সহজ উঠোন

রেজিস্টার / লগইন করুন।

সব কিছু পড়তে, দেখতে অথবা শুনতে লগইন করুন।

Sahaj Uthon
05-December,2022 - Monday ✍️ By- শৌভিক রায় 283

সাদরি: ডুয়ার্সের নিজের ভাষা/শৌভিক রায়

সাদরি: ডুয়ার্সের নিজের ভাষা
শৌভিক রায়
--------------------------------

ডুয়ার্স যেন স্রষ্টার স্বপ্নমায়া প্রার্থিত এক অলৌকিক ভূখন্ড। ভুটান পাহাড়ের পাদদেশে একদা অরণ্য ঘেরা এই অঞ্চল একেবারে পান্ডব বর্জিত না হলেও, খুব কিছু আদৃত ছিল না। পাহাড় থেকে সমতলে আসবার জন্য ব্যবহৃত হত আঠারোটি গিরিপথ যাদের বিস্তার ছিল পশ্চিমবঙ্গের অধুনা কালিম্পং জেলা থেকে আসামের কামরূপ জেলা অবধি।
সার্জেন রেনি বর্ণিত সেই আঠারো দ্বারের ডুয়ার্স আজ সংকুচিত হয়ে পূর্বে সংকোষ আর পশ্চিমে তিস্তার মধ্যবর্তী ভূভাগের মধ্যে সীমাবদ্ধ। নেই অতীতের সেই বেঙ্গল ও আসাম ডুয়ার্স বিভাগটিও। কিন্তু ডুয়ার্সের অসমতল ভূমি, নীল পাহাড়ের রেখা, হিংস্র শ্বাপদের গভীর অরণ্য, খরস্রোতা নদী, চা-বাগানের সবুজ বিস্তার চোখে স্বপ্নের অঞ্জন লাগিয়ে দেয় সবসময়। কিন্তু এই অপার্থিব সৌন্দর্য কখনই প্রাণ পেত না, যদি না এখানে থাকতেন এত ধরণের বর্ণময় মানুষ! ডুয়ার্সের অনিন্দ্য শোভার সঙ্গে এই মানুষদের রঙিন জীবন মিলেমিশে এমন এক রামধনু সৃষ্টি করেছে, যার তুলনা ভারতবর্ষে আর নেই। এখানেই ডুয়ার্স সবার চাইতে আলাদা। হয়ত এজন্যই সে নিজে এক অদ্ভুত দেশ! আর সেই দেশকে যে একসূত্রে বেঁধে রেখেছে, সে হল ডুয়ার্সের প্রাণের ভাষা, সাদরি।
ডুয়ার্সে রাই, দামাই, দ্রুকপা, লিম্বু, লেপচা, কামি, ধামি, সরকি, শেরপা, মুন্ডা, সাঁওতাল, ধীমাল, টোটো, মেচ, রাজবংশী, রাভা, তামাং, নেওয়ার, অসুর ইত্যাদি বহু জনজাতির মানুষ দেখা যায়। তথ্য বলছে যে, ভারতের আর কোনও প্রদেশ বা স্থানে ডুয়ার্সের মতো এত সংখ্যক জনজাতি দেখা যায় না। এদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন বাঙালি, বিহারী, নেপালি, মারওয়ারি, পাঞ্জাবি, সিন্ধ্রি প্রভৃতিরা। উল্লেখ্য যে, এই জনজাতি মানুষদের বেশ কিছু প্রজাতির আগমন হয়েছিল চা-বাগান পত্তনকে কেন্দ্র করে, ইংরেজদের হাত ধরে। আবার মেচ, রাভা, কোচ, গারো, দ্রুকপা, ভুটিয়া, রাজবংশী ইত্যাদিরা আগে থেকেই এখানে ছিলেন। সম্ভবত, ভূমি দখল করে চা-বাগান প্রতিষ্ঠাকে তারা সুনজরে দেখেন নি বলেই চা-বাগানের কাজ থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে রেখেছিলেন। পৃথিবীর অন্য যে সব দেশে চা-চাষ হয়, সে সব স্থানে কিন্তু এই চিত্র দেখা যায় না। বরং স্থানীয় মানুষ চা-চাষের কাজে খুশি হয়েই যোগ দিয়েছেন। সে অর্থে ডুয়ার্স এখানেও আলাদা। অন্যদিকে, ভূমিপূত্রদের স্বাভিমান অনুমান