, একদিন ভালো করে ভালোমন্দ খাবে সেই চিন্তাটাই ওর মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে।
একটা সুখস্বপ্নে ঘুম ভেঙ্গে গেল শিবুর। ঘুম ভেঙ্গে যাবার পরে চোখ কচলে দেখল, না কোনো খাবার জায়গায় নেই। বিছানাতেই আছে, পাশে লক্ষী ঘুমোচ্ছে অকাতরে। লক্ষীর বুকের কাছে খুকী। ওপাশে খোকা এপাশ থেকে ওপাশ ফিরে শুলো। তাহলে এমন বড় বড় মাছের দাগার ঝোল দিয়ে ভাত খাচ্ছে সেটা তো স্বপ্নই। আজ কতদিন ঠিকমত কাজ নেই। লকডাউনের বন্ধ হয়ে শেষ হয়ে আবার সব আগের মতো কাজ চালু হয়েছে ঠিকই,কিন্তু ওর ধার দেনা এখনও মেটেনি, কবে মিটবে কে জানে। খোকাটা কদিন ধরে মাছ খাব মাছ খাব করছে তো সে আর আনতে পারছে কই। তবু ওদের জন্যে দুদিন ডিম এনে দিয়েছে। বোধ হয় সেই সব কথাই ভাবছে ,তাই স্বপ্ন দেখেছে।
আজ যেমন করে পারি যদি টাকা ধার করতে হয় তাও একটু মাছের খোঁজ করবো। এই সব ভেবে শেষ রাতে ঘুম ভেঙ্গে যাওয়ায় ভোর ভোর ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে। সবে পুব আকাশটা ফরসা হচ্ছে, দু একটা পাখপখালি ডাকতে সুরু করেছে।শিবু আন্মনে বড় রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে চলে এলো যেখানে, সেখানে বাম্পার রয়েছে। গাড়ির স্পীড কমাতেই হয় এখানে, তাই এই জায়গায় মাঝে মাঝে পুলিশ থাকে গাড়ি চেকিং এর জন্যে। এতো সকালে আজ কেউ নেই।একটা বড় ট্রাক আসছে দেখে শিবু দাঁড়িয়ে পড়ে।ট্রাকটাও স্পীড কমিয়ে ধীর গতিতে বাম্পার পেরিয়ে যাচ্ছে। ওকে পেরিয়ে যাবার সময় ট্রাক থেকে কি একটা পড়লো যেন। কাছে গিয়ে দেখে মাছের ট্রাক থেকে কি করে যেন বরফ সমেত একটা বড় মাছ পড়ে গেছে। ও তাড়াতাড়ি দৌড়ে গিয়ে ওই বরফ দেওয়া ঠান্ডা মাছখানাকে জাপটে নিয়ে রাস্তার ধারের কলাগাছ গুলোর ভেতরের আড়ালে দাঁড়ালো যাতে ওকে ট্রাকের লোকজন দেখতে না পায়,খুঁজে না পায়।ওরকম জায়গায় অনেক সময় সাপ খোপের বাসা থাকে।আজ শিবু মরিয়া হয়ে সব ভয় জয় করে ফেলেছে। ওদিকে ট্রাক থেকে একজন খালাসি নেমে ওকে খুঁজতেই এদিকে আসছে। তাই দেখে শিবু কলাগাছের জঙ্গল থেকে বেরিয়ে জোরসে দৌড়লো এব্ড়ো খেব্ড়ো ক্ষেতজমি পেরিয়ে আল পথ দিয়ে ঘরের দিকে।পেছনে খালাসি যে সেও ওকে দেখতে পেয়ে ধাওয়া করেছে ধরার জন্যে। কিন্তু না শিবুর সঙ্গে পারবে কেন? ও আজ প্রাণপণ দৌড়চ্ছে। খোকার চাওয়া, ওর স্বপ্ন পূরণ করতে হবে যে।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