সহজ উঠোন

রেজিস্টার / লগইন করুন।

সব কিছু পড়তে, দেখতে অথবা শুনতে লগইন করুন।

Sahaj Uthon
05-December,2022 - Monday ✍️ By- বিকাশ সরকার 238

সেই গানগুলি/বিকাশ সরকার

সেই গানগুলি
বিকাশ সরকার
^^^^^^^^^^

মনে পড়ে সেই গানঃ
‘হিলহিলাছে কমরটা মোর
শিরশিরাছে গাও
কুন্ঠেক না গেলে এলা
হুদুমার দেখা পাও।'
রাজবংশী মেয়েরা যে জলের দেবতা হুদুম দেওয়ের গান গাইছিল, সেই যে আম্বাডিবারও অনেক ভিতরে, সেবার খুব খরা হয়েছিল। খুব খরা, আমার মনে আছে। এত খরা যে খেতগুলি ফেটে গিয়েছিল ফুটির মতো। পূৰ্ব গয়েরকাটার সেই প্ৰান্তর, যতদূর চোখ যায় শুধু তীব্ৰ রোদের ভিতর রাজবংশী মহিলারা, তাঁদের কণ্ঠে জলের জন্য গান। গান তো নয়, যেন আৰ্তনাদ। তাঁরা যাচ্ছেন খেতের দিকে, সেখানে গিয়ে তাঁরা নগ্ন হবেন, তারপর শরীরে ফুটিয়ে তুলবেন সঙ্গমের ভঙ্গি, যৌনইশারায় তুষ্ট করতে চাইবেন হুদুম দেওকে। তারপর গাইবেন :
‘ডিংশাল শাল কমরটা
তাতে নাই মোর ভাতারটা
কর কি মুই কায় বা কয়
কুন্ঠে গেলে দেখা হয়
দেখা হলে দ্যাহাটা জুড়ায়।'
এই যে আদিম অঙ্গভঙ্গি, সেই ঠা ঠা দুপুরে আমি কি যাইনি আম্বাডিবা পার হয়ে সেই কোন অজানা প্ৰান্তরের দিকে? তাও কি আর জল এলো? বৃষ্টি পড়ল কি এতটুকু? সেবার শাকসবজিচালের দাম বেড়ে গেল কত, আর আমাদের একবেলা খাওয়ার পৰ্ব শুরু হল। তখন আমি, একমাত্ৰ আমিই আমার সঙ্গে ছিলাম। অথচ আমি এক জীবনকৃপণ, সহজে নিজেকে খুনির তকমা দিতে আমি চাই না। ‘তকমা দিতে চাও তো নিতে বলো জীবনের ভার’… আমি আমার এই ব্রাত্যজীবনের ভার নিতে যাব কেন? একটা ব্যৰ্থ জীবন, একটা গেঁয়ো এসেনিনের জীবন, একটা পা-কাটা জাঁ আর্তুর র্যাঁবো-র জীবন, একটা অৰ্থহীন জীবনের ভার নিয়ে আমি কোন মরণের পারে যাব বলতে পারো?
যাব তো জলের দেবতার কাছে। হুদুম দেওকে বলব, ‘এই যে মহিলারা নগ্ন হয়ে কত যৌনভঙ্গিমা করে তোমাকে তুষ্ট করার চেষ্টা করলেন তুমি তাঁদের একবিন্দু জলও দিলে না? তুমি কোন হরিদাস ভগবান হে? একদল মহিলাকে নগ্ন করেও তোমার সুখ নেই?' মরণের পারেই ওই দেবতাকে পাবে তুমি। জলের দেবতা, বায়ুর দেবতা, শব্দের দেবতা। আর দেখবে, ‘ছায়া-ছায়া কত ব্যথা ঘুরে ধরাধামে'। আমি যে আমারই ছায়ামাত্ৰ, সে তো আমার ব্যথার ছায়া; কিংবা বলা যেতে পারে, উল্টো করে, আমিই আমার ব্যথাগুলির ছায়া, ছায়ামাত্ৰসার। উপনিষদ পড়েছি খুব মস্তিষ্ক দিয়ে। দেখেছি যে-আলো সে আসলে মায়া, যে-অন্ধকার সে আসলে মায়া; এই আলোছায়ার নিবিড় খেলা, সে-খেলা আসলে মায়ার। এই যে শরীর, যাকে খুন করতে চেয়েছি আমি, যাকে খুন করাতে চাই আমি; সে তো মায়ামাত্ৰ।
