সহজ উঠোন

রেজিস্টার / লগইন করুন।

সব কিছু পড়তে, দেখতে অথবা শুনতে লগইন করুন।

Sahaj Uthon

সেই ছেলেটি ও লাঠি/প্রশান্ত নাথ চৌধুরী

সেই ছেলেটি ও লাঠি
প্রশান্ত নাথ চৌধুরী
-----------------------

ডুয়ার্স, তরাই, ভূটান পাহাড়ের নিম্নদেশ, সম্পূর্ণ কালিম্পং আর দার্জিলিং পাহাড়ের বেশ কিছুটা জুড়েই আমার জন্মস্থান ডুয়ার্স, নিজের একান্ত সীমানা। ভুটানের দুয়ার বা পুবের দুয়ার থেকেই না হয় ডুয়ার্স-এর নামকরণ। “নামে কি আসে যায়” বলেছিলেন কবি। ডুয়ার্স প্রকৃতির সন্তান তার কোন নির্দিষ্ট ভৌগলিক সীমানা নির্দ্ধারণের চেষ্টা না করাটাই শ্রেয়। ভ্রমণে বেড়িয়ে সর্বদা ভেবেছি , মনে মনে তুলনা করে দেখেছি ডুয়ার্সের ঝরনা, নদী, চির সবুজ বনাঞ্চল, বন্যপ্রাণ, আদিবাসী সমাজ তাদের জীবনযাত্রা সবকিছু মিলিয়ে যে পটচিত্র তা অতুলনীয়। মানছি, সাগরের একটা আলাদা মোহ, জোয়ার- ভাঁটার বৈচিত্র, সূর্যাস্ত-সূর্যোদয়, দিগন্তব্যাপি বালুকাবেলা অনুপম। বন জঙ্গল, বন্যপ্রাণ নদী-নালা নিয়ে ডুয়ার্স এক অনন্য স্বপ্নের দেশ।
বৃটিশ অহঙ্কারের’ লখ্ নেস’ বা ‘লখ্ লেমন্ড’ দুটি সমুদ্রসম লেক। স্কটল্যান্ডের প্রাচীন দূর্গ আর বিক্ষিপ্ত বনপথের মাঝে যখন গাইড লেকের গভীরে রাক্ষসের গল্প বলছিলেন, ভাবছিলাম বৃটিশরাও পর্যটক আকর্ষণে আষাঢ়ে গল্পের সাহায্য নিয়ে থাকে। লখ্ নেসের বা লখ্ লেমন্ডের পথ শোভার চাইতে লাটাগুড়ি থেকে চালসা হয়ে মালবাজার ছুঁয়ে সেবক হাজারগুন আকর্ষনীয়। যেটা ভাল লেগেছিল তা ড্রাইভার কাম গাইডের অনবদ্য ধারা বিবরণী আর কয়েক শতবর্ষের ইতিহাস স্পর্শ করে যাওয়া। অভিভূত হয়েছিলাম যখন জানলাম ড্রাইভার ভদ্রলোক কলেজে পড়ান এবং ছুটীর দিনগুলোতে ভিনদেশী পর্যটকদের নিয়ে মার্সেডিস বেঞ্চ গাড়ী চালিয়ে অনর্গল স্থান মাহাত্ম্য বর্ণনা করেন মোটা পারিশ্রমিকের বিনিময়ে। শ্রমের মর্যাদাই এদেশের শেষ কথা।
জীবিকার তাগিদে ডুয়ার্স চষে বেরিয়েছি। আর পথের সৌন্দর্যে বা মোমোর স্বাদে আকৃষ্ট হলে জায়গাটিতে বারবার গেছি। বাসের উপযুক্ত কি না বিচার না করেই প্রায় জবরদস্তি রাত্রি বাস করেছি এমন উদাহরন কম কিছু নয়। আমার মনখারাপের চিরকালের সান্ত্বনা ডুয়ার্সের পথ প্রান্তর, চা পাতার মোহময় সুবাস। কোভিডের কারণে জীবন যখন তালাবন্ধ, চাবিটিও বেপাত্তা, তখনও ডুয়ার্সের জঙ্গল, পাহাড়ে ঘুরে বেড়িয়েছি। কখনও পরিজন সাথে, কখনও একা।
সেদিন দ্বিতীয়বারের ভ্রমণে গিয়েছিলাম কালিম্পং জেলার গরুবাথান ব্লকের ‘তোদে’ নামে এক প্রান্তিক গ্রামে। অপার্থিব এক যাত্রাপথ। সেদিন হেমন্তের ঝকঝকে নীল আকাশ ছিল অকপট। জলপাইগুড়ি থেকে বেরিয়ে রাজবাড়ির গেট ছাড়তেই উত্তর দিগন্তে রূপালি মোড়কে ভাস্বর হয়ে উঠেছিল কাঞ্চনজঙ্ঘা। জাতীয় সড়কে উঠতেই বাম আকাশ প্রান্তে তার অবস্থান, আবার মালবাজার রোডে তাকে দেখা যায় ডান প্রান্তে। চোখ ঝলসানো তার রূপ।
