শাপলা ঝিল
শাপলা ঝিল
সৌগত ভট্টাচার্য
~~~~~~~~~
"কালকের মধ্যে তিনটি লেখা পাঠাতে হবে।" তন্ময় বলে। রিমি চা বানাতে বানাতে বলে, "এটা তোমার ঐ দীপকদার ম্যাগাজিন না কি বললে, কবে প্রকাশ হবে?" তন্ময় ফেসবুক স্ক্রোল করতে করতে বলে, "মহালয়ার আগে!" তন্ময়কে চা দিয়ে রিমি বলে, "পুজোর টিকিট তো সব শেষ! সারাদিন ফোন নিয়ে থাকো অথচ একবারও টিকিট দেখলেও না, কাটার জন্য কাউকে বললেও না!" তন্ময় রিমিকে কোনো উত্তর না দিয়ে রেলের টিকিট দেখতে সার্চ অপশনে গিয়ে দুটো জায়গার নাম টাইপ করে। ভাইজ্যাক লেখার সাথে সাথে নীচে ছোট ছোট করে তন্ময়ের সমুদ্র নিয়ে একটা অপ্রকাশিত কবিতার ছাড়া ছাড়া কয়েকটা শব্দ ঢেউয়ের মত স্ক্রিনে যেন ভেসে আসে, নিমেষে মিলিয়েও যায়। তন্ময় কাউকে বলে বিশ্বাস করাতে পারে না। তন্ময় সঙ্গে সঙ্গে মোবাইলটাকে অফ করে খাটের উপর ছুঁড়ে ফেলে। আশ্বিন মাসের সন্ধ্যায় তন্ময় ফ্যানের স্পিড বাড়িয়ে দেয়।
এ কয়দিন লেখালেখি নিয়ে বসতে পারেনি তন্ময়। আজ সন্ধ্যায় একটু লেখা নিয়ে বসবে ভাবে। তন্ময় বন্ধ ফোনটার দিকে এক ভাবে তাকিয়ে থাকে অনেকক্ষণ। "কি হল চা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে তো!" রিমি তন্ময়কে বলে। তন্ময় চায়ের কাপ হাতে তুলে নিয়ে বলে "আচ্ছা রিমি ধরো যে বন্ধুকে তুমি দেখতে চাও, যে লেখা পড়তে চাও, যে জিনিস কেনার কথা মনে মনে ভাব, যেখানে যেতে চাও সেগুলো কি সার্চে গিয়ে একটা লেটার টাইপ করলে বা তোমার ফেসবুকে বা সার্চে গেলেই কি চলে আসে? "হুঁ, তেমন খেয়াল করিনি কিন্তু বললে বলে মনে হল!" তন্ময় নিজের ফোনটাকে খুব আস্তে বিছানার সঙ্গে হাত ঘষে শিকার ধরার মতো ভয়ে ভয়ে ধরে। বন্ধ ফোনের স্ক্রিনের উপর তন্ময় একটা মুখ দেখতে পায়। নিজের মুখ ফোনের স্ক্রিনে দেখে তন্ময়ের কেমন যেন অচেনা লাগে, অন্য এক তন্ময় যেন। ফোনের সুইচ অন করার সঙ্গে সঙ্গে মুখটা মিলিয়ে যায়। সকালের পোস্টে কমেন্ট পড়তে পড়তে আবার অফ ফোনে মুখ দেখার পর ভয় পাওয়া মুখটা তন্ময়ের হাসি হাসি হয়ে যায়, সব ভুলে যায়। ফোনের আলোয় রিমি তন্ময়ের দুই রকম মুখই প্রায়দিন খেয়াল করে। কিন্তু কিছু বলে না।
