জলপাইগুড়ি শহরের কাছে এক শান্ত নিরিবিলি গ্রামের স্বাস্থ্যকেন্দ্রের doctor in charge ছিলেন আমার বাবা। সেই সুবাদে ওখানকার কোয়ার্টারে আমার ছোট থেকে বড় হয়ে ওঠা। ঐ গ্রামের খোলা আকাশ, বাতাস, নদী, সবুজ-সোনালী-হলুদ মাঠ, বর্ষার ঘন কালো মেঘ, 'ঝরো ঝরো মুখর বাদর দিন' এসবকিছুকে জড়িয়ে ধরে বড় হচ্ছিলাম সেখানে। এছাড়া সেসময় বন্ধুদের সাথে খেলাধূলার ফাঁকে পড়ার বই এর পাশাপাশি নানারকম গল্পের বই, বিভিন্ন পত্র পত্রিকা পড়ার দিকে আমাদের
ভাইবোনদের ভীষণ ঝোঁক ছিল। খুব ভালোবেসে আমরা সেসব পড়তাম। বাবা-মায়ের হাত ধরেই বই পড়াকে ভালোবাসতে শিখেছিলাম। সেসময় বাড়িতে নিয়মিত আনন্দমেলা ও শুকতারা আসত। আমরা ঐ পত্রিকাগুলো রীতিমতো কাড়াকাড়ি করে গোগ্রাসে পড়ে শেষ করতাম। তখন আমাদের চাহিদা ছিল কেবল পাক্ষিক, মাসিক এই পত্রিকাগুলো আর পুজোসংখ্যা। ঐসময় সন্দেশ পত্রিকাও বার হত, কিন্তু কোন কারণে ঐ গ্রামে সেটা পৌঁছত না। এদিকে সেটাও আমাদের পড়বার ভীষণ ইচ্ছে। সেসময় আমাদের পাশের বাড়ির এক দাদা উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে জলপাইগুড়ির কলেজে ভর্তি হতে যাবে বলে প্রস্তুতি নিচ্ছিল, আমি তখন ক্লাস ফাইভ। আমার দাদা সেসব শুনে এসে সন্ধ্যায় আমাদের নিয়ে আলোচনায় বসল। শলা পরামর্শ করে আমরা ঠিক করলাম ঐ দাদাটির কাছে জলপাইগুড়ি থেকে সন্দেশ পত্রিকা আনতে দেব। বাবা মা বই টই পড়ার ব্যাপারে কোনদিন বাধা তো দেনই নি বরং বরাবর উৎসাহ দিয়ে এসেছেন তবু সেদিন কেন যে তাঁদের না জানিয়ে চুপিচুপি এই কাজটি করেছিলাম আজও তা আমার বোধগম্য হয়নি। হয়ত মনে হয়েছিল, ওঁনারা এভাবে আনাতে রাজী হবেন না, বকুনির ভয় ছিল মনে। তবে আমরা না জানিয়ে অন্যকিছু নয়, শুধু বই এনেছি জানলে তাঁরা যে আমাদের এই অন্যায় ক্ষমা করে দেবেন, সে আশা আমাদের মনের কোণে কোথাও লুকিয়ে ছিল। যাইহোক, আমরা আমাদের জমানো পয়সা (বাবা নিয়মিত আমাদের জমানোর জন্য পয়সা দিতেন, পুজোর আগে সেই জমানো পয়সার হিসেব হত, তারপর হত খরচ) থেকেই ঐ পত্রিকা কিনব, ঠিক করেছিলাম। পরদিন সকালে জানলার পাশে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম দাদাটির জন্য। বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর দেখলাম সে বেরিয়েছে। তাড়াতাড়ি গিয়ে আমার দাদাকে জানালাম। দাদাও তড়িঘড়ি পয়সা হাতে নিয়ে ছুট লাগাল। তাকে পিছন থেকে ডেকে হাতে পয়সা গুঁজে দিয়ে সন্দেশ পত্রিকা নিয়ে এসো, বলে একছুটে ফের ঘরে। বাবা মাকে লুকিয়ে এসব করা হচ্ছিল বলে স্বাভাবিকভাবেই মনে একটা ভয় কাজ করছিল আমাদের, তাই খুব হুড়োহুড়ি করে ব্যাপারটা সারা হয়েছিল। এদিকে পাড়ার দাদাটি আচমকা ঘটে যাওয়া ঘটনার সবকিছু ঠিকমত না বুঝে কেমন ভ্যাবাচ্যাকা মুখে ঘাড় কাত করে আচ্ছা বলে রওনা দিল। এরপর বেলা গড়িয়ে সন্ধে নামতে লাগল আর আমাদের উত্তেজনার পারদ উঠতে লাগল তুঙ্গে। আর কিছুক্ষণ পরেই এসে যাবে বহু প্রতিক্ষিত সেই বই। এদিকে বাবা আমাদের পড়াচ্ছেন আর আমরা ভয়, উদ্বেগ, উত্তেজনা নিয়ে চোখাচোখি করছি। অবশেষে এসে গেল সেই ক্ষণ। বাইরে থেকে ডাক এল দাদাটির। আমার দাদা দৌড়ে বাইরে গেল। কিছুক্ষণ পর ফিরে এল, হাতে একটা পত্রিকা আর একটা প্যাকেট। মুখখানি বিবর্ণ, ফ্যাকাসে। ইতিমধ্যে বাবার নজরে এসে গেছে ঘটনাটি। তিনি বললেন, কী ব্যাপার? আমরা ভয়ে কাঁপছি। দাদার হাতে ওগুলো কি তা আর জানার সাহস হল না। বাবা এবার বেশ জোরে বললেন, কি হল? অমনি দাদা ধপ করে বসে পড়ল। মুখ নীচু। আমরা সবাই নিশ্চুপ। থমথম করছে চারদিক। বাবা বড় বড় নিষ্পলক চোখে দাদার দিকে তাকিয়ে। দাদা ধিরে ধিরে পাংশু মুখ তুলে বাবার দিকে তাকিয়ে মিনমিন স্বরে জানাল, পাশের বাড়ির দাদাটিকে জলপাইগুড়ি থেকে সন্দেশ পত্রিকা আনতে বলেছিলাম, ও এক প্যাকেট ছানার সন্দেশ আর নিজের পছন্দমত 'খেলার আসর' (তখন বেরোত, ওটাও আমরা মাঝেমধ্যে পেতাম এবং রাখতাম) পত্রিকাটি নিয়ে এসেছে। বাবা শুনে ভীষণ রাগতে গিয়ে হো হো করে হাসিতে ফেটে পড়লেন। সাথে আমরাও। মা পাশের ঘর থেকে দৌড়ে এসে সব শুনে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়লেন। ঘরের সমস্ত ইঁট কাঠ পাথরও যেন হাসতে লাগল আমাদের উচ্ছ্বসিত সমবেত হাসি দেখে। পরদিন সেই দাদাটি হাসি হাসি মুখে আমাদের বাড়িতে এসে জানতে চাইল, সন্দেশটা ভালো ছিল? তোমরা তো বলনি কোন পত্রিকা আনব তাই ওটাই নিয়ে এলাম, ঠিক আছে তো? আমরা সবাই চুপ। পেটের ভিতর গুড়গুড় করছে হাসি। অবশেষে হাসি চেপে আমরা সব বুঝিয়ে বললাম তাকে। সব শুনে, বুঝে সেও হেসে কুটিপাটি হয়েছিল সেদিন।