করেই ইংরেজরা ছোটনাগপুর, রাঁচি, দুমকা, হাজারিবাগ, চাইবাসা, কেওনঝর, বস্তার ও নেপালের নানা অঞ্চল থেকে সস্তার শ্রমিক আমদানি করেছিল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ডুয়ার্সের মাটিই হয়ে গেছে এই বিবিধ ভাষা, সংস্কৃতি, আচার ব্যবহারের বিবিধ মানুষের একান্ত নিজের। এখানকার পরিবেশ, জল, বায়ু সবকিছুর সঙ্গেই একাত্ম হয়ে গেছেন তারা।
একের সংস্কৃতি ও কৃষ্টি মিশে গেছে অন্যের সঙ্গে। একের ভাষায় অনুপ্রবেশ ঘটেছে আর একজনের ভাষার। স্থানীয় জনজাতি মানুষেরাও ধীরে ধীরে আপন করে নিয়েছেন এদের। একে অপরের থেকে ধার করেছিলেন শব্দ, ভাষা, কৃষ্টি, সংস্কৃতি। আর এভাবেই সময়ের হাত ধরে প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল এমন একটি ভাষার যা সর্বজনগ্রাহ্য হয়ে উঠবে। পাশাপাশি প্রয়োজন ছিল নিজস্ব গোষ্ঠীর ভাষাকে বিপন্ন না করা।
ডুয়ার্সের মানুষ তাই বেছে নিয়েছিলেন সাদরি বা সাদানি বা নাগপুরিয়াকে। অনেকে মনে করেন যে, ডুয়ার্স তথা উত্তরবঙ্গের চা-বাগানগুলিতে শুধুমাত্র সংযোগরক্ষাকারী ভাষা হিসেবে সাদরি প্রচলিত এবং এই ভাষা একান্তই চা-বাগানের নিজস্ব সৃষ্টি। কিন্তু এটি সঠিক নয়। এই ভাষার মূল ডায়ালেক্ট মধ্য ভারত থেকে জনজাতি মানুষের সঙ্গেই এসেছিল। এই মুহূর্তে বিহার, ঝাড়খন্ড, পশ্চিমবঙ্গ, অসম, উড়িষ্যা, ছত্রিশগড় ও মধ্যপ্রদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে এই ভাষায় কথা বলার লোকের সংখ্যা এক কোটির ওপরে। পশ্চিমবঙ্গে মালদহ, উত্তর ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, নদীয়া, সুন্দরবন ইত্যাদি মিলে সাদরি ভাষায় কথা বলেন প্রায় পঞ্চাশ লক্ষ সাধারণ মানুষ।
সাদরিকে কেন্দ্র করে ডুয়ার্সের চা-বলয়ের জনগোষ্ঠীর মানুষেরা নিজ নিজ গোষ্ঠীর উর্ধে উঠে সামগ্রিকভাবে একটি গোষ্ঠীতে পরিণত হতে পেরেছেন। করম সম্মেলন, সাহারিয়া পরব, কালীপূজা, ঝুমুর নাচ ও গান ইত্যাদি পালনের ক্ষেত্রে নিজ গোষ্ঠীর স্বকীয়তা ত্যাগ করে, গোটা চা-বলয়ের অংশগ্রহণ একথাই প্রমান করে। আর এটি সম্ভব হয়েছে সাদরি ভাষার জন্যই, কেননা জনগোষ্ঠীগুলি নিজেদের মধ্যে এই ভাষাতেই পারস্পরিক সংযোগরক্ষা করে চলেছে। অন্যদিকে, মানসিক ও সাংস্কৃতিক ভাবে এই একাত্মতাবোধ বর্তমানে জন্ম দিয়েছে একটি নতুন গোষ্ঠীর, যাতে আছেন চা-বাগানের বিভিন্ন জনজাতির মানুষেরা। মনে করা হচ্ছে যে, চা-বাগান ও সংলগ্ন জনপদগুলির তথাকথিত বাবু সম্প্রদায়ের মানুষদের থেকে কিছু না পাওয়া ও অস্তিত্বের সংকটে ভুগতে থাকা এই বিভিন্ন জনজাতি, খানিকটা নিজেদের তাগিদেই, মিলেমিশে এক নতুন গোষ্ঠী তৈরী করে ফেলেছেন এবং তাদের মুখ্য ভাষা হয়ে উঠেছে সাদরি।
