শীতকাল এলেই খুঁজি শৈশব কৈশোরের দিনগুলো
শীতকাল এলেই খুঁজি শৈশব কৈশোরের দিনগুলো
গৌতম চক্রবর্তী
^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^
কণ্ঠ আর কণ্ঠি। শব্দদু’টো সঙ্গীতকে জড়িয়ে হলেও খানিক আলাদা। হিন্দি ও বাংলা জনপ্রিয় ফিল্মের গান যারা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে পরিবেশন করতেন মূলত তারাই বিভিন্ন দিকপাল কণ্ঠশিল্পীদের ‘কপি সিঙ্গার’ বা কণ্ঠশিল্পী হিসেবে পরিচিত ছিলেন আমাদের ছোটবেলায়। কিশোর কন্ঠ, রফিকন্ঠ, মুকেশ কন্ঠ, লতাকন্ঠি বা আশাকন্ঠি নামে অভিহিত এই কণ্ঠশিল্পীদের শীতের সঙ্গে একটা সম্পর্ক ছিল। আর এখন উৎসবের মুহুর্তগুলোতে যখন সেই কন্ঠশিল্পীরাই গানের রিমেক নিয়ে বিভিন্ন পুজোমন্ডপে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের প্যাকেজে সঙ্গীতানুষ্ঠান পরিবেশন করেন তখন দেখি কেউ সারেগামার অংশগ্রহণকারী, কেই ইন্ডিয়ান আইডলস, কেউ বা আবার ড্যান্স বাংলা ড্যান্স বা মীরাক্কেল আক্কেল চ্যালেঞ্জার অভিধাতে অভিহিত। সঙ্গীত শিল্পী, নৃত্যশিল্পী, কৌতুক শিল্পীদের সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এইভাবে ব্র্যান্ডীয়করণের যুগে আমার হারিয়ে যাওয়া শীতকালের সেই ছোটবেলার অনাবিল মজার দিনগুলোর কথা মনে পড়ে আর নস্টালজিক হয়ে যাই। বাঁশের মাচা বেঁধে এ পাড়ায় সে পাড়ায় গানের জলসা ছিল শীতের সন্ধ্যেরাতের এক বিশেষ আকর্ষণ। সুপারহিট নানান গানকে কণ্ঠে নিয়ে শীতের এই মাচা অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়েই অনেক কণ্ঠশিল্পীর জন্ম। অর্কেস্ট্রা শব্দটির অর্থ ‘সমবেত বাদকদল’। সেই দল থেকে শীত বিদায় নিয়েছে অনেকদিন। সারা বছর রোজগারের তাগিদে অর্কেস্ট্রার সঙ্গে শীতের সে প্রণয় আর নেই। কোন পাড়ায় কোন অর্কেস্ট্রার প্রোগ্রামের খবর বাতাসে আগাম ছড়িয়ে পড়ত। পাড়া কাঁপিয়ে শীতের সন্ধ্যা গড়িয়ে অনেক রাত অবধি চলত শরীর দুলিয়ে সেই গান শোনা। এখন হাতের ইলেকট্রনিক ডিভাইসে কয়েক হাজার গানের সম্ভার শীতের রাতের সেই গানের জলসার আকর্ষণকে অনেকটাই কমিয়ে দিয়েছে। এখন সারা বছরই টিভির পর্দায়, হাতের মোবাইলে ‘তারাদের’ সহজলভ্যতা। ভোটের প্রচারে, নিজের ছবির প্রচারে, মিডিয়ার বাড়বাড়ন্তে নানান ছলছুতোয় ‘তারা’দের অনেকেরই হাঁড়ির খবর আজ আমাদের নখদর্পণে। অত্যুৎসাহী ছাড়া তাদের