এলাম লাটাগুড়ি। ছোট্ট এই জনপদ পর্যটকদের প্রিয় গন্তব্য। শোনা যায় স্কচের অফুরান ভান্ডার এখানেই। একসময় প্রকৃতি পর্যবেক্ষন কেন্দ্রের সামনে সবুজ জীপসি গাড়িগুলো ভিড় করে দাঁড়িয়ে থাকত, পর্যটকদের সাফারি শুরু হত যে এখান থেকেই। সেদিন জীপসি গাড়ির সংখ্যা হাতে গোনা। ইনোভা গাড়ির স্থানীয় চালক সুশীল বলেছিল “পর্যটক দু-চার জন আসছেন। বেশীর ভাগ দল নিজেদের গাড়ি নিয়ে কলকাতা থেকে সরাসরি এসেছে, বহু ট্রেন এখনো চালু না হওয়ায় চার-চাকায় যাতায়াত। স্থানীয় যুবক যারা ধার করে গাড়ি কিনেছেন তাদের ব্যবসা নেই, ঋণ বুকের উপর চেপে বসেছে। আমরা খুব কষ্টেই আছি”।
১৯৫৮ সন থেকে লাটাগুড়ি দিয়ে আমার যাতায়াত। সে সময় শালের গোল খুঁটির উপর বেশ উঁচুতে টিনের চালের বাংলো আকৃতির ২০-২৫ টা বাড়ি ছিল রাস্তার ধারে। আর ছিল বেশ কিছু কাঠ চেরাই-এর কল। আমাদের এক কাকা বলতেন “এটা কাঠ চেরাই নয় চোরাই কাঠের আখড়া”। দু-চারটি দোকান নিয়ে জনপদটি ছিল ভারি চমৎকার। লাটাগুড়ি ঘিরে আছে বনভূমি আরএকটা রেলপথ। মাল থেকে বন জঙ্গল, নদী, গ্রাম ছুঁয়ে রেলের পথ চলা। গুরুত্বহীন এই রেলপথ, তবে কিছু এলাকার জন্য অবশ্যই ‘লাইফ লাইন’। কালে ভদ্রে যে লাইনে ট্রেন চলে সেখানে লাটাগুড়িতে বন কেটে সাফ করে রেলপথের ওপর কেন যে একটা ঢাউস ফ্লাই ওভার তৈরী হচ্ছে সেটা অনেকের বোধগম্য হয়নি। দুবছর হতে চলল নির্মাণ কার্য চলছে তো চলছেই, ‘শ্লথ গতিতে। এ সময়ে সবার (?)মুখেই মাস্ক, তবুও গাড়ি যখন নির্মাণ স্থল অতিক্রম করে তখন ধূলোয় চরাচর অন্ধকার, আর ক্ষোভে ফেটে যায় বুক। আমরা উত্তরবঙ্গের মানুষ, স্বভাব প্রতিবাদী নই, মানতেই হয়।
আচ্ছা ! বাতাবাড়ী চা বাগানের বিপরীতে ত্রিভুজসম জমিতে ঘনসবুজ বনানী বা সবুজতর চা বাগান হলেই মানাত ভাল। হয়েছে সরকারী বিনিয়োগে ট্যুরিস্ট লজ। সামনেই মূর্তি নদী, তার উপর দীর্ঘদিনের অবহেলিত ক্ষয়িষ্ণু সেতু। সকালেই নদীতে কিছু পর্যটক জলকেলীতে মগ্ন, অন্তহীণ সেলফি তোলা তো আছেই। সেতুটির প্রবেশ পথের বাম দিকে চায়ের দোকান সংখ্যায় বাড়তে দেয়া যাবে না, আর যেগুলো চালু আছে তাদের একটু চাকচিক্য বৃদ্ধি করা যায় কিনা দেখা দরকার।