সাদরি ভাষার সাহিত্য, সঙ্গীত যথেষ্ট সমৃদ্ধ। বংশানুক্রমে মৌখিকভাবে এই লোক সাহিত্য, সঙ্গীত চলে আসছে। দৈনন্দিন জীবনের নানা কথা বিশেষ করে চা-বাগানের শ্রমিকের লোকজীবনের দুঃখ, কষ্ট, প্রেম, ভালোবাসা, করম পূজা, বিভিন্ন লোকাচার, ঈশ্বর, প্রকৃতি ইত্যাদি সাহিত্যে, সংগীতে ফুটে উঠেছে। যেমন- 'আকাশ হিল্লি তো হিল্লি/ পাহাড় তল্লি তো তল্লি/ এক দিন তোর সুন্দর কাযা/ মাটি মে মিল যায় রে।' (আকাশও হেলে যায়, পাহাড়ও ডুবে যায়, একদিন আমাদের সবারই সুন্দর শরীর মাটিতে মিলে যাবে) । ধাঁধা, প্রবাদ-প্রবচনেও সমৃদ্ধ সাদরি ভাষা- 'শুতাল সংযাপকে না জাগুয়াবে` (শান্ত লোককে রাগলে বিপদ)। রয়েছে নানা ধরণের লোকগান বিবাহ উদযাপনে, অতিথি আপ্যায়নে, পূজায়, জন্মগ্রহনে বা মৃত্যুতেও। উল্লেখ করা যায় সাদি, করম, রাসহুল প্রভৃতি গানের। সাদরি লোককথায় উঠে আসে স্থানীয় মানুষের জীবন ও সংস্কৃতি। কৃষি, শিকার, পশু পালন ইত্যাদিই মূল সে লোককথার। রয়েছে অসংখ্য ছড়া। এইসব লোককথা ও ছড়াতে মানুষের পাশাপাশি বন্যপ্রাণও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়।
হিন্দির ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তায় চা-বলয়ে আজ খানিকটা কোণঠাসা হলেও কিন্তু সাদরি এই অঞ্চলের বুকের ভাষা। ডুয়ার্স-সহ উত্তরের বিস্তীর্ণ এলাকায় বাংলার পরেই এই ভাষায় অধিকাংশ মানুষ কথা বলে থাকেন। মুশকিল হল যে, সাদরি ভাষাকে আজও সে অর্থে মান্যতা দেওয়া হয় নি। আর কে না জানে, সঠিক পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া কোনও ভাষার সংরক্ষণ ভীষণ কঠিন। যে ভাষা এক নতুন গোষ্ঠীর লিঙ্গুয়া ফ্রাংকা, নতুন সংস্কৃতির মূল ধারক, সেই ভাষাকে যদি আমরা সযত্নে রক্ষা না করতে পারি, তবে উত্তর প্রজন্ম কিন্তু আমাদের ক্ষমা করবে না। একথা বোঝার সময় বোধহয় হয়েছে।
তথ্য ঋণ:
১/ আনন্দবাজার পত্রিকায় নিজের লেখা প্রবন্ধ 'তরাই ও ডুয়ার্সের কাছের ভাষা হয়ে ওঠা সাদরি প্রাপ্য সম্মান কবে পাবে?'
২/ উত্তরবঙ্গের চা বাগিচার জনজাতি: সমাজ ও সংস্কৃতি-- দেবব্রত বসু

আপনাদের মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴
software development company in siliguri,best
                            software development company in siliguri,no 1 software
                            development company in siliguri,website designing company
                            in Siliguri, website designing in Siliguri, website design
                            in Siliguri website design company in Siliguri, web
                            development company in Siliguri