দর্শনের জন্য দর্শককুলের আকুতি খুবই কম বলে তাই আজ আলাদা করে শীতের রাত জেগে খেলার মাঠের প্যান্ডেলে ত্রিপলে বা কাঠের চেয়ারে বসে তারকাবহুল স্টার নাইট দেখার ধূম ধীরে ধীরে হারিয়েই যাচ্ছে। তবুও দুর্গাপুজো কালীপুজোর রাতে ‘ব্র্যান্ডেড’ বা ‘রেস্তোওয়ালা’ বিশিষ্টজনেদের পুজোতে নামীদামীদের দেখতে এখনো ভির জমে।
প্রকৃতিতে শীত আসত বেশ সেজেগুজে। শীতকে যেন দেখতে পাওয়া যেত প্রতিটি বাড়ির খোলা জায়গায়। বারান্দার রেলিংয়ের ফাঁক গলে শীত চুইয়ে পড়ত। সারা বছর একমাত্র এই সময়টাতেই নানা রং উঁকি দিত সেইসব জায়গায়। বিভিন্ন রংয়ের চন্দ্রমল্লিকা, গাঁদা, ডালিয়ারা উঠত ঝলমলিয়ে। দোকানে ফুলের জলসায় এরা সবসময়ই শীতকে এক অন্য মাত্রা এনে দিত। কিন্তু “এ দিল মাঙ্গে মোর”! ভালো কিছু আমাদের সবসময় চাই। তাই এখন সারা বছর এইসব ফুলের চাষ। শীতের ফুল এখন সারা বছরই ফুলের দোকানে সেজেগুজে দাঁড়িয়ে থাকে। শুধুমাত্র শীতের সঙ্গে তার আর কোনও বিশেষ আত্মীয়তা নেই। শীতকে হারিয়ে ওরাও হারিয়েছে সুগন্ধ, হারিয়েছে আমেজ। বাতাসে শিরশিরে অনুভূতির সঙ্গেই যেন আগাম ভেসে আসত শীতের রসনার সুবাস। মন ভালো হয়ে যেত আগাম কল্পনার রসাস্বাদনে। এটা অস্বীকার করা যাবে না আমবাঙালির কাছে শীত বরাবরই এক ‘সুস্বাদু’ মরশুম। তরতাজা সব্জিভরা বাজারে ঢুকলে খরচের হাতটাও যেন বাগে আসতে চাইত না। এই মরশুমে কেনার ক্ষমতা লাগাম ছাড়া হতেই হবে, কেন না শীত এসেছে যে। এখন না খেলে আর পাওয়া যাবে না। কিন্তু না, আধুনিক কৃষিব্যবস্থা ফসল ফলাতে এখন আর শীতের তোয়াক্কা করে না। শীতের নিজস্ব ফসল ফলছে সারা বছর, শীতের ফুলকপি এখন সারা বছর ধরে খাচ্ছি আমরা। সেই স্বাদ আর নেই। তাই খেতে বসে অতীতের স্বাদের স্মৃতি রোমন্থনই সম্বল আমাদের। শুধুমাত্র স্পেশাল খাবারদাবারের নিরিখেই অতীত আর আজকের শীত ভিন্নতা লাভ করে আমাদের হৃদয়কে আরো ব্যাথাতুর করে সুদূর অতীতে ফিরিয়ে দেয়। তবুও কিন্তু শীত এলে এখনও ব্যাগে ঝলমল করে রূপসী ফুলকপি, চিরসবুজ তন্বী পেঁয়াজকলি, বার্মিজ রুবির মত গাঢ় লাল চকচকে অপরূপা টমেটো, ঝিনুক থেকে বের করা সবুজ মুক্তোর মত মটরশুটি, সপ্তমীর চাঁদের মত বাঁকা কচি সিম, ব্ল্যাকবিউটি বেগুন, লজ্জায় গোলাপী ফরসা নধর মুলো, পাটভাঙা তসরের মত সজীব পালং, পরতে পরতে রহস্যময়ী বাঁধাকপি। বাজার ফেরতা কর্তার ঠাসা ব্যাগে উঁকি দিয়ে আহ্লাদিত গিন্নি ঘন দুধে মালাইদার কফি নয়ত আদা দিয়ে কড়া ফ্লেভারের চা বানিয়ে আনে।