অনেকদিন পর আজ তন্ময় বাড়িতে। প্রতিদিনই সন্ধ্যায় কোনো না কোনো কবিতা-আড্ডা বা আলোচনা পাঠ থাকেই। "আজ আসর বাসর নেই?" রিমি তন্ময়কে বলে। তন্ময় খাতা পেন নিয়ে টেবিলে বসে। আজ সে ঠিক করেছে দুই লাইন হলেও লিখবে। তন্ময়ের হাতে ফোন থাকলে তন্ময় কবিতার লাইন বা কবিতার শব্দ কল্পনা করতে চায় না! রিমি লেখালেখির তন্ময়কে কয়েক বছর আগে বড় স্ক্রিনের ফোনটা দিয়েছিল ওর জন্মদিনে। যাতে স্কুলে বা গাড়িতে অবসরে বসে তন্ময় লেখালেখি করতে পারে। তন্ময় ফোনে লেখালেখি শুরুও করেছিল। কিন্তু অনলাইন হয়ে যাই লিখতে চায় কবিতার পরের শব্দটি ওয়ার্ড সাজেশনে চলে আসে কবিতার মুখটাই ঘুরিয়ে দেয়, চিন্তা এলোমেলো করে দেয়। মনে হয় যেন ফোনটি সারাদিন তন্ময়ের মতো মনে মনে কবিতার সঙ্গে ছিল। তন্ময় যা ভেবেছে ফোনটিও তাই ভাবছে, অন্তত সেই ভাবনাকে ছোঁয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। তন্ময়ের ফোনটি কি তাহলে মন পড়তে পারে! কবিতা বুঝতে পারে তন্ময়ের মত! এসব ভেবে অনেক সম্ভাবনাময় কল্পনা সে হারিয়ে ফেলেছে। তবে কি সব সময় মনকে আর ফোনকে এ ভাবে আলাদা করা যায়! কবিতার মতোই জীবনের সঙ্গে ফোনটা এঁটে আছে। কল্পনার কথা একান্তে যেন ফোনটা শুনতে পায়! যে কথা কাউকে কখনো বলা যায় না সেই কথা যেন ফোনটা জেনে গেছে।
লক করা ফোনটায় তন্ময়েরই মতোই একজনের ছায়া দেখা যায় যে হয়ত ফোনের মধ্যে বাস করে।
চার লাইন লিখে রিমিকে তন্ময় জিজ্ঞেস করে
"আচ্ছা রিমি তুমি আমাকে কতটা চেন?"
"ঢং.."
"এই ফোনটার থেকেও বেশি চেন?"
"বোকা বোকা কথা বলো না তো!"
"ফোনটা আমার সব কিছু জানে জানো!"
"সে তো জানিই। আমার সতীন আমার থেকে তোমাকে বেশি জানে!"
"আমার সবটা সে পড়ে ফেলেছে! কোথায় থাকি, কোথায় যাই, কি খাই, কি পছন্দ, কার সাথে কথা বলি, কি লেখা পড়তে ভালোবাসি, কি সিনেমা দেখত ভালোবাসি, সারাদিন আমার গায়ের সঙ্গে লেপ্টে থাকে। আমিই যদিও ওকে এসব ইনফরমেশন জানার জন্য এলাও করেছি। "
" তোমার ইমোশনগুলোও…"
"ভাবছি স্মার্ট ফোন ছেড়ে বেসিক ফোন ইউস করব… এবার তাই করতে হবে! ওদের ইনফরমেশন গ্যাদারিং প্রোগ্রামের অঙ্কের সঙ্গে পেরে ওঠা যাচ্ছে না। জীবনে কোনো প্রাইভেসিই নেই! আমার চিন্তা করার স্বাধীনতাকে চুরি করে নিচ্ছে!"
"খেতে দিয়েছি এস… ঝিরি তোমার ফোনে ফোন করে পায়নি। খেয়ে একবার ফোন করো। পুজোয় ওর ফেরার টিকিট কাটতে হবে।" দার্জিলিং মেল লিখলে যদি পাহাড়ের কুয়াশার কবিতা স্ক্রিনে দেখা যায়!
