সেদিনও বৃষ্টি ছিল
রম্যাণী গোস্বামী
÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷
-
মনে আছে জুঁই? তুই একদিন সকাল সকাল পড়তে এসেছিলি তোর স্যারের কাছে? তোর
স্যার মানে আমার বাবা। আদর্শ বিদ্যাপীঠের ইংরেজির শিক্ষক। কিন্তু বাবা তখন
বাড়ি ছিল না। মা-ও ভিতরের ঘরে রান্না নিয়ে ব্যস্ত। আমি তো জানতামই তোর একলা
পড়তে আসার কথা। তাই শুধু পাগলের মত ঘর বারান্দা করছি। দূর থেকে তোকে আসতে
দেখে এক দৌড়ে ঘরে গিয়ে সোজা পড়ার টেবিলে ল্যান্ডিং। বুকের মধ্যে ধড়াস ধড়াস।
যেন এখনই দুই গোলে জিতিয়ে দিয়েছি আমার স্কুল টিমকে। অথবা যেন এইমাত্র
ক্লাস টিচার প্রণববাবু রেজাল্ট লেখা কাগজ হাতে নামগুলো পরপর আওড়ে উঠলেন। আর
আমার নাম এক নম্বরে! বুকের মধ্যে পিংপং বলটা সেভাবেই নেচে চলেছে। থামবার
নামটি নেই। ওদিকে কিন্তু কান খাড়া করে রেখেছি। কখন বেলটা বাজবে। সবুজ
কুর্তি ছিপছিপে মেয়েটা এসে দাঁড়াবে আমার দোরগোড়ায়।
-
হ্যাঁ, স্যারের সেদিন কলকাতা থেকে ফেরার কথা। কিন্তু কী একটা কারণে ট্রেন
লেট ছিল। তখন তো এখনকার মত মোবাইল ফোন চালু হয়নি। মোবাইল দূরের কথা।
ল্যান্ডফোনই সবার বাড়িতে ঢোকেনি। তুমি আওয়াজ পেয়ে ঘরের ভিতর থেকে বেরিয়ে
এসে দরজা খুললে। বাইরে তখন অদ্ভুত এক ভরভর্তি মেঘলা আকাশ আমার মাথার উপরে
ঝুলে আছে। যেন একবার, আঙুল দিয়ে একটি ইশারা করলে সে এখনই ঝাঁপিয়ে পড়বে আমার
উপর। ভিজিয়ে দেবে আমূল। চব্বিশ বছর আগে ওমন উন্মুখ আকাশ দেখলে আমার ভয় করত
অর্কদা। এক বুক ভাললাগায়, রোমাঞ্চে মরে যেতে ইচ্ছে করত। দেখলাম গ্রিলের
ওপাশে তুমি দাঁড়িয়ে। মাথাটা সামান্য হেলানো উপরের দিকে। তোমার চোখের ভিতরে
যেন সেই আকাশটার ছায়া এসে পড়েছে। আকাশটা কখন যেন নিজেই ঢুকে পড়েছে তোমার
দু’চোখে। দারুণ ভয়ে কেঁপে উঠলাম আমি।
- চব্বিশটা বছর! উফ্, তুই সত্যি বলছিস জুঁই? এতগুলো দিন পেরিয়ে গেল? যাচ্চলে! আমরা তো দুজনেই বুড়ো হয়ে গেলাম রে!
- অ্যাই, খবরদার আমাকে বুড়ো বলবে না। আমি কিন্তু তোমার চাইতে পাক্কা দু’বছরের ছোট। এখনও তোমার মত চালশে পড়েনি। মনে রেখো।
-
হ্যাঁ, তাই তো। বুড়ো কেন হবি? তুই তো বুড়ি। চিরকালই একটা পাকা বুড়ি ছিলি
জুঁই। ময়নাগুড়ির মত একটা ছোট্ট শান্ত শহরের বেচারা বাচ্চা বাচ্চা ছেলেগুলোর
মাথা একেবারে চিবিয়ে খেয়েছিলি।
-
বাহ, আমি মাথা চিবিয়ে খেয়েছিলাম বুঝি? চমৎকার! এখন তো তোমার মুখে বেশ বুলি
ফুটেছে দেখছি অর্কদা। সেদিন কোথায় ছিল তোমার এই সাহস? আমার এখনও মনে আছে।
ঠায় তিনটি ঘণ্টা বসে ছিলাম সেদিন তোমাদের বাড়ির বাইরের ঘরে একা। বাড়িতে
সবাই জানে যে স্যারের অপেক্ষায়। কিন্তু মনে মনে কি আর কোনও প্রত্যাশা ছিল
না আমার বলতে চাও? একটি কিশোরী মেয়ে বসে আছে কেবল ইংরেজি গ্রামারের কতগুলো
শুকনো কচকচি শুনবে বলে? জানও? ওই দু’ঘণ্টা পাশের ঘর থেকে অনবরত তোমার গলা
খাঁকারি দেওয়ার বিচিত্র আওয়াজ শুনেছি আমি? প্রতিবার ভেবেছি, এই বুঝি তুমি
এলে পর্দা সরিয়ে। কিন্তু না। তুমি এলে না। এত ভীতু ছিলে? এত?