ব্রীজের মাঝে দাঁড়িয়ে বামে গভীর বন, খরস্রোতা নদী, গভীর নীল আকাশ প্রান্তে ধ্যানমগ্ন হিমালয়। ডাইনে একই নদী, বনাঞ্চল মিশেছে গরুমারা অভয়ারন্যের গভীরে। কেন ফিল্ম মেকারদের চুম্বকের মত এই অঞ্চল আকর্ষণ করে সেটা উপলব্ধি করা যায়। আমি নিজেও বছরে আট-দশবার মূর্তি নদীর পারে আসি, বর্ষার মূর্তির উচ্ছল পথচলা সত্যি রোমাঞ্চময়। মূর্তির ওপারে নিশ্ছিদ্র বন আর বিরামহীন ঝিঁঝি পোকার ডাক। ঐখানে বিশেষ প্রজাতির এক ঝিঁঝি পোকার ডাক অবিকল হুইসেলের মতো। সরু রাস্তায় দ্রুত চলে এসেছিলাম খুনিয়া মোড়ে। ডাইনে নাগরাকাটা বামে চালসা আর সামনে পথ চলেছে ঝালং হয়ে বিন্দু। আমরা সামনের পথ ধরে চললাম।
শিলিগুড়ি-আলিপুরদুয়ার জংশন রেলপথ অতিক্রম করলেই চাপড়ামারী বনাঞ্চল, এখানেই আমার প্রিয় বনবাংলো। কিছুটা পথ পাড়ি দিয়ে কালিম্পং জেলায় পদার্পণ করেছিলাম। মূর্তি থেকে ৩০ কিমি ঝালং আর তার থেকে ৯ কিমি দূরে বিন্দু নামে ভারতের শেষ জনপদ, তার পরেই বন্ধুরাষ্ট্র ভুটান। ঝালং-এর কাছ থেকে বাঁয়ের পাহাড়ী পথ গেছে তোদে। আজকাল পাহাড়ের যে কোন গ্রামে খুঁজলেই ‘হোম স্টে’ পাওয়া যায়। ঝালং থেকে তোদের দূরত্ব মাত্র ১৮ কিমি, বেশ খাড়া পাহাড়। সময় লাগা উচিত ৪৫ মিনিট কিন্তু সময় কমবেশী দেড় ঘন্টা লাগবে, রাস্তা এমনই বেহাল। পাহাড়ের উপর থেকে জলঢাকা নদী বা হাইডেল পাওয়ার টাউনশীপ, ভুটানে পাহাড়তলীর জনপদ, সবুজ অরন্যের মোড়কে পাহাড় দর্শন এক বিরলতম অভিজ্ঞতা। প্রকৃতিকে আলিঙ্গন করতে বারবার গাড়ী থামাতেই হচ্ছিল।
দশবছর আগে একবার তোদে এসেছিলাম, একজনের মুখে গল্প শুনে। দুপুরে পৌঁছে লজ মালিককে খুঁজে বের করা হল। সরল পাহাড়ী মানুষটি বলেছিল “ছয় মাস পরপর ট্যুরিস্টরা আসে তাই আর আমি বাড়ি ভাড়া দেব না”। পরদিন ছিল রবিবারের হাট, তৎপরতা তুঙ্গে। অনেকটা ভজানোর পর দুটো কাঠের ঘর খুলে দিয়েছিল। হাটের মূল পশরা ফুলঝারু, বড় এলাচ ও আদা। শিলিগুড়ি থেকে ব্যপারীরা আসে। পাহাড়ী গ্রাম থেকে ঘোড়ায় চড়ে মানুষজন হাটে এসেছিল। আয়রন সম্বৃদ্ধ ‘ দাওয়া খোলা ‘নদী, তার উপর বৃটিশদের তৈরী লম্বা ঝুলন্ত ব্রীজটি দেখে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছিলাম। ওপারে পাহাড়ী গ্রাম তাংতা, হাঁটা পথেই যোগাযোগ। সে ব্রীজ এখন ইতিহাস।
আমরা তোদে বাজারের নীচে গাড়ি থেকে নামলাম। পথে দেখেছি দু-একটা হোম-স্টে। একটু নীচে এস.এস.বি. ক্যাম্পের পাশ দিয়ে পথ গেছে স্রোতবতী বিপুলা ঝরনার দিকে। দূর থেকে ঝরনার আওয়াজে স্বর্গীয় নিস্তব্ধতা ভঙ্গ হচ্ছিল। প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে বহমান ঝরনার দিকে দল বেঁধে রওনা দিলাম। ফুল ঝারু গাছের বন, লম্বা পাতার ফার্ণের বাহার, এলাচের খেত পাহাড়ের গায়ে। পাহাড়ের ধাপে ধাপে ধান চাষ হয়েছে। সোনালী বরনের পাকা ধানের শোভা বড্ড মধুর। গৃহস্থের সাজানো বাড়ি, বাহারী ফুল গাছ আর মাচায় ঝুলছে কুসুম বরন স্কোয়াশ ফল। পথে মহিলাদের দেখেছি শুকনো জ্বালানী কাঠের বোঝা বয়ে নিয়ে বাড়ি ফিরছে।