রাতে কবিতাটা শেষ করে, মন মতো হয়নি লেখাটা। আজই লেখা পাঠানোর শেষ দিন । ফোন মানে তো মেইল আইডি। ফোন অফ রাখলেও তাহলে ওদের প্রোগ্রামিং কথা শুনতে পায়। কে বলে ফোন কথা শোনে না! মনের কথা বুঝতে পারে না! তবে কি সব চিন্তার ভাষা শব্দ চুরি করেছে তাহলে এই ফোন! সারদিন নজরদারি চালাচ্ছে। তন্ময় একজন শিল্পী। সে নিজের কবিতার ঈশ্বর হতে চায়। সে তার কবিতার জন্মদাতা। কবিতাকে জন্ম দেওয়ার আনন্দ আর কারো সাথে সে ভাগ করতে চায় না। তার কেনা যন্ত্র তাঁর কবিতাকে তার ভাবনাকে নিয়ন্ত্রণ করছে!
স্টাফ রুমের দরজা দিয়ে দূরে দেখে অবনীদা হাঁটতে হাঁটতে আসছেন। সংস্কৃতের অবনীদা থেকে আত্মভোলা মানুষ তন্ময় খুব কম দেখেছে। সারাদিন মুখে হাসি। জগৎ সম্পর্কে ধারণা একবারে নিজের তৈরি অবনীদার। দুনিয়ার কোনো খবর অবনীদা রাখেন না। পেছনে সকলে হাসাহাসি করে অবনীদাকে নিয়ে, অবনীদার দুনিয়া থেকে পিছিয়ে থাকা নিয়ে। অবনীদা তো ফোন ব্যবহার করে না। সকলে অনেকবার বলেছে "এত টাকা মাইনে পাও একটা ফোন কেন না কেন?" অবনীদা বলে, "না রে ভাই আমার মাথা কেমন করে ওই ফোনগুলো দেখলেই। আমি পারি না ওগুলো ব্যবহার করতে! ভয় লাগে!" তন্ময় ভাবে কেউ অবনীদার চিন্তা ভাবনা পছন্দ কোনো প্রোগ্রামিং জানে না। এই বিশ্ব বাজারে অবনীদা তাই অচল একজন মানুষ। তাই কি অচল অবনীদাকে নিয়ে সবাই হাসি ঠাট্টা করে। জীবনে একটা মেলও করতে পারেনি। অবনীদার মেল আইডি কোথাও হয়ত নেই। থাকলেও সেটা কেউ কখনও ব্যবহার করেনি। একটা ফোন এসে তন্ময়ের ভাবনাগুলো হারিয়ে যায়। "হ্যাঁ কাল রাতেই লেখা গুলো পাঠিয়ে দিয়েছি। একটু দেখে নিও!" ফোনে তন্ময় বলে।
"কি তন্ময় ভাই ভালো আছো?" স্টাফ রুমের ধীর গতিতে ঢুকে অবনী তন্ময়ের ঘাড়ে হাত রেখে বলে। "খাতা শেষ হল অবনীদা?" অবনী মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বলে। অবনী নিজের চেয়ারে বসে ঢুলতে ঢুলতে ঘুমিয়ে পড়ে। তন্ময়েরও কাল রাতে ভালো ঘুম হয়নি। মধ্য রাতে তন্ময় দেখে বন্ধ ফোনটি যেন ওর দিকে তাকিয়ে আছে। যেন কিছু বলতে চায়। কিছুতেই চিন্তা চুরির ভয়ে কবিতা আসে না তন্ময়ের। যেন বলতে চায় অবচেতনে ভেসে বেড়ানো যে শব্দে ধরতে পারছে না তন্ময়, ফোনটি যেন সেই শব্দ গুলো সার্চ করে দেওয়ার জন্য অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে আলো জ্বালিয়ে। শুধু তন্ময়ের আঙুলের স্পর্শ চায়। কিন্তু তন্ময় এই জালে পা দেবেই না। তন্ময় ঘামতে থাকে, অস্থির লাগে। স্টাফরুম থেকে বাথরুমে গিয়ে একটা সিগারেট ধরায়। সিগারেটের সাদা ধোঁয়ার রিংয়ের ঠিক মাঝখানে যেন তন্ময় আটকে গেছে। বাথরুমের বন্ধ দরজায় রিংটা অনেকক্ষণ ধরে হওয়ায় ভেসে বেড়ায়। তন্ময় পরের সিগারেটের টান দিয়ে জোরে ফুঁ দিয়ে রিংটা ভেঙে দেয়।
"তুমি জানো অবনীদার কোনো স্মার্ট ফোন নেই!" তন্ময় রিমিকে বলে।
"কেন সবার কি স্মার্ট ফোন থাকতেই হবে?"