কঠ উপনিষদ আমার বড় প্ৰিয়। যম বললেন, ‘অশরীরং শরীরেষু অণবস্থেষুবস্থিতময়মহান্তং বিভুমাত্মানং মত্বা ধীরো ন শোচাতি।।' মানে হলো, যিনি শরীরের মাঝে অশরীরী হয়ে, নশ্বর বস্তুর মধ্যে অক্ষর হয়ে বিরাজ করেন, সেই মহান, বিভু আত্মাকে জেনে ধীর ব্যক্তি কখনও শোক প্ৰকাশ করেন না। যম আরও বললেন, ‘অণোরণীয়ান মহতো মহীয়ান,য়আত্মাস্য জন্তোৰ্নিহিতো গুহায়াম।য়তমক্ৰতুঃ পশ্যতি বীতশোকো য়ধাতু প্ৰসাদান্মহিমানমাত্মনঃ।।' মানে কী? মানে হলো, এই আত্মা পরমাণু প্ৰভৃতি সূক্ষ্ম বস্তুর চেয়েও সূক্ষ্মতর, আকাশা ইত্যাদি মহৎ পদাৰ্থের চেয়েও মহত্তর। আত্মা নামে প্ৰসিদ্ধ সেই বস্তু এই জীবের হৃদয়গুহাতে জীবাত্মারূপে নিহিত আছে। বিষয়ে অনাসক্ত ও শোকদুঃখবৰ্জিত ব্যক্তি মন প্ৰভৃতি ইন্দ্ৰিয়ের ও ধাতুসকলের প্ৰসন্নতাবশত আত্মার মহিমা প্ৰত্যক্ষ করে বিগতশোক হন। অতএব আমি আমার সব ভারই বইব। বয়ে চলে যাব সেই হুদুম দেও অবধি। জলের কাছে গিয়ে আমাকে বলতেই হবে, এই যে আম্বাডিবার একদল রাজবংশী মহিলা নগ্ন হয়ে যৌনসংসৰ্গের ভঙ্গি করে শীৎকারের মতো সুরে তোমার আরাধনা করলেন, আর তুমি তাঁদের একবিন্দু জলও দিলে না একটু খেত করার জন্য, এই ভার তোমাকেই বইতে হবে। কেননা তুমিই আমার সঙ্গে, সেই কিশোরবেলায়, আম্বাডিবা পেরিয়ে প্ৰান্তরের পারে হুদুম দেও পূজা দেখতে গিয়েছিলে।
তার মানে ‘যমের খেতে' যে আমি গিয়েছি, মানে সেই যমকান্ত রায়, তার খেতে; সে তোমার কঠ উপনিষদেরই যম… যমকান্ত রায়কে, যমকান্ত রায়দের আমিও দেখেছি আমার সাথে। তখনও আকাশে কুয়াশা থাকে, তখনও রোদ তেমন পড়ে না… যমেরা ন্যাংটিমাত্ৰ পরে বলদ নিয়ে মাঠে চলে যান। তাঁদের মাংসল ফরসা কত পাছা যে ছোটবেলায় দেখেছি। মনে হতো, এত যে শীত, তার মধ্যে পাছা অমন উদলা থাকে কী করে, সেখানে কি ঠাণ্ডা লাগে না? পরে, অনেক পরে, যখন আমি শিলিগুড়ি থাকি, দেখেছি আমারও তো একটা ভালো সোয়েটার নেই, আমারও তো নেই একটি লেপ, আমারও তো নেই একটা চাদর… তাহলে আমি শিলিগুড়ির ভয়ংকর এই শীতে বেঁচে আছি কী করে? আসলে প্ৰাণই বাঁচায়। তবে নিৰ্মল মণ্ডল, মরাঘাট ফরেস্টের গাৰ্ড, আমাকে একটি সরকারি কম্বল উপহার দিয়েছিলেন; নইলে আমি তো বরফজীবাশ্মই হয়ে যেতাম সেই ১৯৮৮ সালের ঠাণ্ডায়। তখন যে আমি লিখেছিলুম, ‘প্ৰভু জিশু, এই শীতে আমাকে একটি ভেড়ার লোমের কোট দিও', তা পড়ে লোকে বলল, বাহ, কী চমৎকার পঙক্তি, জিশুর কাছে কি না কোট চাওয়া হলো… একদম নতুন ধরণের ভাবনা, নতুন