এখানেই দেখা হয়েছিল অচেনা পাহাড়ী যুবকটির সঙ্গে। পরনে তার বেশ অধুনিক রাউন্ড নেক টি-শার্ট ও লোয়ার, নীলচে গামবুট, পিঠে জিনসের ব্যাক-প্যাক। হাসি বিনিময়েই পরিচয়। আমাদের টিমের সবাইকে সুস্বাদু পেয়ারা দিয়েছিল। জঙ্গল থেকে জোগাড় করে একটা বাঁশের লাঠি আমার হাতে দিয়েছিল। একসাথে অনেকটা পথ চলা। এসে দাঁড়ালাম দূরন্ত এক নদীর (ঝরনা) পাড়ে। দূরে রয়েছে ঝোলনা ব্রীজের অবশেষ। আমার সামনে একটা বাঁশের সাঁকো। ওপারে যাবার জন্য সাঁকোয় পা রেখেছিলাম মাত্র, সবাই হৈ হৈ করে বারণ করেছিল হয়ত ঝুঁকি ছিল। ছেলেটি নিমেষে কাছে এসে দাঁড়িয়েছিল।
ওই ঝরনার ওপরের দিকে কাছেই স্রোত ভেঙ্গে বোলেরো পিক-আপ ভ্যানে মানুষজন ও মালপত্র পারাপার চলছিল। কাছেই একপাশে বেশ বড় এলাকা নিয়ে একটা রিসর্ট তৈরী হয়েছে। দৃষ্টিন্দন বড় গোলাকৃতি টেন্ট।, সুইমিং পুল, ফুল গাছ নিয়ে পাহাড়ের কোলে এই রিসর্ট বোহেমিয়ানদের ভাল লাগতেই হবে। অমন অনিন্দ্যসুন্দর প্রকৃতির সামনে বারবার আনমনা হয়ে পড়ছিলাম। পাহাড়ী ওই যুবকটির কথাও ভেবেছি। মনে ছিল, ফিরে গিয়ে গাড়ীর পাশে ওর সঙ্গে বসে লাঞ্চ সেরে, ওকে কিছু অর্থ দিয়ে ভালবাসা জানাব।
হঠাৎ দেখি ছেলেটি সাঁকো পার হয়ে ওপারে একটা ভ্যান দাঁড় করিয়েছে। গাড়িটিতে উঠে হাত নাড়তে থাকল। সবাইকে হতবাক করে আমাদের সামনে দিয়েই ছেলেটি ওপরে উঠে গেল। মহিলারা রিসর্ট মালিকের স্করপিও গাড়ি চেপে উপরে যাবার পথ ধরেছিল। আমারা তিনটি পুরুষ হাঁটা পথে চড়াই ভেঙ্গে লাঠিতে ভর দিয়ে এগুতে থাকি। এস.এস.বি. ক্যাম্পের কাছে আমাদের গাড়ি এসে তুলে নিয়েছিল। তখন চারটে বাজে, একটু পরেই আঁধার ঘনিয়ে আসবে। মুক্তাঙ্গনে সবাই বসে খাওয়া দাওয়া সেরে বাড়ি ফিরেছিলাম। ডুয়ার্স বা তরাই-এ এমন উজার করা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর বহু জায়গা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। ডুয়ার্স সবটাই চিনি এটা বলা বোধহয় ঠিক হবে না।
বলে রাখি সেই লাঠি কিন্তু আমার সংগ্রহে রয়ে গেছে।

আপনাদের মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴
software development company in siliguri,best
                            software development company in siliguri,no 1 software
                            development company in siliguri,website designing company
                            in Siliguri, website designing in Siliguri, website design
                            in Siliguri website design company in Siliguri, web
                            development company in Siliguri