"না তা নয় কোনো মেল আইডিও নেই"
"আচ্ছা কি হয়েছে তোমার বল তো। সারাদিন ফোন ফোন ফোন। একবার বন্ধ করছ একবার খুলছ। ফোন নিয়েই আছ। কে কাকে লাইক দিল কমেন্ট করল এগুলো না দেখেও থাকতে পার না আবার বলছ ফোন নাকি তোমার সব ইনফরমেশন জানতে পারে। কি হয়েছে গো তোমার! যদি তোমার কথা মেনে নিই যে তোমার সব কিছু জানতে পারে তো অসুবিধা কী?"
"আসলে একটা মেল আইডি দিয়েই শুধু ফোনে ঢোকা যায়। কিন্তু বেরোনোর রাস্তা কেউ জানে না। সেই আইডি আমাকে আমার চিন্তাকে নতুন করে সাজায়। একটা মেল আইডি মানেই আমাদের এক একজনের ক্লোন!"
"আমাদের দেশের বেশির ভাগ লোকের স্মার্ট ডিভাইস নেই, তাহলে তাদের চেনে না!"
"তোমার কোনো ধারণা আছে কত লোক নতুন স্মার্ট ডিভাইস কিনছে রোজ রোজ! তাদের সকলকে চিনে ফেলছে, কোনো প্রাইভেসি নেই কারো!"
"পাগল পাগল কথা বল না তো! তোমার ভালো লাগে বলে আজ আলু পোস্ত করলাম একবার বললেও না কেমন হয়েছে!"
"ভালো হয়েছে। একটা মেল আইডি দিয়ে ফোন খোলা মানে সেটা একটা অন্য আমিই, যাকে দেখা যায় না।" তন্ময়ের চোখ মুখ পাল্টে যায়।
"তার সঙ্গে অবনী দার সম্পর্ক কোথায়?"
"অবনীদার কোনো মেল আইডি নেই, স্মার্টফোন নেই তাই ওর ক্লোন নেই, এই দুনিয়া অবনীদাকে ছুঁতে পারে না… অবনীদার কোনো ফোন নেই মেইল নেই, তাহলে দ্বিতীয় কোনো সত্বা নেই!"
রাতে খাওয়ার টেবিলে বসে কথা গুলো বলছিল তন্ময় আর রিমি। খাওয়ার পর অনেকক্ষণ আগে হাত শুকিয়ে গেছে। খাওয়ার পর রিমি বলে, "কাল শেফালী মাসি আসবে না ওর বাড়িতে পুজো। এই ফোন ফোন না করে ওঠ। সব বাসন রাতেই ধুতে হবে।" তন্ময় রিমিকে বোঝাতে পারে না ওর অস্থিরতাটা ঠিক কোথায়!