মাছেভাতে বাঙালি অনায়াসে দিনকতক মাছ ভুলে থাকতে পারে। কিন্তু সেও তো হওয়ার নয়। শীতকালের মাছ বাজার রুপোলি শস্যে ভরা। সুন্দরী মৌরলা, আদুরে কাজলি, লাবণ্যময়ী পাবদা, রূপসী বোরোলি, বিদুষী সরপুঁটি, দাপুটে কই, হ্যান্ডসাম কাতলা, কাকে ছেড়ে কার কথা বলি? ফুলকপি কেনার পরে কই মাছ দেখলে গোটা গোটা বড়িসহ ফুলকপি আর আলু দিয়ে কইমাছের ঝোলের কথা ভেবে ঢোক গেলে না এমন নির্লিপ্ত আসক্তিহীন বাঙালি আছে কি ইহজগতে? কিংবা মুলো, বেগুন, আলু, ধনেপাতা দিয়ে মৌরলার চচ্চড়ি যে প্রাণিত বাঙালি খায়নি তার তো বাঙালি জন্মই বৃথা। আবার কালজিরে ও পেঁয়াজ কুচি ফোড়ন দিয়ে ডুমো ডুমো করে কাটা চিকন বেগুন সহযোগে পাবদার ঝোল, নতুবা টাটকা সতেজ পিয়াজকলি দিয়ে ছোট চিংড়ির প্রিপারেশন খেয়ে কত ভিনজাতি পুরুষ যে বাঙালি শ্বশুরবাড়ি পাওয়ার স্বপ্নে বিভোর হয়েছে, হিসেব নেই। আসলে বাঙালির কাছে আমিষ নিরামিষে তফাৎ যে খুব কম এই ঋতু সেটাই প্রমাণ করে দেয়। যদিও দিন পাল্টাচ্ছে। গালভরা রাশভারী সাহেবি নাম দিয়ে বাঙালি জীবনের অঙ্গ হয়ে উঠেছে শতেক লাইফ-স্টাইল ডিজিজ। সুগার, প্রেসার, থাইরয়েড, কোলেস্টেরল, ইউরিক অ্যাসিড, গ্যাস-অম্বল, বদহজম নিয়ে নিত্য বসত করা বহু বাঙালির জীবন থেকে কাটছাট হয়ে গেছে অনেক শখ আহ্লাদ। তবু শীতের ক’টা দিন তারা বেপরোয়া থাকতে চেষ্টা করে। অসুখ তো জীবনভর থাকবে। কিন্তু কড়াইশুটির কচুরি, নলেন গুড়ের সন্দেশ, জয়নগরের মোয়া, ফুলকপির পুরভরা শিঙাড়া, টোপা টুসটুসে কমলালেবু এ সব তো মাত্র ক’দিনের অতিথি। এদের যথাযথ আপ্যায়ন না করলে হয়? লাঞ্চ শেষে বারান্দায় আরাম কেদারায় গা এলিয়ে কৌণিকভাবে আছড়ে পড়া মিঠে রোদ শরীরে মেখে আলতো হাতে খোসা ছাড়িয়ে কমলা খেতে খেতে ঝিমঝিমে অনুভূতি লা জবাব। গরম চা আর নানারকম পিঠেপুলিতে সেরে নেওয়া হয় পৌষ সংক্রান্তির উৎসব। একইসঙ্গে অগুণতি আমন্ত্রণ, একাধিক আত্মীয়-স্বজন-বান্ধবের শুভ পরিণয়, যেখানে উপস্থিত থাকা ইজ আ মাস্ট, সেগুলোর কথা ভুলি কী করে? ছাদ-পিকনিক কিংবা কাছাকাছি কোনও বাগানবাড়ি ভাড়া করে দলেবলে গিয়ে হইহুল্লোড় ও খানাপিনা করে একটা বেলা কাটিয়ে আসা। এই ঋতু কাউকে খালি হাতে ফেরায় না।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