-
না, ভীতু না। তাছাড়া আমি তো তোর সঙ্গে কোনওদিন ফ্লার্ট করতে চাইনি জুঁই।
সেক্ষেত্রে হয়ত বলা যায় অনেককিছু। বানিয়ে বানিয়ে। আর তখন আমি ছোট ছিলাম রে।
মাধ্যমিকটাও দিইনি। সাধারণ মধ্যবিত্ত ঘরের সাদামাটা ছেলে। দেখতে খাস কিছু
নয়। পড়াশোনা, খেলাধুলা সবেতেই সো সো। মানে মিডিওকার আরকী। স্কুলের রেজাল্ট
কোনওদিন তেমন আহামরি নয়। আর আমার পাশে তুই? বাপ রে! ময়নাগুড়ি কলেজের নামী
অধ্যাপকের একমাত্র আদুরে মেয়ে। পড়াশোনায় দারুণ। স্কুলের ফার্স্ট গার্ল। তার
উপরে অপরূপ রূপসী। আমার তখন ভিতরে ভিতরে সেই কনফিডেন্সটাই জন্মায় নি। রাগ
করছিস কেন? কতদিন পরে দেখা হল। ঝগড়া করবি তবু?
-
ঝগড়া? ঝগড়া তো করছি না। সিম্পলি জানতে চাইছি অর্কদা। পরে তো জন্মেছিল
তোমার সেই কনফিডেন্স? তাই না? কলেজে ভর্তি হয়ে দেখি তোমার কী প্রতিপত্তি
স্টুডেন্টদের মধ্যে! তুমি তখন ডিপার্টমেন্টাল টপার। ডিবেট কম্পিটিশনে
ফার্স্ট। কলেজ ম্যাগাজিনের সম্পাদক আর সেই সঙ্গে সম্ভাবনাময় একজন কবি। আবার
স্টুডেন্ট ইউনিয়নের লিডারও। নানা বয়সী ছেলেরা, সুন্দরী মেয়েরা সবসময়
তোমাকে ঘিরে আছে। অর্কদা, অ্যাই অর্ক, শুনুন অর্কপ্রভ স্যার – আহা! কত
ধরণের সম্বোধন। ঢং দেখে মরে যাই। আর আমি যে এইচ এসে মোটামুটি রেজাল্ট করে
খোদ তোমাদের ডিপার্টমেন্টেই ভর্তি হলাম? একবারও এসেছিলে যেচে কথা বলতে?
নাহ্। এবারেও তুমি আসো নি।
-
কীভাবে যাব বল দেখি? কলেজে ভর্তি হয়ে তোর সে কী ভয়ঙ্কর দেমাক তখন। আর হবে
না? টি. কে. এম. এর সুন্দরী মেয়ে বলে কথা। তোর আশেপাশে কত স্তাবক! ছেলেরা
ল্যাংল্যাং করে ঘুরছে তোর পিছনে। আর তুইও ব্যাপারটা যথেষ্ট এনজয় করতিস।
কিন্তু তোর দু’চোখে কখনও দেখেছি বোধহয় বর্ষার মেঘ ঘনিয়েছে। আমি তো চলে
গেলাম ইউনিভার্সিটি। বাড়িতে মায়ের কাছে শুনতাম, দিনে দিনে নাকি তোর রেজাল্ট
খারাপ হচ্ছে। কলেজে উঠে ঠিক করে পড়াশোনাটা করিস নি কেন রে জুঁই?
-
অত জবাবদিহি করতে পারি নে বাপু। এবার উঠতে হবে। দূরে দ্যাখো, সূর্যটাও
কেমন নদীর বুকে ডুবি ডুবি করছে। মেয়েটাকে মায়ের কাছে রেখে এসেছি। আমি ঘাড়
ধরে না বসালে একফোঁটা হোমওয়ার্ক করবে না। তখন ফোনে ওর বাবার কাছে বকা খাব
আমি।
- বাপরে! ক’দিনের
জন্য অফিস ছুটি নিয়ে বাড়ি এসেছিস, এখানে এসেও তোর মেয়ের পড়াশোনা চলছে?
পারিসও তোরা আজকালকার বাবা মায়েরা মাইরি। উফ! শালা, ভাগ্যিস বিয়ে ফিয়ের
ঝামেলায় যাইনি। হ্যাঁ রে জুঁই? কর্তামশাই কি শুধুই বকে? রাতে আবার ডাবল আদর
করে পুষিয়ে দেয় না?