আবেদন। আমিই শুধু জানতাম, আমি সত্যি-সত্যিই জিশুর কাছে প্ৰেম নয়, একটা গরমজামা চেয়েছিলাম; সেবার শীতে খুবই কষ্ট পেয়েছিলুম আমি। পরে মনে হয়েছে, নিৰ্মল মণ্ডলই সেই জিশু খ্ৰিস্ট। সে শুধু জঙ্গলই নয়, আমার মতো গরিবগুবোকেও সামৰ্থ্য অনুযায়ী পাহারা দেয়। তো সেই যমেদের কাছে, আমি এক নচিকেতা। আমি মরে যাব, জানি, কিন্তু যমেরা কীভাবে অমর হয়ে আছে তার রহস্য আমাকে জানতেই হবে; হ্যাঁ, মরণের পরেও...
বটে। তাই যম বললেন, ‘ন নরেণাবরেণ প্ৰোক্ত এষয়সুবিজ্ঞেয়ো বহুধা চিন্ত্যমানঃ।য়অনন্য-প্ৰোক্তে গতিরত্ৰ নাস্তিয়অণীয়ান হ্যতৰ্ক্যমণু প্ৰমাণাৎ।।' (ইন্দ্ৰিয়ের দ্বারা যে জ্ঞান লাভ করি তা বাহ্যজগতেরই জ্ঞান অথবা মনের দ্বারা যা চিন্তাভাবনা করি তা আমাদের যুক্তিতৰ্কের উপরেই প্ৰতিষ্ঠিত থাকে। সুতরাং যা অত্যন্ত সূক্ষ্ম, ইন্দ্ৰিয়ের অগোচর, চিন্তা দিয়েও যাকে পাওয়া যায় না, তাঁকে তৰ্কের দ্বারা পাওয়ার কথা তো নয়। এজন্যই এই শ্লোকে বলা হয়েছে, বুদ্ধিজীবী যাঁরা তাঁদের কাছে উপদিষ্ট হয়ে আত্মজ্ঞান লাভ হয় না। যাঁদের আত্মার সাক্ষাৎকার লাভ ঘটেছে একমাত্ৰ তাঁরাই এ-বিষয়ে সন্দেহ দূর করতে পারেন। যিনি এই বিচিত্ৰ জগৎকেও জানেন এবং তার ভিতরের সূত্ৰাত্মাকেও জানেন তিনিই একমাত্ৰ আত্মারহস্য সম্বন্ধে জ্ঞান দিতে পারেন।) আর এই জ্ঞান আমি পাই জাঁ আর্তুর র্যাঁবো-র কাছে, পাই গয়েরকাটায় বিগুলঝোরা নদীর পাশে ছনের ঘরে অন্ধ হরকান্ত রায়ের গানে। কী গান? সেই গান হলোঃ
‘দেহতরীর মাঝি ষোল্লজন
ছয়জন তার বৈঠা মারে
গুন টানে নয়জন।
মনমাঝি হাইল ধরিয়া
বসিয়া থাকি চালায় নৌকা
মনের উল্লাসে।
নৌকা যেদিন ঠেকিবে বালুচরে
নৌকা ছাড়ি দাঁড়ি মাঝি
সবে পলাইবে।
নৌকার হয় যেইজন গোর মহাজন
সঙ্গের সাথী লইয়া দেহতরীক
থুইবে ভাই গুপ্ত করিয়া।'
তখন আমার বড় ঘুম পায়, বড় ঘুম পায়; একটি ঘুম, একটি দীৰ্ঘ কবিতার মতো...

আপনাদের মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴
software development company in siliguri,best
                            software development company in siliguri,no 1 software
                            development company in siliguri,website designing company
                            in Siliguri, website designing in Siliguri, website design
                            in Siliguri website design company in Siliguri, web
                            development company in Siliguri