ভোরের দিকে ফোরলেনটা ঘুমিয়ে থাকে হালকা কুয়াশার বালাপোষ জড়িয়ে। ফাঁকা হাইওয়ের ওপর দিয়ে লম্বা ব্রিজ পেরিয়ে বাকালীর দিকে যাচ্ছে তন্ময়। কয়েকদিন রাতে ভালো ঘুম হয়নি তন্ময়ের। ভোরের শিরশিরে হওয়ায় তন্ময়ের মাঝে মাঝে চোখ লেগে আসছে বিজয় ডাকে "স্যার"। তন্ময় "অবনী দা..." বলে ডাকতেই চেক লুঙ্গি আর স্যান্ড গেঞ্জি পরে অবনী বেরিয়ে আসে। "তন্ময় ভাই তুমি…!" অবনী যেন বিশ্বাস করতে পারে না। অবনী তন্ময়কে ডেকে ঘরে বসিয়ে মালাকে চা করতে বলে। তন্ময় আর অবনী ঘরে এসে বসে।
"বল ভাই তন্ময়। আমি তো তোমাকে দেখে অবাক হয়ে গেলাম!"
"হওয়ারই কথা। হঠাৎ ইচ্ছে হল সকালে বেরোনোর বুঝলে!"
"বেশ করেছ আজ দুপুরে খেয়ে যাবে..."
"না সেটা সম্ভব না অবনীদা। অন্যদিন আসব রিমিকে নিয়ে!"
অবনী বুঝতে পারছে না তন্ময় কেন এসেছে। তন্ময়ের মধ্যে একটা অস্থিরতা দেখতে পাচ্ছে। তন্ময়ও কিছু একটা বলতে চাইছে জানতে চাইছে। কিন্তু কি বলবে! তন্ময় মাঝে মাঝে অবনীর দিকে তাকাচ্ছে আর ভাবছে অবনীই যেন এই গ্রহের শেষ মানুষ যার কোনো ইনফরমেশন কারো কাছে নেই। ওর ক্লোন তৈরি করতে পারেনি এই প্রযুক্তি। "নিন…" মালা তন্ময়ের সামনে টেবিল টেনে চা দিয়ে যায়।
অবনীদাকে বিদায় দিয়ে তন্ময় গাড়িতে উঠে বসেছে। অবনীর দৃষ্টিতে একটা কিছু খুঁজে পায় তন্ময়। যার সম্পর্কে কোনো তথ্য বিশ্ব বাজার জানে না। ওর না আছে ফেসবুক না আছে গুগল। ডিজিটাল দুনিয়ার বাইরে একজন মুক্ত মানুষ। অবনীর ভাষা তো এখনো ডিকোড করতে পারেনি কেউ। এ সব ভাবছিল আর একটা নিরাপত্তাহীনতা তন্ময়কে কুঁড়ে খাচ্ছে তন্ময়কর। কি যেন একটা হারানোর ভয়, চুরি হয়ে যাওয়ার ভয়। নিজের সব গোপনীয়তা যেন উন্মুক্ত হয়ে যাচ্ছে গোটা পৃথিবীর কাছে। যে ফোন দিনরাত তন্ময়ের চিন্তা থেকে ভালোবাসা সব সব ইনফরমেশন চুরি করছে, প্রতিনিয়ত তাকেই সে আরেক গোপনীয় পাসওয়ার্ড দিয়ে স্ক্রিন লক করে রেখেছে। অন্যদিন গোটা পৃথিবীর কাছে উন্মুক্ত করে দিচ্ছে নিজেকে। এ যেন চোরকে মালিক নিজেই দ্বার পাহারা দিয়ে সুরক্ষা দিচ্ছে চুরি করার জন্য।
গাড়ির জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে ছিল তন্ময়। বাইরে নীল আকাশ ঝকঝকে করছে। রাস্তার ধারে ধানের সবুজ আর কাশের সাদা মিলে মিশে এক হয়ে গেছে।