-
বাজে বোকও না তো। আর অত জোরে জোরে হেসো না। কেবল ইয়ার্কি তোমার। আহ্, আমার
অত কাছে ঘেঁষে এলে কেন অর্কদা? সরে বসও। ওই দ্যাখো বাঁধের উপরে ছেলেগুলো
ফুটবল খেলা বন্ধ করে ঘাড় ঘুরিয়ে আমাদেরই দেখছে। ওদিকে আকাশের অবস্থা কিন্তু
খুব একটা ভালো নয়, দেখেছ? যখন খুশি নামবে।
-
সেদিনও তুই টিউশন পড়তে আসার পরপরই চারিদিকে অন্ধকার করে কেমন ঝুম বৃষ্টিটা
এল? মনে আছে তোর জুঁই? দেখতে দেখতে আমাদের বাড়ির সরু গলিটায় হাঁটু জল
দাঁড়িয়ে গেল। সেই সঙ্গে লোডশেডিং। অনেক পরে মা যখন কী একটা দরকারে বাইরের
ঘরে ঢুকেছে, তোকে চুপচাপ একাকী অন্ধকারে ভূতের বসে থাকতে দেখে মায়ের সে কী
অবাক হয়ে যাওয়া! তারপর তোর সামনেই আমাকে ডেকে এনে কী ঝাড়টাই না ঝাড়ল মা।
কেন এতক্ষণ মেয়েটাকে শুধুশুধু বসিয়ে রেখেছিস - এইসব বলে। কারণটা কি সেদিন
আমি নিজেও জানতাম? যা হোক। তারপর তোর পিশেমশাই আসলেন হাঁটু অবধি প্যান্ট
গুটিয়ে তোকে বাড়ি নিয়ে যেতে। গলির মাথায় রিকশা দাঁড়িয়ে আছে। ভিতরে ঢুকতে
পারেনি। ইস, অতটা জলকাদা ঠেলে ঠেলে মোড় অবধি যেতে তোর খুব কষ্ট হয়েছিল না
রে জুঁই। আমার জন্যই সেদিন তোর অত দুর্ভোগ। আমি ভীষণ সরি রে।
- তুমি কি সামনাসামনি এই সরি-টুকু বলার জন্যই চব্বিশ বছর পরে ফেসবুক খুঁজে খুঁজে আমাকে এখানে ডেকে আনলে অর্কদা?
-
হ্যাঁ রে। ঠিক বলেছিস। এই সরি-টাই এতদিন বলতে চেয়েছিলাম। বলা হয়ে ওঠে নি।
আর ভয় একটাই। হয়ত এইটে বলার পর আমাদের মধ্যে আর কোনও কথা বেঁচে থাকবে না
জুঁই। আমি তোকে রোজ সকালে গুড মর্নিং, রাতে গুড নাইট, দিনের শেষে, আজ কী
টিফিন খেলে? এসব আটপৌরে কথোপকথনের সঙ্গী করে উঠতে পারব না কোনওদিন। যাগকে,
ঠিকমত বোঝাতে পারছি না বোধহয়।
- বোঝাতে চেয়েছিলে কখনও?
- মানে?
-
লিভ ইট অর্কদা। বেশ। আজকের পর আমরা আর কোনওরকম যোগাযোগ করব না। নো চ্যাট।
নো ফোন কল। কেমন? শুধু একটাই অনুরোধ। তুমি কবিতা লেখাটা ছেড়ো না। নাও, এখন
চলো। ওঠা যাক।
- একবার
তাকিয়ে দ্যাখ না জুঁই, দূর থেকে কেমন ঝাপসা বৃষ্টিটা ধেয়ে আসছে এদিকে।
অনেকটা ঘোড়ার ক্ষুরের মত একটানা ঝমঝম আওয়াজ, শুনতে পাচ্ছিস? তুই শুনতে
পাচ্ছিস? ওই দ্যাখ, বাঁধের উপরের চায়ের দোকানটার ঝাঁপ তুলেছে। চল ওখানে বসে
বসে দেখি আমাদের ছেলেবেলার সেই বৃষ্টিটা আজ কতখানি বদলে গিয়েছে।
-
তুমি পরে মন খুলে যত পারও দেখো তোমার ডুয়ার্সের বৃষ্টিকে। আমার বর্তমান
এখন কলকাতার প্যাচপ্যাচে বর্ষায়। অর্কদা, চলও, বাইকটা এবার স্টার্ট করও, ওই
সর্বনাশী বৃষ্টিটা এসে আমাদের ধরে ফেলার আগেই আমাকে বাড়ি ফিরতে হবে।
#
আকাশটাকে একলা রেখে দ্রুত চলে গেল ওরা। আর তখনই নামল দিগন্তজোড়া বৃষ্টিটা।