কিছুক্ষণ পর জানলার বাইরের দৃশ্যর বদলে তন্ময় জানলার কাচে নিজের মুখ দেখতে পায়। চমকে ওঠে তন্ময়। ঠিক যেন স্ক্রিনলক ফোনের ভেতর থেকে সেই মানুষটা নিস্পৃহ মুখে ওঁর দিকে তাকিয়ে হাসছে। তন্ময় জানলার থেকে চোখ সরিয়ে সামনের দিকে তাকালে লুকিং গ্লাস উইন্ড স্ক্রিন সব জায়গায় একই মুখ ভেসে ওঠে। ওর দিকে তাকিয়ে আছে একটি মুখ। যেন নিজের ছায়া নিজের সবচেয়ে বড় প্রতিপক্ষ। নিজের ছায়া দেখে তন্ময়ের অস্থির লাগে, ঘামতে থাকে। চেনা রাস্তায় বিশ্বজিতের দোকানের ঠিক পাশেই একটা বড় ঝিল, ঝিলের পর নদী। তন্ময় এখানে এসে গাড়ি দাঁড় করায়। ঘামতে ঘামতে গাড়ি থেকে নামে। পুজোর আগে শাপলায় লাল হয়ে যায় ঝিলটি। গাড়ি থেকে নেমে একটা সিগারেট ধরায় সে।
বিশ্বজিতের দোকানে দুধ চা ফোটানোর গন্ধ আর ঝিলের পাশের বাঁধ থেকে শিউলির একটা হালকা গন্ধ তন্ময়ের নাকে আসছে। খুব পরিচিত এই বাঁধের রাস্তা ধরে তন্ময় ঝিলের দিকে হাঁটা দেয়। নীল আকাশে ছায়া শাপলা ঝিলে পড়েছে। ঝিরি অনেকদিন বাদে বাড়ি ফিরছে। পুজো আসছে। এই বয়সে পুজো নিয়ে উন্মাদনা না থাকলেও একটা প্রতীক্ষা থাকে তন্ময়ের। ঝিলের জলের সমানে এসে দাঁড়ায় সে। আকাশের ছায়ার সঙ্গে একজন লম্বা মানুষের ছায়া ঝিলের জলে পড়ে, শাপলার মাঝে। পিঠের পেছনে রোদ। একটা মাছরাঙা ঝুপ করে জলে এসে একটা মাছ ছো দিয়ে নিয়ে উড়ে যায়। জলের মধ্যে ছায়াটা ভেঙে ভেঙে ঢেউ ওঠে। শাপলা ঝিল, দুধ চায়ের গন্ধ, পুজো আসার অপেক্ষা ঝিরির বাড়ি ফেরা, শিউলির গন্ধ, মাছরাঙার জলে এসে পড়া এর চেয়ে বিশুদ্ধ কবিতা আর কি হতে পারে। দেখার পর পৃথিবীর সরলতম ভাষায় লিখে ফেলতে পারার নামই তো কবিতা। আর যে আকাশের মত না লেখা শব্দ যা ছায়া হয়ে শাপলা ঝিলে পরে তার নাম তো অপেক্ষা। এই সব কবিতা কী স্মার্ট ফোন তার প্রোগ্রাম ল্যাঙ্গুয়েজ দিয়ে ডিকোড করতে পারে!
তন্ময়ের অবনীকে ফোন করতে ইচ্ছা হয়। তারপর মনে পড়ে, অনেক দিন আগে অবনী একটা খুব ছোট্ট বেসিক ফোন কিনেছিল। ওর ফোন দেখে ভয় লাগত, ফোন ব্যবহার করত না সে। তারপর থেকে অবনীর ফোন নেই। সে নিয়ে অনেক ঠাট্টা তামাশা করেছে সকলে। আজকাল রিমির দেওয়া ফোনে নিজের মুখের ছায়া দেখে তন্ময়ের ভয় লাগে, নিজের ছায়া নিজেকে অস্থির করে তোলে। তন্ময় নিজে নিজেই মুচকি হাসে, ভাবে অবনীদার না ব্যবহার করা বেসিক ফোনের ওইটুকু ছোট্ট স্ক্রিনে নিজের মুখের ছায়া তো পড়ত না।
শাপলা ঝিলে যে ছায়টি পড়েছে ঠিক অবনীর মতো দেখতে লাগছে না!
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